ব্যাংক ডাকাতি বা চুরি নিয়ে তো অনেক ছবিই দেখেছেন, হলিউডের ওশান্স সিরিজ তো বিখ্যাত। বহুদিন ধরে ওশান্স এর সাথে পাল্লা দেবার মতো কিছুর দেখা মিলছিল না, এবার বুঝি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়াই গেল। কথা হচ্ছে নেটফ্লিক্সের ‘লা কাসা দে পাপেল’ (La casa de papel) বা ‘মানি হাইস্ট’ (Money Heist) সিরিজটি নিয়ে। দুর্দান্ত এক ব্যাংক ডাকাতির গল্প শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার সাথে পর্ব পর্ব করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, চলুন আজ সে গল্প নিয়েই গল্প হোক।
নায়ক আমাদের এক প্রফেসর, অন্তত নিজেকে প্রফেসর ডাকেন আর কী। নায়ক বলা উচিত না খলনায়ক- সেটা বিতর্কের বিষয়, হাজার হোক, অন্যায়ভাবে টাকা চুরি তো করছেন। ব্যাপারটা ঠিক যেন পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের মতো, যতই জানি যে জ্যাক স্প্যারো এক জলদস্যু, তবুও তার প্রতি দরদ আর ভালোলাগা মিশ্রিত সমর্থন কিন্তু একবিন্দু কমে না।
তো বলছিলাম প্রফেসরের কথা। তার মহাপরিকল্পনা হলো, তিনি স্পেনের রয়্যাল মিন্ট থেকে টাকা চুরি করবেন। যেন তেন অংক না, একে বারে ২.৪ বিলিয়ন ইউরো সরিয়ে দেবেন! কিন্তু একে চুরি ডাকতে তিনি নারাজ। কেন? কারণ, তিনি আসলে চুরি করবেন না। টাকা ছাপাবেন। আর সে টাকা ছাপিয়ে পালিয়ে যাবেন দল নিয়ে। তার এ ‘ডাকাতি’র দলে আট জন, যার প্রত্যেকের আছে গভীর অতীত, আর বিশেষ বিশেষ দক্ষতা। একবার রয়্যাল মিন্টে ঢুকতে পারলে সময় লাগবে ১১ দিন। সে ১১ দিন তারা ৬৭ জন হোস্টেজকে বন্দী করে রাখবে, আর বাহিরে তো পুলিশি কড়া পাহাড়া থাকবেই। পালাবার জন্যও লাগবে দুর্দান্ত এক উপায়। কী হবে সেটা?
রয়্যাল মিন্টের কথায় আসা যাক। স্প্যানিশে যাকে ডাকা হয় ‘Fábrica Nacional de Moneda y Timbre – Real Casa de la Moneda’। এটি স্পেনের জাতীয় টাকশাল, হেডকোয়ার্টার মাদ্রিদে। অর্থাৎ এখানেই টাকা ছাপানো হয়। স্প্যানিশ অর্থ মন্ত্রণালয় এর দেখভাল করে থাকে। ১৯৪০ সাল থেকে ব্যাংক অফ স্পেন টাকা ছাপানো শুরু করে আর আজকের দালানটি ১৯৬৪ সালে ব্যবহার শুরু হয়। আরেকটি টাকশাল আছে উত্তর স্পেনের বুর্গোসে। উল্লেখ্য, সিরিজের নাম ‘লা কাসা দে পাপেল’ অর্থই হলো ‘কাগজের ঘর’ যেখানে কাগজ বলতে আসলে ব্যাংকনোট বোঝানো হচ্ছে, মোদ্দা কথা- টাকশাল।
প্রফেসরের আসল নাম সের্গিও মার্কিনা। আল্ভারো মর্তে অসাধারণ অভিনয় করেছেন এ চরিত্রে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধারী, প্রত্যুৎপন্নমতি আর সুদূরপ্রসারী- এ তিনখানা গুণই তার মাঝে আছে সমান তালে। বহু মাস ধরে তার এ পরিকল্পনা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তর পর্যন্ত নির্ভুলভাবে করা, তার দলের সদস্যদেরও সেভাবে তিনি শিখিয়ে পড়িয়ে দেন। তার অতীত রহস্যময়।
টম অ্যান্ড জেরির মতোই ডাকাত থাকলে পুলিশও থাকবে, পুলিশ তাড়া করে বেড়াবে দোষীকে। আর এখানে পুলিশের ভূমিকায় আছেন ইন্সপেক্টর রাকেল মুরিলো। মাঝবয়সী সুন্দরী এ মহিলার আছে এক সন্তান, কিন্তু স্বামীর সাথে তার চলছে ছাড়াছাড়ি। একদিকে ঝামেলাময় পারিবারিক জীবন, অন্যদিকে ব্যাংক ডাকাতির লাইভ কেস, দুদিক থেকে তাকে বুঝি ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এর মাঝে হঠাৎ করে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা মেলে এক প্রিন্স চার্মিং এর, প্রেমেও পড়ে যান তিনি। কিন্তু তিনি কি আর জানতেন এই ব্যক্তিই যে আসলে যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি? এই সেই প্রফেসর? ইঁদুর বিড়ালের খেলা চলবে কতক্ষণ?
