২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। কয়েক মাসের রাজনৈতিক উত্তেজনা পরিণত হয় সামরিক সংঘাতে, স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন হিসেবে ইউক্রেনে প্রবেশ করে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে ভৌগলিক আর রাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে যুদ্ধ করছে রাশিয়া আর ইউক্রেন, যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিটি সংকটের সর্বশেষ খবরই মানুষের কাছে পৌঁছে যায় বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে, খবর পৌঁছানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অনলাইন পোর্টালগুলোও।
ব্যক্তির সংগ্রহে থাকা তথ্যের উপর ভিত্তি করে মানুষ বিদ্যমান সংকটে বিভিন্ন পক্ষ নেয়, পক্ষ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়, নিজের আত্মোপলব্ধি। চলমান রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যেও মানুষ নিজের উপলব্ধির আলোকে একটি পক্ষ নির্ধারণ করেছে, পক্ষ নির্ধারণ করতে হয়েছে রাষ্ট্রগুলোকেও।
পক্ষ নির্ধারণের জায়গা থেকেই মানুষ ইউক্রেন কিংবা রাশিয়ার পক্ষে তর্কের ঝড় তুলেছে, কেউ কেউ সংহতি জানাতে নেমে এসেছেন পথে। চলমান রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্ব অস্ত্র আর রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে, একইভাবে সমর্থন আর সংহতি জানাচ্ছে এসব দেশের মানুষেরাও। ইউক্রেনের প্রতি বিভিন্নভাবে যারা সংহতি জানাচ্ছেন, তাদের কাছে সংহতি জানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে সূর্যমুখী ফুল।
রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ কেন চলছে?
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রথম আড়াই মাসেই প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে ইউক্রেনে, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী এখনও প্রতি সপ্তাহে ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য রাশিয়াকে শুরুতে প্রায় দুই লাখ সেনা নামাতে হয় ইউক্রেনের যুদ্ধ ফ্রন্টগুলোতে। এখনও ইউক্রেনে মোতায়েন আছে লক্ষাধিক রাশিয়ান সেনা। এই বিপুল সংখ্যক সেনার পরিচালনব্যয়ের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধ, বিভিন্ন ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা।
বিপুল এই অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যেও চলছে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ব্যাপারে। কিংবা এই যুদ্ধ পরিণত হতে পারে এক চিরস্থায়ী যুদ্ধ হিসেবেও। অনেকগুলো কারণেই রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনও চলমান।
প্রথমত, ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার সংকটকে কেন্দ্র করে, ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। ভূরাজনৈতিক কারণগুলো এই যুদ্ধে এখনও বিদ্যমান, বিদ্যমান নিরাপত্তার সংকটও। ইউক্রেনকে হয়তো এই যুদ্ধে মানচিত্র ভাঙার বেদনাদায়ক পরিণতি মেনে নিতে হবে। কিন্তু, ইউক্রেনের শাসকদের এই পরিণতি মেনে নেওয়ার আগপর্যন্ত যুদ্ধ চলতেই থাকবে।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন আর রাশিয়া যুদ্ধের একটি মৌলিক কারণ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ধারণা, পরবর্তীতে যেটি ট্রিগারিং কারণ হিসেবে পরিণত হয়েছে। পরিচয়ের ধারণার ক্ষেত্রে বিভাজনের সাথে যুক্ত হয়েছে ভৌগলিক বিভাজন, যেটি যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ভূমিকা রাখছে। পরিচয়ের ধারণা ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে একটি ‘জেনারেল এভিল’ হিসেবে।
তৃতীয়ত, উইনস্টন চার্চিলের মতে, রাশিয়ানরা জাতীয় স্বার্থকে দেখে সবার আগে, জাতীয় স্বার্থের জন্য নিতে পারে রাজনৈতিক ঝুঁকি। রাশিয়ানরা সামরিক সক্ষমতাকে যেমন সম্মান করে, একইভাবে অসম্মান করে অক্ষমতাকে, বিশেষ করে সামরিক অক্ষমতাকে। যুদ্ধ শুরুর পরে রাশিয়ার দিক থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি পরিণত হয়েছে সম্মানের বিষয়ে। ফলে, রাশিয়ানরা চূড়ান্ত বিজয় চাইছে, চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য নিয়োগ দিচ্ছে লোকবল, আর বিনিয়োগ করছে রাষ্ট্রীয় অর্থ।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইউক্রেনের পক্ষে সংহতি
আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকগণ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে বহুমেরুর দাবি করলেও ইউক্রেন সংকট এসে আন্তর্জাতি রাজনীতিকে আবার স্নায়ুযুদ্ধের মতো দ্বিমেরুতে পরিণত করেছে। রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করেছে একপক্ষ পছন্দ করতে, সমর্থনের জন্য একটি পক্ষ বেছে নিতে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক বিশ্ব নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছে ইউক্রেনকে, সামরিক সহায়তা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে। রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো, যেগুলোর শাসকেরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্নভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বাইরেও নাগরিকদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে অনেকে সংহতি জানাচ্ছেন। যেহেতু যুদ্ধে আপাতদৃষ্টিতে ভিক্টিম হয়েছেন ইউক্রেনের মানুষেরা, জীবন আর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে তাদেরকেই, লড়তে হচ্ছে স্বজনদের নিরাপত্তা আর সুরক্ষার জন্য, সংহতি বেশি আসছে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের পক্ষেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন ইউক্রেনের একক রিপাবলিকের ধারণার প্রতি সমর্থন জানাতে সূর্যমুখী ফুল সম্বলিত মাস্ক পরেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের স্টেট অব দ্য ইউনিয়নের ভাষণের দিন পোশাকের হাতা সজ্জিত করেন সূর্যমুখী ফুলে।
