গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং কর্নেলকে কেউ লেখে না

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ জীবনে একটাই বই লিখতে চেয়েছিলেন। একদিন সকালে বাজারে যাওয়ার সময় তার মনে হলো, তিনি প্রস্তুত। সাথে সাথে বাজারে না গিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। লিখতে বসে যান। লেখেন কালজয়ী সেই উপন্যাস, সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ! নিঃসঙ্গতার একশ বছর! এখন লাতিন আমেরিকা ও তার সাথে জাদুবাস্তবতার কোনো উদাহরণ চাইলে মানুষ এই উপন্যাসের কথা বলে। এই অঞ্চলের মানুষ অদ্ভুত। সবসময় মনে হয় ঘোরের মধ্যে চলে। নেটফ্লিক্সের কার্টেল শো নার্কোসের মাধ্যমে আমরা দেখেছি সব। এছাড়া, এ এলাকায় বামধারার রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব অনস্বীকার্য। বিপ্লবীরা বেশ সক্রিয়। যুদ্ধ ও দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগেই আছে। আছে দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগণ। সাথে সাগর, ঝড়, বন, জঙ্গল, নদী ও প্রকৃতির এক অদ্ভুত মিশেল। সাথে মানুষের একাকিত্ব, অপেক্ষা ও মেলানকোলির গভীর সত্য অনুভূতি। এই বিশাল ক্যানভাসে মার্কেজ সৃষ্টি করেছেন নিঃসঙ্গতার একশ বছর

Gabriel Garcia
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

মার্কেজ একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতাকে তিনি সাহিত্য হিসেবে মনে করতেন। আইন পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতা থেকে সাহিত্য। সাংবাদিকতা সাহিত্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকতার মাধ্যমেই সাহিত্যে প্রবেশ মার্কেজের। এ নিয়ে প্রশ্ন নেই। মার্কেজের প্রথম বড় ধরনের সাহিত্যকর্ম হচ্ছে দ্য স্টোরি অব এ শিপরেক্‌ড সেইলর‘; বাংলায় বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প’ বইটি অনেকটাই সংবাদের ঢঙে লেখা। কলম্বিয়ার নৌ বাহিনীর জালিয়াতির ফলে ডুবে যায় নৌজাহাজ। কোনোমতে টিকে থাকে একজন। ভয়ানক উত্তাল সাগরে ভীষণ প্রতিকূলতায় তার বেঁচে থাকা নিয়েই এই গল্প। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা উপন্যাস। এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে বিদেশে পেশা খুঁজতে হয় মার্কেজকে। কেননা, নৌজাহাজ ডুবে যাওয়ার সরকারি ব্যাখ্যা মিলছিলো না মার্কেজের বর্ণনার সাথে। ফলাফল- সরকারের চক্ষুশূল এবং বিদেশি পত্রিকায় যোগদান। উপন্যাসটিও প্রকাশিত হয় অনেক পরে, ১৯৭০ সালে। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- ঠিক এই বইই কেবল অ-মার্কেজীয়, অর্থাৎ আমরা যেসব কারণে মার্কেজকে চিনি– অপেক্ষা, মেলানকোলি; এসব এই বইয়ে নেই। বরং সারভাইভাল নভেলের এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ হিসেবে একে উল্লেখ করা যেতে পারে।

The story of a shipwreck sailor
Image source: Wikimedia Commons

মার্কেজকে বলা হয় জাদুবাস্তবতার জাদুকর। কেন? এই জাদুবাস্তবতা কী? সহজ ভাষায় বলতে গেলে- জাদুবাস্তবতা মানে হচ্ছে বাস্তবতার সাথে এমন সব জাদুকরী উপাদান যোগ করা যাতে বাস্তবতাই এক ‘বিশেষ’ রকমের বাস্তবতা হয়ে ওঠে। একটানা দুই বছরের উপর বৃষ্টি, শূকরের লেজযুক্ত মানবশিশু- এসব অদ্ভুত ও অবাস্তব মনে হতে পারে আপাতদৃষ্টিতে। কিন্তু নিঃসঙ্গতার একশ বছর উপন্যাসে মাকান্দো গ্রামের যে ছবি এঁকেছেন মার্কেজ, এসব উপাদান বরং বাস্তবকে করেছে আরো বাস্তব। প্রায় সব উপন্যাসেই এই টেকনিককে মার্কেজ গ্রহণ করেছেন অতি সাধারণ, সহজ ও স্বাভাবিকভাবে।

Cien Anos De Soledad
নিঃসঙ্গতার একশ বছর; Image Source: Amazon

মার্কেজের বইয়ে কয়েকটা বিষয় ঘুরে-ফিরে এসেছে– অপেক্ষা, মেলানকোলি, যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বিপর্যয়। প্রতিটি বইয়ে আছে কলম্বিয়া তথা লাতিন আমেরিকার ভারি ও পাগলাটে জীবনযাপন। একটা নাম প্রায়ই আসে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। চরিত্রটি সম্ভবত লেখকের নানা বলে আমরা ধারণা করি।

