৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২; ব্রিটেনের সদ্যপ্রয়াত রানী ২য় এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান চলছে। ব্রিটেনের দেয়ালে দেয়ালে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলছে রাজতন্ত্রবিরোধী পোস্টার, তাতে লেখা, “Make Elizabeth the Last“, অর্থাৎ এলিজাবেথই যেন এই তালিকার সর্বশেষ ব্যক্তি, এরপর যাতে আর রাজতন্ত্র না থাকে। গত ৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় এলিজাবেথ পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজতন্ত্রবিরোধীরা আবারও সরব হয়েছে, রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গিয়েছে তাদের। তাছাড়া, ব্রিটেনের রানী পৃথিবীর মোট ১৪টি দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান। তার মৃত্যুর পর সেই দেশগুলোতেও হয়েছে রাজতন্ত্রবিরোধী মিছিল। তারা চায় রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। এই বিলুপ্তির দাবির পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। চলুন, আজ আমরা ব্রিটেনের রাজতন্ত্রবিরোধীদের সেসব যুক্তির সাথেই পরিচিত হই।
YouGov কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ব্রিটেনের ১৮-২৪ বছর বয়সী ৪১ ভাগ নাগরিক রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ও একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান চায়। অন্যদিকে, মাত্র ৩১% নাগরিক চায় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজা বা রানীর উপস্থিতি।
২০২১ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ব্রিটেনের ২১ শতাংশ নাগরিক রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি চায়, যেখানে ৬৩ শতাংশ চায় রাজতন্ত্র অব্যাহত থাকুক। তবে অনেকেই রাজতন্ত্রের সংস্কার দাবি করেছেন। রানী ২য় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর বর্তমানে ২০২২ সালে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রবিরোধীদের শতকরা হার আরও বেড়েছে। তাদের রয়েছে নিজস্ব দল, যারা রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির পক্ষে প্রচারণা চালায়। রাজতন্ত্রবিরোধীদের প্রভাব ব্রিটেনে বেড়েছে, যার জন্য রানীর কফিন নিয়ে যাওয়ার সময় রাখা হয়েছিল বিশেষ নিরাপত্তা। সেখানে দেখা গিয়েছে রাজতন্ত্রবিরোধীদের জড়ো হতে। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র বিরোধীদের রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু যুক্তি।
রাজপরিবারের অতিরিক্ত ব্যয়
ব্রিটেনের রাজতন্ত্রবিরোধীদের অন্যতম যুক্তি হচ্ছে রাজপরিবারের ব্যয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্রিটিশ রাজপরিবারের মোট ব্যয় ছিল ১০২.৪ মিলিয়ন পাউন্ড, যার মধ্যে সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৬৩.৯ মিলিয়ন, রাজকর্মচারীদের বেতন বাবদ ২৩.৭ মিলিয়ন, রাজপরিবারের ভ্রমণ বাবদ ৪.৫ মিলিয়ন, এবং ইউটিলিটি ও গৃহস্থালির খরচ বাবদ ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড। এই বিশাল রাজকীয় ব্যয়ের উৎস পূর্বে ছিল রাজপরিবারের বংশগত রাজস্ব। রাজা তৃতীয় জর্জের আমলে সেই রাজবংশের উত্তরাধিকারের রাজস্ব বিলুপ্ত করা হয়, ন্যস্ত হয় হাউজ অব কমন্সের কাছে। তখন থেকে হাউজ অব কমন্স ব্রিটেনের পাবলিক ফান্ড থেকে রাজপরিবারের সকল ব্যয় নির্বাহ করা হয় ব্রিটেনের সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে।
ব্রিটেনের রাজতন্ত্রবিরোধীদের দল রিপাবলিক-এর মতে, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রকৃত ব্যয় ৩৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড। যেসকল ব্রিটিশ নাগরিক রাজতন্ত্রের বিরোধী, তাদের মতে- রাজপরিবারের এই বিশাল ব্যয়ের কোনো অর্থই হয় না। তারা মনে করে, রাজতন্ত্র ব্রিটিশ সরকারের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যত ব্যয় হচ্ছে, তার চেয়ে কম ব্যয়ে একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব চালনা করা যায়।
অযাচিত উত্তরাধিকার
হাজার বছরে ধরে চলে আসা ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বর্তমান গণতান্ত্রিক যুগেও টিকে আছে। দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার পুত্র তৃতীয় চার্লস বর্তমান ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার গ্রহণ করেছেন। তিনিই বর্তমান ব্রিটিশ রাজা। বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে অন্যতম একটি সরকারব্যবস্থা হচ্ছে রাজতন্ত্র। রাজতন্ত্রে আবার দুটো ভাগ রয়েছে- নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র। যদিও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের মতো নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের রাজা বা রানী রাষ্ট্রীয় নির্বাহী ক্ষমতার মালিক হন না, তবুও উভয় রাজতন্ত্রেই পরবর্তী রাজা বা রানী নির্ধারিত হন বংশপরম্পরায় বা উত্তরাধিকারসূত্রে। এক্ষেত্রে দেখা যায়- রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী নাগরিকগণ নিজেদের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান পান না। তারা শুধু জানেন রাজপরিবারের কেউ পরবর্তী রাজা বা রানী। একপ্রকার ধারণা করাই যায় কে হচ্ছেন পরবর্তী রাজা বা রানী। এক্ষেত্রে যোগ্যতা বা অন্য কোনো নির্ধারক দেখার আগে দেখা হয় তিনি রাজবংশের উত্তরাধিকার কিনা।
