গত দশকের শুরুতে আরব বসন্তের যে রঙিন ফানুশ উড়েছিল তিউনিসিয়ায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো সেই বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে আরব উপদ্বীপের দেশ ইয়েমেনে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তরুণরা, সংস্কারপন্থীদের টানা এগারো মাসের আন্দোলনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আলি আব্দুল্লাহ সালেহ। নব্বইয়ের দশকে উত্তর আর দক্ষিণ ইয়েমেন একীভূত হওয়ার পর থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আলি আব্দুল্লাহ সালেহ, ২০১২ সালে তার পতনের পর শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের প্রত্যাশাকে সঙ্গে করে ক্ষমতায় আসে হাদি সরকার।
কিন্তু, যে প্রত্যাশা আর পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে সালেহর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন মনসুর হাদির সরকার, কার্যত তার কোনটাই পূরণ হয়নি। বরং, ক্ষমতার পালাবদলের ঝুঁকি আর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে গেছে ইয়েমেনের বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীগুলো, তৈরি করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট। সময়ের সাথে এই সংঘাতে জড়িয়েছে আঞ্চলিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোও, স্বার্থের সন্ধানে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোও।
দশকব্যাপী চলা এই সংঘাতে ইয়েমেনের ২৭ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৩.৬ মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে, ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো। অর্ধেকের বেশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে, অর্ধেকের বেশি শিশু ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। ২৪.৩ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে দূর্ভিক্ষের সম্ভাবনার সামনে, প্রতি পাঁচ জনের একজন ভুগছে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে।
এই সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে আহত আর নিহত মানুষের পরিসংখ্যান। গত এক দশকে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছে গৃহযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে। আহত-নিহতের এক-চতুর্থাংশের বয়সই ১৮ এর নিচে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সমীকরণের পাশাপাশি অনেকগুলো অভ্যন্তরীণ প্রভাবক ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, ইয়েমেনকে দাঁড় করিয়েছে এই ভয়াবহ মানবিক সংকটের সামনে। এই আর্টিকেলে আলোচনা হবে সেই অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলো নিয়েই।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব
এগারো মাসের আন্দোলনের পর আলি আব্দুল্লাহ সালেহ সরে যান প্রেসিডেন্ট পদ থেকে, শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের প্রক্রিয়া। কিন্তু, আলি আব্দুল্লাহ সালেহের পরিবর্তে যিনি ক্ষমতায় আসেন, সেই মনসুর হাদি দেশটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অর্থাৎ, সালেহ যে এস্টাবলিশমেন্টকে সঙ্গে করে দেশকে শাসন করেছেন, সেই স্বার্থগোষ্ঠীর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি ইয়েমেন। পরবর্তীতে যখন নির্বাচন হয়, তখন প্রার্থী হন মনসুর হাদি, সংস্কারপন্থীরা ব্যর্থ হন ক্ষমতার বৃত্ত থেকে এই স্বার্থগোষ্ঠীকে সরাতে। এর কারণ, দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরশাসনের অধীনে থাকা ইয়েমেনে স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি, তৈরি হয়নি আলি আব্দুল্লাহ সালেহ পরবর্তী সময়কে সংস্কারপন্থীদের রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো নেতা।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির জন্য অনেকগুলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পাদনের সুযোগ তৈরি করে দিতে হয়। রাজনৈতিক কর্মীদের যেতে হয় সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। প্রথমে একজন রাজনৈতিক কর্মীর মধ্যে রাজনৈতিক দর্শন তৈরি হয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, সময়ের সাথে সেই চিন্তা রূপ নেয় কাজে। এই রাজনৈতিক কাজগুলো একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়, অভ্যাস থেকে তৈরি হয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব একসময় দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, ঠিক করে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি।
কঠোর স্বৈরশাসন আর ধর্মীয় নেতৃত্বের বিশাল প্রভাব থাকা ইয়েমেনে এই প্রক্রিয়াগুলোর কোনটিই যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়া আটকে গেছে রাজনৈতিক দর্শন তৈরির মতো প্রাথমিক কাজেই। ফলে, ইয়েমেনের রাজনৈতিক কাঠামোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন কোনো নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি, যার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদলের দিকে প্রবাহিত করার মতো দক্ষতা আছে। জনগণের মধ্যে একসময় গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো নিয়ে তৈরি হয় আস্থার সংকট। দক্ষতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সালেহের বলয় থেকেও উঠে আসা সম্ভবপর ছিল না, কারণ সেই বলয়ের সবসময়ই লক্ষ্য ছিল তাদের উন্নয়ন, সাধারণ ইয়েমেনিদের উন্নয়ন না।
