“আমার সবসময় মনে হয় আমি যেন কিছু খুঁজে চলেছি, কাউকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু কী খুঁজছি? কোনো জায়গা? কোনো মানুষ? নাকি কেবলই একটা চাকরি?”
ছোট শহর ইতোমোরিতে বাস করা কিশোরী মিতসুহা তার জীবন নিয়ে হতাশ। ছোট একটি শহরে একজন সাধারণ মেয়ের জীবন তাকে ক্লান্ত করে তোলে, মনে প্রাণে সে চায় পরেরবার সে যেন টোকিও শহরে এক সুদর্শন ছেলে হয়ে জন্ম নেয়! এক সকালে ঘুম ভেঙে মিতসুহা নিজেকে আবিষ্কার করে সুদর্শন টোকিওবাসী ছেলেরূপে। পরদিন ঘুম ভেঙে নিজেকে আগের অবস্থাতেই ফিরে পেয়ে তার ধারণা হয় সে হয়তো স্বপ্ন দেখছিল। তাই যদি হবে, তাহলে স্কুলে সবাই এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন ওর সাথে? কেন তার ডায়েরিতে অচেনা হস্তাক্ষরে লেখা “তুমি কে?’ কেন তার মনে হচ্ছে সে অন্য কারো জীবন যাপন করেছিল?
আপাতদৃষ্টিতে মাকোতো শিনকাই নির্মিত কিমি নো নাওয়া/ইয়োর নেম অ্যানিমে মুভির এই দেহ অদলবদলের কাহিনী খুব সরল মনে হলেও এর মাঝে রয়েছে অনেক নতুন মাত্রা। টোকিও শহরে বসবাসকারী তাকি আর গ্রামের মেয়ে মিতসুহা কীভাবে নিজেদের মানিয়ে নেয় পরস্পরের জীবনের সাথে, কীভাবে নোটবইতে, সেলফোনে একজন আরেকজনের জন্য রেখে যায় বার্তা, আর কীভাবেই বা দেখা না করেই প্রেমে পড়ে যায় একজন আরেকজনের। হুট করেই বন্ধ হয়ে যায় তাকি আর মিতসুহার এই অদ্ভুত যোগাযোগ।
মিতসুহাকে খুঁজতে ইতোমোরি গিয়ে তাকি কেন খুঁজে পায় না মিতসুহাকে? কেনই বা তাকির নোটবই আর সেলফোন থেকে উধাও হয়ে গেছে মিতসুহার অস্তিত্বের চিহ্নগুলো? কেন তাকি কিছুতেই মনে করতে পারছে না মেয়েটির নাম, যার সাথে তার আত্মার অদলবদল হয়েছে দিনের পর দিন? তাকি কি খুঁজে বের করবে, নাকি ভুলে যাবে মিতসুহাকে? মিতসুহা কি চিরতরে হারিয়ে যাবে তাকির জীবন থেকে?