রাশিয়ার আক্রমণের অন্যায্যতা আর অগ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ফেব্রুয়ারিতেই বিক্ষোভে নামেন হাজার হাজার সুইস নাগরিক, জেনেভার জাতিসংঘের ইউরোপিয়ান সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ করেন আরো হাজারখানেক সুইস নাগরিক। প্রো-ইউক্রেনীয় সুইসরা যখন রাশিয়ার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ দাবি করছিল, সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত রাশিয়ানরা আন্দোলনে নামে ‘আই এম রাশিয়ান’ ট্যাগলাইন নিয়ে।
ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ শহরে ইউক্রেনের সাথে সংহতি জানাতে রাস্তায় নামেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। প্রতিবাদ ছড়িয়ে যায় প্যারিস, মন্টপিলার আর মার্সেইয়েও।
রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ডেও একইভাবে শুরু হয় প্রতিবাদ। ফিনিশরা হেলসিংকিতে স্লোগান দিচ্ছেন, “পুতিনের সাথে রাশিয়ার পতন হোক।” প্রায় তিন হাজার মানুষ জড়ো হয় ভিয়েনাতে, অস্ট্রিয়ার ইউক্রেনীয় কমিউনিটি রাস্তায় নামে ‘স্টপ দ্য ওয়ার’ স্লোগান নিয়ে। রোমে প্রতিবাদ করতে নামে এক হাজারের বেশি মানুষ।
এর বাইরেও, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা ইউক্রেনের নাগরিকদের পক্ষে সংহতি জানিয়েছেন, বিভিন্নভাবে ইউক্রেনীয়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইউক্রেনীয়দের প্রতি সংহতি জানানোর একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে সূর্যমুখী ফুল, যেটি ইউক্রেনের জাতীয় ফুল।
সূর্যমুখী কেন?
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের শুরুতেই একটি সূর্যমুখীর বীজ নিয়ে ভিডিও ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, এক ইউক্রেনীয় নারী রাশান অস্ত্রে সজ্জিত এক সেনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন কিছু সূর্যমুখী বীজ নিয়ে।
ভিডিওর শুরুতেই তিনি রাশিয়ান সৈনিককে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে বলেন,
আপনি এখানে কি করছেন? আপনারা দখলদার, আপনারা ফ্যাসিস্ট। অস্ত্র নিয়ে আমাদের জায়গায় আপনারা কেন এসেছেন? আমার কাছে থাকা এই সূর্যমুখী বীজগুলো নিন, এবং আপনাদের পকেটে রেখে দিন, যাতে এই মাটিতে আপনারা যখন পড়ে থাকবেন, সেখান থেকে সূর্যমুখীর চারা গজাবে।
ভাইরাল এই ভিডিও সকলের মনোযোগ কেড়েছে, ইউক্রেনের জাতীয় ফুল সূর্যমুখী একইসাথে হয়ে উঠেছে ইউক্রেনীয়দের কাছে শক্তিমত্তা আর উষ্ণতার প্রতীক। সূর্যমুখী ফুল সূর্যের আলোর সাথে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে বলে সূর্যের উষ্ণতা আর শক্তিমত্তার প্রতীক হিসেবে দেখা হয় আগে থেকেই। উত্তর আমেরিকা থেকে স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের মাধ্যমে ইউরোপে বিস্তৃতি ঘটে সূর্যমুখী ফুলের। কালের আবর্তে যা ছড়িয়ে যায় ইউক্রেনেও। শুরুতে নিছক গহনা আর ওষুধ হিসেবে সূর্যমুখী ফুল ব্যবহৃত হলেও সময়ের সাথে শুরু হয় সূর্যমুখীর বাণিজ্যিক উৎপাদন। ইউক্রেনে সূর্যমুখীর বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে খ্রিষ্টান চার্চগুলোর তেল আর চর্বির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা।
পরবর্তীতে ইউক্রেনের সব প্রান্তে ছড়িয়ে যায় সূর্যমুখী ফুল। ইউক্রেনের প্রতিটি অঞ্চলের কৃষকেরা জড়িয়ে যায় সূর্যমুখী চাষের সাথে। ইউক্রেনের বাড়ির আঙিনা, কৃষিজমি থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই গ্রীষ্মে দেখা যায় সূর্যমুখীর সোনালী হাসির চিত্র। চলমান এই যুদ্ধে ইউক্রেনে ব্যাহত হচ্ছে সূর্যমুখীর উৎপাদন, ব্যাহত হচ্ছে গত বছরের উৎপাদিত সূর্যমুখী বীজের রপ্তানিও। এর প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনেও। বিভিন্ন স্থানে গড়ে ৫৬ শতাংশ বেড়েছে সূর্যমুখীর বীজ থেকে উৎপাদিত তেলের দাম।
চলমান যুদ্ধেও অবশ্য কিছু অঞ্চলের কৃষক সূর্যমুখী ফুলের উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। সূর্যমুখী ফুল উৎপাদনের মাধ্যমে সেই কৃষকেরা অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেন; স্বপ্ন দেখেন নিজেদের সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবার। এসব অঞ্চলের প্রত্যেক কৃষকই নিজেদের বিবেচনা করছেন যোদ্ধা হিসেবে, তাদের যুদ্ধের অস্ত্র সূর্যমুখী ফুল।
ইউক্রেনের জাতীয় জীবন আর চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি তাই হয়ে উঠেছে সূর্যমুখী ফুল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও সেই প্রতিচ্ছবিকে কেন্দ্র করেই সূর্যমুখী ফুলের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে সংহতি।