লেখকের সবচেয়ে ছোট উপন্যাস কর্নেলকে কেউ লেখে না বা এল কোরোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এস্ক্রিবা। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ। কলম্বিয়া থেকে অনেক দূরে ফ্রান্সের প্যারিসে এক হোটেলে ১৯৫৭ সালে তিনি রচনা করেন ছোট এই নভেলা, নিঃসঙ্গতার একশ বছর লেখার প্রায় দশ বছর আগে! এই উপন্যাসে মার্কেজীয় জাদু নেই, আছে নিখাঁদ সামাজিক বাস্তবতা। কিন্তু তা-ও, এই উপন্যাসের মাধ্যমেই সম্ভবত সাংবাদিক মার্কেজ থেকে লেখক মার্কেজের উত্তরণ। জাদুবাস্তবতা না থাকলেও অন্য সব, যেমন- অপেক্ষা, যুদ্ধের বিপর্যয়, মেলানকোলি, ঘোর লাগা লাতিন সমাজ ও প্রকৃতি সবই আছে।

অনেক অপেক্ষা করে যে তার কাছে যেকোনো অপেক্ষাই অপেক্ষা।

জীবনের ৫৬ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন বৃদ্ধ। সর্বশেষ যুদ্ধের পর চুক্তি হয় বিপ্লবীদের সাথে। চুক্তিমতে পেনশন পাবেন বৃদ্ধ, যিনি ছিলেন বিপ্লবী। দীর্ঘ ক্লান্তিকর, ক্ষুধার্ত, হতাশাজনক এক জীবন যাপন করছেন বৃদ্ধ। স্ত্রীর হাঁপানির অসুখ। দিনগুলো হয় বিষণ্ন। রাতগুলো দীর্ঘ। কোনো অন্ন নেই, অর্থ নেই। একমাত্র ছেলেও মারা যায় কিছুদিন আগে। আছে কেবল একটা লড়াইয়ের মোরগ। অসুস্থ স্ত্রী তাড়া দেন মোরগটা বিক্রি করে কিছু পয়সা জোগাড়ের। গোঁয়ার বৃদ্ধ মোরগ বিক্রি করবে না। শীতের শেষে মোরগলড়াই হবে, মোরগটা জিতে যাবে, বাজির বিশ শতাংশ পাবে, এই আশায় আছে বৃদ্ধ।

Image Courtesy: Wikimedia Commons

 

প্রতি শুক্রবার শহরের নদীঘাটে এসে অপেক্ষা করেন বৃদ্ধ। নৌকায় আসে ডাক। পোস্ট অফিসে আশা নিয়ে যান, কিন্তু প্রতিবারই পোস্ট মাস্টার তাকে জানিয়ে দেন, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না! ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিপর্যস্ত স্ত্রী বলেন, “লড়াইয়ের বাকি পঁয়তাল্লিশ দিন, ততদিন কী খাব আমরা?” দীর্ঘজীবনের শক্তি সঞ্চয় করে বিশুদ্ধ, দ্ব্যর্থহীন, অপরাজেয় কণ্ঠে কর্নেল উত্তর দেন, “শিট!

গৃহযুদ্ধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভেঙে পড়া এক জনপদ। প্রকৃতি, আবহাওয়া ও সমাজের ঘোরলাগা এক ছবি। ক্ষুধা ও দারিদ্র‍্যক্লিষ্ট জনগণ। সবকিছুর কেন্দ্রে এক বৃদ্ধ যিনি ধারণ করেন প্রাচীন যুদ্ধের ইতিহাস। একইসাথে তিনি ধ্বংসপ্রায় অথচ আত্মমর্যাদায় বলিয়ান। অপেক্ষায় আছেন, সুদিন আসবে। এটাই কি যুদ্ধে বিপর্যস্ত কিন্তু আশায় চেয়ে থাকা লাতিন জনপদ নয়?

মার্কেজের সব লেখার ‘প্রায়’ সারমর্ম বলা যেতে পারে উপন্যাসটিকে। আরো কিছু কারণে উপন্যাসটি বিশেষ। এটি ছোট, একশ পৃষ্ঠারও কম। লেখা খুব আঁটসাঁট; জমাটবাধা। কোথাও কোনো অতিরিক্ত বর্ণনা নেই। গভীরতা আছে বেশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সহিংসতা নভেলার মূল বিষয়, অথচ কোথাও কোনো সশস্ত্র লড়াইয়ের বর্ণনা নেই! নেই রক্তারক্তি, খুনোখুনি, মারামারি, হানাহানি। যুদ্ধের সব উপকরণ ছাড়াই মার্কেজ লিখেছেন যুদ্ধ নিয়ে এক উপন্যাস। মূলত, কলম্বিয়ার ইতিহাসে দুটো বড় সহিংসতার সময় ছিল ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ এর গৃহযুদ্ধ, এবং ১৯৫০ এর সহিংসতা। এই দুই রক্তাক্ত সময় নিয়ে অনেক লাতিন ঔপন্যাসিকই উপন্যাস লিখেছেন, যেগুলো রক্তারক্তি ও সহিংসতায় ভরপুর। কেবল মার্কেজ ভিন্ন এক প্রচেষ্টা চালান। তিনি হত্যাকাণ্ডের প্রামাণ্য বর্ণনার চেয়ে বরং বেঁচে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা ও আতঙ্কজনক প্রভাব লিখতে চেয়েছেন। কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না এক্ষেত্রে শুধু সফলই নয়, বরং ক্লাসিকের মর্যাদা রাখে।

This Bangla article discusses about different books of Gabriel Garcia Marquez, especially 'No One Writes to the Colonel'.

Related Articles

Exit mobile version