গত এপ্রিল মাসে ভারতের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এদেশের প্রখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা আইআইটি-র ৫০ জন প্রাক্তন ছাত্র দেশের তফসিলি জাতি, আদিবাসী এবং অনগ্রসর শ্রেণীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বহুজন আজাদ পার্টি বা বাপ নামক একটি রাজনৈতিক মঞ্চের সূচনা করেন। এই মঞ্চের সদস্যরা তাদের দৈনন্দিন রুজি-রোজগার ছেড়ে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে পূর্ণাবয়ব দেওয়ার কাজে আপাতত ব্রতী হয়েছেন। যদিও রাজনৈতিকভাবে বাপ বিজেপি বা কংগ্রেস কাউকেই সমর্থন করতে রাজি নয়, কিন্তু তারা এই মুহূর্তে নির্বাচনে লড়াই করার কথাও ভাবছে না। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন নয়, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ২০২০ সালের বিহার নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে সাধারণ নির্বাচন।
প্রধানত তফসিলি জাতি, আদিবাসী বা অনগ্রসর শ্রেণী থেকে আগত বাপ-এর সদস্যরা মনে করেন যে, দেশের পিছিয়ে পড়া বর্গের ৮৫ শতাংশ মানুষ এখনও খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের আশু প্রয়োজন। বিজেপি বা কংগ্রেস দলকে তাদের সমর্থন না করার কারণও এটাই। তারা মনে করেন, এই দুই দলেই ক্ষমতা শীর্ষনেতৃত্বের মধ্যে কেন্দ্রীভূত যা তাদের চিন্তাপ্রসূত মডেল-এর সঙ্গে মেলে না। বিজেপির বিপক্ষে তাদের আরও অনুযোগ, গেরুয়াবাহিনী ধর্মকে অবলম্বন করে পুরো সমাজকেই বিপথে চালনা করার বিধ্বংসী খেলায় মেতেছে এবং তারা যদি আরও একটি মেয়াদ ক্ষমতায় আসে, তাহলে দেশের যে ক’টি স্কুল-কলেজ অবশিষ্ট আছে, সে সবই মন্দিরে রূপান্তরিত হবে!
ভারতের রাজনৈতিক চিত্রপটে বাপ-এর আত্মপ্রকাশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে।
এই সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ
প্রথমত, বাপের উত্থান যে সময়ে ঘটছে, সে সময়টা কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রে একটি দলের শাসন চলছে; কোনও জুলিমিলি সরকারের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। এমনকি নরেন্দ্র মোদী সরকার নানা সমালোচনা সত্ত্বেও এক বড় অংশের ভারতীয় মানুষের কাছে এখনও যথেষ্ঠ জনপ্রিয়।
ভারতের অর্থনীতিও পৃথিবীর চোখে অন্যতম দ্রুত উন্নতিশীল; সাময়িক বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও যখন দেখা যায় যে দেশের অভিজাত একটি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র থেকে পাশ করা সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ছাত্ররা তাদের নিজেদের আইডিন্টিটিকে আরও উন্নত দেখতে চায়, তখন বুঝতেই হয় যে ভারতের গণতন্ত্রের একটি চিন্তাশীল দিক এখনও রয়েছে। বা বলা চলে, দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এলেও সামাজিক রাজনীতিতে চোরাস্রোত আজও বইছে যথেষ্ঠ জোরে। একটি মজবুত গণতন্ত্রে কখনও স্থবিরতা আসে না আর ভারতেও সেটা আসেনি।
স্বাধীনতার সাত দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ভারতের গণতন্ত্রে নিচু তলার মানুষের যেমন সবদিক থেকে স্বাবলম্বী হয়নি, তেমনি রাজনৈতিক গণতন্ত্রের অবিরাম ঢেউয়ে তাদের অধিকার-ইচ্ছেগুলোর কথাও আর চাপা থাকেনি তাদের সমাজের অন্তরে। আজ যে আইআইটি-র প্রাক্তনীরা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের কথা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর, সেই কারণে খুলেছে একটি রাজনৈতিক মঞ্চও- তা কিন্তু কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। একটি বিশেষ ক্ষমতায়ন হয়েছে বলেই অনগ্রসর শ্রেণীর সন্তানরা আজ নিজেদের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিয়ে চলার কথা ভাবতে পারছে। অনেকে হয়তো “ওই দেখো সংরক্ষণের প্রসাদ পেয়ে কেমন গান গাইছে দলিত” বলে কটাক্ষ করবেন বাপ-এর এই প্রতিষ্ঠাপর্বকে, কিন্তু একথা কিছুতেও অস্বীকার করা যায় না যে আজ দলিত বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীদের কণ্ঠে জোর এসেছে এই রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়নের জোরেই। আর এই ক্ষমতায়নের হাত ধরেই আসতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন যার জন্যে প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব এবং ইচ্ছে। এখানেই ভারতীয় গণতন্ত্রের এক বড় সাফল্য।
দলিত আন্দোলনকে দিশা দেখতে পারে শিক্ষিত, মেধাসম্পন্ন যুবারাই