এরপর আসা যাক দলের সদস্যদের ব্যাপারে। প্রথমে টোকিও। ভাবছেন শহরের নামে কেন নাম? দলের কোনো সদস্যই যেন অন্যের অতীত জানতে না পারে- এরকম নিয়ম করে দিয়েছিলেন প্রফেসর। আর সেই সাথে কড়া নিষেধ, কেউ কাউকে আসল নাম বলতেই পারবে না। এর বদলে সবাই একেকজন একেক শহরের নামে নিজেদের নাম বানিয়ে নেবে। সেই থেকে এলো টোকিও। মধ্যবয়সী তেজস্বী এক নারী, আমাদের গল্পের আরেক নায়িকা। যে কিনা আবার প্রেমে পড়ে গিয়েছে রিও নামের এক তরুণ সদস্যের, বয়সে যে কিনা অনেক ছোট তার চেয়ে। এ অসম প্রেম যে টিকবে না ডাকাতির পর সেটা দুজনেই জানে। কিন্তু আদিমতায় মত্ত দুজন বর্তমানের আনন্দে বিভোর হয়ে ভুলে থাকতে চায় ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
রিওর বাবা চায় তাকে আগলে রাখতে, কিন্তু সব সময় কি আর পারে? এছাড়াও দলের শক্তিশালী সদস্য হলো গোপন মরণ রোগে ভোগা বার্লিন, প্রফেসরের অনুপস্থিতিতে টাকশালের ভেতরে যে কিনা দলের নেতা। কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকে, কখনো কখনো দলের অন্য সদস্যরা মেনেই নিতে পারে না সেগুলো।
এরপর আছে জমজ বিশালাকার ভাই হেলসিংকি আর অসলো। একজন কথা কম বলে, আর আরেকজন করে বেড়ায় ভয়ংকর সব কৌতুক। দেখতে কড়া হলেও মন তাদের পরিষ্কার। আছে নায়রোবি নামের আরেক উদ্যমী মেয়ে, অনবরত টাকা ছাপানোর কাজে ওস্তাদ। মস্কো, ডেনভার- এদের ছাড়া দলটা যেন ফাঁকাই লাগত।
ওদিকে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। ৬৭ জন জিম্মির কথা তো আগেই বলা হয়েছে, কেমন হবে যদি এর মাঝে একজন প্রেমে পড়ে যায় এক ডাকাত সদস্যেরই? মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় স্টকহোম সিন্ড্রোম (Stockholm Syndrome), যেখানে জিম্মি তার জিম্মিকারীরই প্রেমে পড়ে যায়, অন্তত তৈরি হয় তার প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা কিংবা আস্থা। জিম্মিদেরই একজন যদি কাজ করা শুরু করে ‘ডাকাত’দের হয়ে, তাহলে তো বড় বিপদ। আর বিশেষ করে জিম্মিদের মাঝে যখন আছে সে দেশের এক রাষ্ট্রদূতের মেয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ!