স্বৈরতন্ত্রের অধীনে থেকে অনেক দেশেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হলেও, ইয়েমেনের এই রাজনৈতিক শূন্যতা ব্যতিক্রম নয়। বরং, ইয়েমেনের মতোই শূন্যতা বেশিরভাগ দেশে তৈরি হয়, স্বৈরতন্ত্রের অধীনে থাকলে। এই রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতাই সংকট তৈরি করেছে, ইয়েমেনকে টেনে নিয়ে গেছে গৃহযুদ্ধের দিকে।
শিয়া-সুন্নিদের ধর্মীয় বিভাজন
ধনী আরব উপদ্বীপ অঞ্চলের দরিদ্রতম দেশ ইয়েমেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও। ঐতিহাসিক কারণেই ইয়েমেনের উত্তর আর দক্ষিণ অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে, পার্থক্য রয়েছে সামাজিক জীবনেও। এর সাথে নবম শতাব্দী থেকে শুরু হয় ধর্মীয় বিভাজন। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে ইয়েমেনের জনগণ প্রাথমিকভাবে মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত, জায়েদী শিয়া ও শাফেয়ী। জায়দী শিয়াগণ প্রধানত সৌদি আরবের লাগোয়া উত্তর ইয়েমেনের পার্বত্য অঞ্চলে বাস করে, তাদের বসবাস আছে মধ্যে ইয়েমেনেও। এই গোত্রগুলো আভিজাত্যের দাবিদার হলেও, তারা প্রধানত কৃষিকাজের সাথে জড়িত, বসবাস করে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে।
অন্যদিকে, শাফেয়ীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ ইয়েমেনে, প্রধানত এদের বসবাস শহুরাঞ্চলগুলোতে। ব্যবসায়ী শ্রেণি হওয়ায় ইয়েমেনের অর্থনীতির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণও এই শাফেয়ীদের হাতে, তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কাঠামো।
বিভিন্ন কারণেই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠেনি, নব্বইয়ের দশকে উত্তর আর দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হওয়ার পরও জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় একই রাজনৈতিক কাঠামোতে আসেনি দুই সম্প্রদায়। বরং, সবকিছুতে প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহের বলয়ের সুন্নিকরণ প্রক্রিয়া উস্কে দিয়েছে দুই সম্প্রদায়ের বিভাজন, সাম্প্রতিককালে ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে এই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ উঠেছে তুঙ্গে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের অন্যতম প্রধান নিয়ামক এই শিয়া-সুন্নি বিরোধ।
পানির সংকট ও জলাধারের নিয়ন্ত্রণ
মরুভূমির দেশ ইয়েমেনে পানির সংকট দীর্ঘ সময় ধরেই চলছে, ইয়েমেনের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে থেকেছে জলাধারগুলোর নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে জনসংখ্যার উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইয়েমেনের দুই অংশেই, সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে কৃষিকাজের ধরনও। জলবায়ু পরিবর্তনে উচ্চঝুঁকিতে থাকা ইয়েমেনে পানির একটা বিপুল অংশ ব্যয় হয় ক্বাত উৎপাদনে, যা ব্যবহৃত হয় স্নায়ু উত্তেজক দ্রব্য হিসেবে। এই জিনিওগুলো পানির ব্যবহার বাড়িয়েছে ইয়েমেনে, পানির উৎসের নিয়ন্ত্রণে তৈরি হওয়া সংঘাতের ঘটনাগুলোকে পরিণত করেছে সংস্কৃতিতে।
চলমান গৃহযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়েছে উঠেছে পানির উৎস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি, পানির উৎস নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন স্থানে হয়েছে হামলা। ফলে, পানির উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাধ্য হয়েই কৃষিজীবী ইয়েমেনীদের অংশ হতে হচ্ছে গৃহযুদ্ধের। অনেকে নিরাপদ অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে আবার সংঘাতপ্রবণ এলাকাতে ফিরে আসছেন পানির স্বল্পতার কারণে, ফলে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। বর্তমানে ইয়েমেনের অর্ধেক মানুষের কাছে দৈনন্দিক কাজ চালানোর মতো যথেষ্ট পানির সরবারহ নেই।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অভাব
একীভূত ইয়েমেনে দুই দশকের শাসনামলে কঠোর স্বৈরতন্ত্রের চর্চা করেছেন আরব বসন্তের ফলে উৎখাত হওয়া প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ, বাঁধাগ্রস্ত করেছেন সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিকাশকে। কঠোরভাবে মোকাবেলা করা হয়েছে সিভিল সোসাইটির কন্ঠকে, বাঁধাগ্রস্ত করা হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকাশকে। সাধারণত, স্বৈরশাসক কঠোরভাবে দেশ চালালে মানুষ রক্ষণশীল রাজনীতির দিকে ঝুঁকে যায়, রাজনীতিতে বেড়ে যায় ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব। ইয়েমেনে ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও সাম্যের দৃষ্টিকোণের অভাব ছিল। জায়দী ইমামরা তাদের শাসনামলে ভৃত্যের মতো আচরণ করেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে, যার লিগ্যাসি ছিল আলি আব্দুল্লাহ সালেহের সময়েও। ফলে, সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ, শাসনযন্ত্র হয়ে পড়ে এককেন্দ্রিক।