সাধারণ কাহিনীর মতো মুভিটির চরিত্রগুলোও খুব সাধারণ। ছোট শহরে বাস করা মিতসুহা বড় হয় তার ঐতিহ্যবাহী পরিবারের প্রাচুর্যের মধ্যে। পুরো শহরের সবার তার প্রতি আগ্রহ তার ভালো লাগতো না, সে চাইত টোকিও শহরে গিয়ে জীবন নিজের মতো গুছিয়ে নিতে। অপরদিকে তাকি টোকিও শহরে বাস করা তরুণ, যে স্কুলের পরে পার্টটাইম চাকরি, আবার হোমওয়ার্ক সব কিছু নিয়ে হিমশিম খায়। মিষ্টি স্বভাবের দয়ালু মিতসুহা যেমন দর্শকদের মনে জায়গা করে নেবে, চঞ্চল তাকির দুষ্টুমি তেমনিভাবে দর্শকের মুখে হাসি ফোটাতে বাধ্য।
মুভিটি শুরু হয় এক উল্কাপাতের দৃশ্য দিয়ে। নক্ষত্রঝরা সেই রাতের আকাশ মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা সৃষ্টি করে। মুভির আর্ট দর্শকের চোখ আর্দ্র করার জন্য যথেষ্ট। চমৎকার সব রঙ এবং উপযুক্ত অ্যানিমেশনের ব্যবহার দর্শকের নজর ঠিক যেদিকে যাওয়া প্রয়োজন সেদিকে নিয়ে যাবে, আবার আশেপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব ডিটেইলিংকে উপেক্ষা করতে দেবে না। বরং প্রতিতা ঝরে যাওয়া পাতা, খসে পড়া তারা, গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু তার আশেপাশের বাকি সবকিছুর সাথে সমন্বিত হয়ে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের অবতারণা করে।
সৌন্দর্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে এটি নিঃসন্দেহে সেরা অ্যানিমেগুলোর একটি। প্রতিটি দৃশ্যই ওয়ালপেপার হিসেবে ব্যবহার করার মতো নান্দনিক। সূক্ষ্ম সব ডিটেইলিং সিনেমাটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাতাসে উড়তে থাকা মিতসুহার চুল কিংবা তাকির অগোছালো বেডরুম সবকিছুই অত্যন্ত যত্নের সাথে আঁকা। সাধারণ থেকে সাধারণতর দৃশ্যগুলোও প্রায় নিখুঁত করে তুলে ধরা হয়েছে।
সিনেমার কন্ঠ অভিনেতারা বেশ দক্ষ ছিলেন, যার ফলে প্রতিটা চরিত্রের আবেগ দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। মিতসুহার মিষ্টি কন্ঠ বা দাদীর দৃঢ় স্বর, প্রতিটি চরিত্র কার্যকরভাবে উঠে এসেছে। প্রতিটি দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চমৎকারভাবে সমন্বিত ছিল। সুললিত পিয়ানোর ব্যবহার দৃশ্যগুলোতে অন্যরকম স্বস্তি এনে দিচ্ছিল।
জাপানী রক ব্যান্ড রডউইম্পসের প্রধান গায়ক ইয়োজিরো নোদা অ্যানিমেটির থিম সঙ্গীত রচনা করেছেন। রক সঙ্গীত তারূণ্যকে প্রকাশ করে। মূলচরিত্র তাকি ও মিতসুহার কিশোরসুলভ আবেগ, যুক্তি না মেনে যা কর্তব্য মনে হয় তা-ই করতে মরিয়া হয়ে ওঠা, তাদের সরলতা আর মিথষ্ক্রিয়া গানগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সিনেমাটিতে রডউইম্পসের গাওয়া চারটি চমৎকার গান রয়েছে। গানগুলো হলো ইয়ুমেতোরো (Dream Lantern), যেনযেনযেনসে (Past past past life), স্পার্কল এবং নান্দেমোনাইয়া (It’s nothing)। সুরেলা গানগুলো বার বার শোনার সাধ জাগবে।
৩ জুলাই, ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত অ্যানিমে এক্সপোতে সিনেমাটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর ২৬ আগস্ট জাপানের থিয়েটারগুলোতে সিনেমাটি মুক্তি দেয়া হয়। সিনেমাটি অত্যন্ত ব্যবসাসফল হয়। শুধুমাত্র জাপানেই আয় করে ২৩ বিলিয়ন ইয়েন (১৯০ মিলিয়ন ইউএস ডলার)। এটি জাপানের সেরা ব্যবসাসফল সিনেমাগুলোর মাঝে দ্বিতীয়। জাপানের বাইরে চীন, থাইল্যান্ড সহ আরো অনেক দেশে সিনেমাটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘কিমি নো নাওয়া’ সমালোচকদের কাছেও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। পর্যালোচনা সংগ্রাহক ওয়েবসাইট ‘রটেন টোম্যাটো’তে সিনেমাটি ১০১টি রিভিউ এর উপর ভিত্তি করে ৯৭% অনুমোদন পেয়েছে, গড় রেটিং ৮.২/১০। মেটাক্রিটিকে চলচ্চিত্রটির ১০০টি রিভিউয়ের মধ্যে ৭৯টি অনুমোদিত।