সিরিজটি দেখতে দেখতে আপনি নিজেই যে কখন চাইতে থাকবেন টাকা চুরি হোক, টাকা চুরি হোক- টেরই পাবেন না। সিরিজটি নির্মাণের সার্থকতাটা এখানেই। সকলেই অভিনয় করেছেন যেন নিজেদের পুরোটা দিয়ে।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা সাউন্ডট্র্যাকের কথায় আসা যাক। একটি উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনীর জন্য ঠিক যখন যেমনটা হলে একদম শতভাগ নিখুঁত হবে, ঠিক ততটুকুই করা হয়েছে, একবিন্দু কমও যেন নয়। কখনো কখনো লোম খাড়া করা আবহসংগীত আপনাকে নিয়ে যাবে রয়্যাল মিন্টেই। আর হ্যাঁ, ইন্ট্রোর থিম মিউজিকের কথা না বললেই নয়। My Life Is Going On শিরোনামে সিসিলিয়া ক্রালের গাওয়া গানটি আপনাকে এতই মুগ্ধ করবে যে প্রতিবার না শুনে পারবেনই না। এই সেই গানটি-
শুরুতেই কিন্তু এ সিরিজটির স্থান নেটফ্লিক্সে ছিল না। স্প্যানিশ এ টিভি সিরিজটি অ্যালেক্স পিনা বানিয়েছিলেন অ্যান্টেনা থ্রি এর জন্য। এক সিজনেই বানানো সিরিজটিতে ছিল ১৫টি পর্ব, তবে মুক্তি দেয়া হয় দুই অংশে। ক্রাইম ড্রামা থ্রিলার জনরার সিরিজটির প্রথম অংশে নয়টি আর দ্বিতীয় অংশে ছিল ছয়টি পর্ব। ২০১৭ সালের ২ মে প্রিমিয়ার হয় সিরিজটির। প্রথম অংশ নেটফ্লিক্সে প্রিমিয়ার হয় ২০১৭ সালের ক্রিসমাসের দিন। তবে নয়টি এপিসোডকে এডিট করে নেটফ্লিক্স পরিণত করে তেরটি এপিসোডে। এরপর ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে দ্বিতীয় অংশ মুক্তি পায়, ছয়টি পর্বকে করা হয় নয়টি পর্ব। আর সেই সাথে ১৮ এপ্রিল ঘোষণা দেয়া হয় যে, ২০১৯ সালেই আসছে তৃতীয় সিজন, আর এটা হবে সম্পূর্ণই নেটফ্লিক্সের। সবচেয়ে বড় ডাকাতি এখনো শেষ হয়নি। নেটফ্লিক্স অবশ্য সিরিজটির নাম স্প্যানিশ না রেখে ‘মানি হাইস্ট‘ রেখেছে, যার মানে ‘অর্থ ডাকাতি’।
গুজবাম্প দেয়ার মতো একটা দৃশ্য ভক্তরা পছন্দ করে থাকবেন যেটি কিনা ‘বেলা চাও‘ (Bella ciao) গানটি গাওয়া। প্রফেসর আর বার্লিনের কণ্ঠে এ বিপ্লবী গানটা কিন্তু ঐতিহাসিক! ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের ইতালীয় গৃহযুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার এক অ্যান্টি-ফ্যাসিবাদী বিপ্লবী গান ‘বেলা চাও’। কিন্তু রহস্য হলো, বার্লিন আর প্রফেসরের সম্পর্ক আসলে কী?
বলা বাহুল্য, সিরিজে রয়্যাল মিন্ট বলতে যা আমরা দেখি সেটা আসল রয়্যাল মিন্ট বা টাকশাল নয়। সেখানে শুটিং করতে অনুমতি প্রার্থনা করা হয়েছিল, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যায়নি। তাই শুটিং করা হয় Spanish National Research Council-এ।
সিরিজটি আইএমডিবি-তে ৮.৮/১০ রেটিং পাওয়া সিরিজটি দেখেছেন কি? না দেখে থাকলে, নেটফ্লিক্সেই দেখতে ক্লিক করুন এখানে। সাল্ভাদর দালি মুখোশ পড়া ডাকাতদের ভালোবেসে ফেলতে এখুনি বসে পড়ুন বিঞ্জওয়াচে।
ফিচার ইমেজ: InfoGlitz