এককেন্দ্রিক কাঠামোর চূড়ান্ত ফলাফল সাধারণভাবে যা হয়, ইয়েমেনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আলি আব্দুল্লাহ সালেহের পতনের সাথে সাথেই ভেঙে পড়ে পুরো শাসনকাঠামো, শিয়া-সুন্নি বিবাদের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও কোন্দলে জড়ায় সালেহর প্রভাব বলয়ে থাকা স্বার্থগোষ্ঠীগুলো। সবমিলিয়ে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকাশ না হওয়ায় একীভূত ইয়েমেনে মসৃণ হয়নি জাতিগঠনের প্রক্রিয়া, যার চূড়ান্ত ফলাফল এই দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধ।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি
বর্তমানে ইয়েমেনে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আছে প্রায় ১ কোটি। ইয়েমেনে অস্ত্রের উপস্থিতি হিসেবে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কাছেই গড়ে একটির বেশি অস্ত্র আছে, আছে বিভিন্ন ধরনের বিধ্বংসী অস্ত্রের উপস্থিতিও। ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর শহরকেন্দ্রিক কাঠামো আর সাধারণ নাগরিকদের কাছে এই বিপুল অস্ত্রের উপস্থিতি ব্যর্থ হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আধুনিক যুগে এসে তৈরি হয়েছে হবসের ‘প্রকৃতির রাজ্যের’ মতো অরাজক অবস্থা, যেখানে সবাই সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সামরিক বাহিনীর কাঠামোবদ্ধ সীমাবদ্ধতা আর বিপুল অস্ত্রের উপস্থিতি ইয়েমেনকে করেছে সংঘাতপ্রবণ, সংঘাতকে করেছে সর্বব্যপ্তীময়। এই সর্বত্র সংঘাতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইয়েমেনে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন।
বর্তমানে ইয়েমেনে তিনটি প্রভাবশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি রয়েছে। আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট আর হুতিরা। আরব বসন্তের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিজেদের অবস্থানকে পোক্ত করতে শুরু করে আল কায়েদা ইন আরব পেনিনসুলা, ২০১৫ সালে তাদের দখলে আসে ইয়েমেনের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল। এই সংগঠন আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য পায়, পোর্টের কর, ব্যাংক লুটের মতো ঘটনাগুলো দিয়ে তৈরি করেছে আয়ের নিজস্ব উপায়ও। আল-কায়েদার মতো শক্ত অর্থনৈতিক কাঠামো না থাকায় ইয়েমেনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ইসলামিক স্টেট, তাদের নির্বিচারে হত্যা আর মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা তাদেরকে করেছে জনবিচ্ছিন্ন। তবে, সময়ের সাথে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছে হুতিরা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আবির্ভূত হয়েছে আঞ্চলিক নিরাপত্তার সংকট হিসেবেও।
ইয়েমেন সংকটের ভবিষ্যৎ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বেশ অনেকগুলো গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গেছে ইয়েমেন, গৃহযুদ্ধগুলোতে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। গত শতাব্দীতে ইয়েমেনে প্রথম গৃহযুদ্ধ হয় ১৯৬২ সালে, উত্তর ইয়েমেনে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধ চলে প্রায় আট বছর, প্রাণ হারায় প্রায় দুই লাখ ইয়েমেনি। এরপর এডেন নিয়ে কয়েকবার সংঘাত হয়েছে দুই ইয়েমেনের মধ্যে, ইয়েমেনের দুই অংশের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতও হয়েছে আশির দশকে। আশির দশকেই একবার গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ইয়েমেনে, ১৯৮৬ সালের এই গৃহযুদ্ধ চলে বারো দিন। একীভূত ইয়েমেনে প্রথম গৃহযুদ্ধ হয়ে ১৯৯৪ সালে, প্রাণ হারায় প্রায় দশ হাজারের মতো মানুষ। এরপরের দুই দশকে বেশ কয়েকবার সংঘাত ছড়িয়েছে, প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। তবে সেই সংঘাতগুলো কখনোই গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়নি।
ইয়েমেনের সংকট আলোচনায় অতীতের গৃহযুদ্ধ আর সংঘাতগুলো নিয়ে আলোচনার কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক কাঠামোতে বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইয়েমেনের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি, পুনরাবৃতি ঘটেছে ইতিহাসের। ২০১৪ সাল থেকে নতুন করে আরেকটি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে ইয়েমেনে, গৃহযুদ্ধ চলছে বিগত সাত বছর ধরে। এরমধ্যে লাখো মানুষ নিহত হয়েছে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে, ইয়েমেন হয়ে গেছে এক ব্যর্থ সংগঠন। সময়ের সাথে ইয়েমেন সংকটে যুক্ত হয় আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশগুলো, যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবশালী দেশগুলো। এদের কেউই এখন পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান দিতে পারেনি, বন্ধ করতে পারেনি সাধারণ ইয়েমেনিদের দূর্ভোগ।
যে স্বপ্ন নিয়ে ইয়েমেনিরা আরব বসন্তের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়েছিল, রাজপথে নেমেছিল বিক্ষোভে, তার অনেকগুলোই এখন মরীচিকার মতো আবির্ভূত হয়েছে ইয়েমেনিদের কাছে। তবে, অর্ধ-শতাব্দী পরে হলেও, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো ইয়েমেনকে। গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর জন্য প্রতিনিয়ত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সাধারণ জনগণকে, নিতে হয় রাজনৈতিক ঝুঁকি।