ব্রিটেনের রাজতন্ত্রেও একই রকমের নির্বাচন পদ্ধতি রয়েছে। সেখানকার রাজতন্ত্রবিরোধীদের অভিমত, ব্রিটিশ রাজতন্ত্র অনেকটা আমলাদের মতো কাজ করে, কিন্তু তারা উত্তরাধিকারসূত্রে আসা লোক। এই কাজের জন্য একজন লোক এভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে যোগ দেয়াকে অনেকে দেখছেন অপ্রয়োজনীয়, অযাচিত ও অনুচিত রূপে। রিপাবলিক দলের অনেকেই মনে করে, বর্তমান যুগে এসে এভাবে একজন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন বংশপরম্পরায় বা উত্তরাধিকারসূত্রে, যা গণতন্ত্রের সাথে যায় না। অনেকের মতে, সরকার চালনার জন্য যেহেতু নির্বাচিত লোক আছে, তাই রাজতন্ত্র রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।
উপনিবেশবাদের লিগ্যাসি
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সীমানা বোঝাতে একসময় একটি কথা প্রচলিত ছিল, “ব্রিটিশ রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হয় না।” মূলত, ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো চলত শোষণ, নিপীড়নের মাধ্যমে; লুট করে আনা হতো একটি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ। ব্রিটিশ রাজা বা রানী হন এই উপনিবেশ অঞ্চলসমূহের প্রধান, যার আদেশে নিয়ন্ত্রিত হয় ঐ অঞ্চলগুলো। ফলে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ দেশগুলোর সংগঠন কমনওয়েলথ অব নেশনের প্রধানও রাজা বা রানী। তাছাড়া, সদস্য রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেনের রাজা বা রানীকে নিজ দেশের রাজা বা রানী মেনে থাকে। প্রাক্তন উপনিবেশ দেশগুলোর শাসনের লিগ্যাসি আজও বহন করে চলছে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র।
রাজা তৃতীয় চার্লসের সিংহাসনে আরোহণের সময় অনেক বিশ্লেষক বর্ণনা করেছেন, এমন এক মুকুটের অধিকারী হলেন তিনি, যার পেছনে রয়েছে শত শত বছরের লুটতরাজের লিগ্যাসি। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বিরোধীদের অভিমত- এই রাজতন্ত্র উপনিবেশবাদের ঘোর ছাড়া কিছুই না। আধুনিক যুগে এসে সেই ঘোর থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ার উচিত বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, রাজতন্ত্র যেহেতু উপনিবেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত, সেহেতু রাজতন্ত্রের সাথে উপনিবেশবাদের রয়েছে দৃঢ় সম্পর্ক। ‘রিপাবলিক’ দলের ব্রিটিশ নাগরিকগণ উপনিবেশের লিগ্যাসি বহন করার জন্য ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের পতন চান, চান নতুন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।
যুবসমাজের অনীহা ও লিবারেলিজমের বৃদ্ধি
জাতি হিসবে ব্রিটিশরা রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। তারা চায় পুরাতন রীতিনীতি, নিয়মের পরিবর্তন না হোক। আবার উদারনৈতিকরা চায় ইতিবাচক পরিবর্তন। ব্রিটেনে রাজপরিবারের উপর চালানো জরিপে যারা রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি চায় তাদের বয়স ১৮-২৪ বছর। আবার যেসব ব্রিটিশ নাগরিকের বয়স ৬৫ বা তার বেশি, তারা প্রায় সবাই ব্রিটিশ রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার পক্ষে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে- ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে বর্তমানে যুবক প্রজন্ম চাচ্ছে না রাজতন্ত্র থাকুক। তাদের মধ্যে নির্বাচিত, উত্তরাধিকার সূত্রে নন এমন কেউ রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হওয়ার পক্ষে মত বেশি। যুবসমাজের কাছে রাজতন্ত্রের চোখে পড়ার মতো কোনো কাজ নেই, শুধু ব্রিটিশ ঐতিহ্য হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরোধীদের ইদানীং আরো সোচ্চার হতে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনের বেশিরভাগ নাগরিক রাজতন্ত্রের পক্ষে। দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর অবশ্য অনেকেই রাজতন্ত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের প্রতি অনেক ব্রিটিশ নাগরিক অসন্তুষ্ট হলেও এটা অনস্বীকার্য যে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রবিরোধীদের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশ কম।