মুক্তি পাওয়ার পর থেকে চলচ্চিত্রটি জিতে নিয়েছে অনেক পুরস্কার, আর মনোনয়ন পেয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি। ২০১৬ সালে সিটগেস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র হিসেবে পুরষ্কৃত হয় ‘কিমি নো নাওয়া’। একই বছর ২৯তম টোকিও ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি তৈরি করার জন্য মাকাতো শিনকাই গ্রহণ করেন আরিগাতো বা ধন্যবাদ পুরষ্কার। ষষ্ঠ নিউটাইপ অ্যানিমেশন অ্যাওয়ার্ডসে সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়, সেরা সাউন্ডট্র্যাক আর সেরা আবহ সঙ্গীতে হয় রানার আপ। ওই বছর লস এঞ্জেলসে ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ডসেও সেরা চলচ্চিত্রের পুরষ্কার বাগিয়ে নেয় ‘কিমি নো নাওয়া’। এছাড়াও ২০১৭ সালের ৪০তম জাপান অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে এক্সিলেন্ট অ্যানিমেশন অফ দ্য ইয়ার, ড্রেক্টর অফ দ্য ইয়ার, সেরা স্ক্রিনপ্লে আর সেরা সাউন্ডট্র্যাক ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার জিতে নেয়। একই বছর ৩৬তম অ্যানিমে ফেস্টিভ্যালে দর্শকদের পছন্দে সেরা পুরষ্কার আর ১১তম সেইয়ু অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী আর সাইনার্জি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় সিনেমাটি।
মিতসুহা আর তাকির গল্প এর নিজস্ব সরল সৌন্দর্যে দর্শকের মর্মস্পর্শ করে। কেউ কাউকে কোনোদিন না দেখে প্রেমে পড়ে যাওয়ার ভেতর যে নিষ্পাপ সারল্য আছে, তা মুগ্ধ করার মতো বৈকি! রেললাইনে ট্রেনের সমান্তরালে চলে যাওয়ার রূপক দিয়ে শিনকাই যে গভীর জীবনবোধের অবতারণা করেছেন, তা প্রাসঙ্গিক বটে। অনেক সময় নিজের পথে চলতে থাকা দুটি ট্রেনের দেখা হয়ে যায়, কখনোবা দেখা হয় না। তবে দেখা হওয়া না হওয়া ট্রেনের স্বাভাবিক গতিকে আটকে রাখে না, জীবন চলে জীবনের নিয়মে। পুরো সময়জুড়ে দর্শকদের মনে প্রশ্ন থেকে যাবে, দেখা কি হবে দুজনের? দেখা হলে কি তারা চিনতে পারবে একে অপরকে?
“তুমি কে? কেন আমি এখানে এসেছি? আমি তাকে দেখতে এসেছি, তাকে বাঁচাতে এসেছি। আমি তাকে জীবিত দেখতে চাই! কিন্তু সে কে? কে? কাকে দেখতে আমি এখানে এসেছি? আমার খুব কাছের কেউ। আমি ভুলতে চাই না! আমি ভুলতে পারি না! কিন্তু… কে? কে? কে? কে? তোমার নাম কী?”
সময় বেণী করা সুতোর মতো, পাশাপাশি বয়ে চলে চমৎকার সব বুনটে, পাক খেয়ে যায়, জট লেগে যায়, আবার জট খুলেও যায়। মহাজগতের সবকিছুর সাথে মিশে আছে সময়। আর সময়ের সুতোর বুনটে গাঁথা আমাদের জীবন। জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়ার জন্য তাকি আর মিতসুহার দুই পথে চলা দুই জীবনের সুতোয় জট লেগে গেল, বদলে গেলো দুজনেরই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। কীভাবে? বুঝতে হলে দেখতে হবে চমৎকার এই চলচ্চিত্রটি।
Featured Image: scmp.com