দ্বিতীয় বিশেষত্ব হচ্ছে রাজনৈতিক। আজ ভারতে দলিতদের উন্নয়নে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা প্রবাদপ্রতিম দলিত নেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের কথা বারবার নানা মঞ্চে তুললেও বাস্তবে তারা তার মন্ত্র বা শিক্ষা যে খুব পালন করে চলে তা নয়। দলিতদের প্রতি প্রকৃত অন্যায়-অবিচারের বিরোধিতা করে এক ধরনের সামাজিক-ইন্টেলেকচুয়াল আন্দোলন তৈরি করার কোনো প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি; তারা ব্যস্ত থেকেছে দলিতের ‘দলিত পরিচয়ের’ আইডিন্টিটিতে ক্রমাগত শান দিয়ে তাকে উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভোটের মেশিনে ফায়দা তুলতে। এতে তাদের রাজনৈতিক অভীষ্ট পূরণ হলেও সার্বিকভাবে দলিতের উত্থান ঘটেনি; আম্বেদকর মহাশয় রয়ে গিয়েছেন এক অন্তঃসারশূন্য দলিত আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে।
এযাবৎ উত্তরপ্রদেশ-কেন্দ্রিক বহুজন সমাজ পার্টিকেই দলিত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যেত, কিন্তু দলের নেত্রী মায়াবতীর দুর্নীতি কলঙ্কিত ভাবমূর্তি বা তার দলের নির্বাচন জিততে রামধনু কৌশল ইত্যাদি আদতে প্রমাণ করেছে যে দলিতের হয়ে লড়াই করা আসলে তাদের মার্কেটিং-এর পন্থা। আসল লক্ষ্য হচ্ছে এক নতুন রাজনৈতিক এলিট-এর সূচনা করা যাদের মেধার কমতি থাকলেও পসারের কমতি নেই। বাপ-এর মতো নবীন-কেন্দ্রিক দলগুলি এই সুযোগসন্ধানী রাজনীতিতেই বিরক্ত এবং চায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যেখানে দালাল নয়, থাকবে দলিতদের অধিকার নিয়ে লড়াই করার সত্যিকারের নেতৃত্ব।
বাপ-এর উত্থান গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেও যে এর মধ্যে এক ধরনের শ্রেণী পরিচয় রয়েছে- মেধা, শিক্ষা, চিন্তাশীলতার। শুধুমাত্র জাতিগত পরিচয়ের উপরে নির্ভর করে কোনো সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটে না, কারণ কাস্ট বা জাতি একটি নেতিবাচক আইডেন্টিটি। জাতিকে আগে শ্রেণীতে পর্যবসিত করে তবেই উন্নয়নের পথে এগোনো সম্ভব হবে।
আজকের সুযোগসন্ধানী, মধ্যমেধার রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এই রূপান্তরের পথ নিরুপন করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, তার জন্যে চাই শিক্ষিত, চিন্তিত, উদ্যোগী, স্বার্থত্যাগী যুবসমাজকে আর সেটাই বাপ তার প্রাথমিক পদক্ষেপে করে দেখিয়েছে। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনও শ্রেণী-কেন্দ্রিক হলেও এই একই কারণে আটকে গেছে, কারণ তাতে নতুন নেতৃত্ব, যা শুধু নির্বাচন নয়, আদর্শের জন্যেও লড়বে, উঠে আসেনি। উন্নয়নের পথ যদি আদর্শের উপরে ভিত্তি করে না তৈরি হয় তবে সে উন্নয়ন অধরাই থেকে যায়। কিছু স্বার্থপর শ্রেণীর কার্যসাধন হয়তো হয়, কিন্তু সিংহভাগই রয়ে যায় আঁধারে।
তবে বাপ-এর আগে আপ দেখিয়েছে এগোবার রাস্তা খুব সহজ নয়
বাপ-এর উঠে আসা নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক ঘটনা। তা আশার আলো দেখায় এই কারণেও যে শিক্ষিত তরুণদের হাতে রয়েছে এই নতুন উদ্যোগের জয়ধজ্জা। কিন্তু পাশাপাশি, শিক্ষিত হলেও রাজনীতিতে আনকোরা এই তরুণদের হাতে এই রাজনৈতিক মঞ্চটি কতটা সুরক্ষিত সে নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। অদূর অতীতে আমরা দেখেছি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি বা আপ খুব সাড়া জাগিয়ে শুরু করলেও তা বেশিদিন স্থায়িত্ব হয়নি।
বাপের মতো আপ জাতিগত নয়, শ্রেণীগত নিরিখেই কাজ শুরু করেছিল কিন্তু অচিরেই রাজনীতির পাঁকে পড়ে সে দ্রুত তার আসল লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হতে শুরু করে। তাড়াহুড়ো করে জাতীয় নির্বাচনে লড়তে গিয়ে নিজের নাম অহেতুক ডোবায়, জড়িয়ে পড়ে অন্দরের কোন্দলে এবং কংগ্রেস এবং বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোই হয়ে ওঠে তার প্রধান দায়িত্ব। এতে আপ-এর যে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল- দেশ ও সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা- তা রয়ে যায় তিমিরেই। বড় বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত লড়তে লড়তে আপ-এর পরিচয়ই হয়ে ওঠে বিভ্রান্তিমূলক।
একই কথা কি বাপ-এর ক্ষেত্রেও খাটবে? অতীতে আমরা দেখেছি কীভাবে বড় বড় দলগুলো তাদের প্রভাবের জোরে ছোট আইডেন্টিটি-মূলক দলগুলিকে বেমালুম গিলে খেয়েছে। রাজনৈতিক-এর সঙ্গে লড়াইতে অরাজনৈতিক যুঝতে পারেনি বেশিক্ষণ, না পারার কথাও। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিকের সঙ্গে লড়তে যে প্রজ্ঞা, বিবেচনা এবং লড়াই করার রসদ দরকার পড়ে তা অরাজনৈতিকের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না; থাকে শুধু সদিচ্ছা। কিন্তু শুধুমাত্র সদিচ্ছা নিয়ে আগাপাশতলা রাজনীতির নাগপাশে জড়িয়ে পড়া এই সিস্টেম-এর সঙ্গে কতক্ষণ লড়াইয়ে টিকতে পারবে বাপ-এর মতো নব্য সংগঠন?
শুভেচ্ছা রইল, সঙ্গে সঙ্গে কিছু আশঙ্কাও।
Featured Image Source: Twitter