“If you must blink, do it now.“
সিনেমার শুরুতে এমন একটি নির্দেশনা পেলে একটু নড়েচড়ে তো বসতেই হয়, তাই নয় কি? এমন একটি লাইন দিয়ে সিনেমা শুরু করতে হলে যথেষ্ট সাহসী ও বেপরোয়া হওয়া লাগে। এই বেপরোয়া কাজটিই করে দেখিয়েছেন ট্রেভিস নাইট। তার নির্মিত ‘Kubo and the Two Strings’ শীর্ষক স্টপ মোশন ফিল্মে।
অবশ্য সবাই আগে থেকেই খানিকটা অনুমান করেছিল, ঝকমকে সিনেমার আড্ডায় নাইট এমন ভিন্ন কিছুই নিয়ে আসবেন, যা সাড়া ফেলে দেবে চারদিকে। এর আগে তার ‘লাইকা এন্টারটেইনমেন্ট’ বিশ্বকে উপহার দিয়েছে কোরালাইন (Coraline) , প্যারানরম্যান (Paranorman), দ্য বক্সট্রলস (The Boxtrolls) এর মতো অদ্ভুত সুন্দর কিছু সিনেমা, যার প্রতিটিতেই ছিল স্টপ মোশন জিনিয়াসদের জাদুর মায়া।
জাপানের নদীর ধারের একটি গ্রামের ছোট্ট এক ছেলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নেমে পড়ে এক কঠিন অভিযানে। একটি অ্যানিমেটেড সিনেমার জন্য এর চেয়ে ভাল গল্প আর কী হতে পারে? যারা প্রাচীন উপকথা পছন্দ করেন, তাদের জন্য এই সিনেমাটি ধোঁয়া ওঠা গরম এক প্লেট সিঙ্গাড়ার চেয়েও বেশি উপভোগ্য হবার কথা। সিনেমার নায়ক, ছোট্ট কুবো এমন এক অনুপ্রেরণার নাম, যে সবাইকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অনুধাবন করায় পুরো সিনেমার প্রতিটি সেকেন্ডে।
মার্ক হেইমস আর ক্রিস বাটলারের কাছ থেকে ধার করা গল্প নিয়ে নাইট যখন সিনেমাটি বানানো শুরু করেন, কেউ বোধহয় ভাবেননি যে, গোটাকতক রুপকথাসদৃশ ঘটনা আর ছোট একটি বাচ্চাকে নিয়ে নাইট কী করার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু ছেলেমানুষী এই গল্পকে নাইট রূপ দিয়ে ফেললেন অসাধারণ একটি চিত্রকল্পে।
সিনেমার শুরুর দৃশ্যে দেখা যায়, রুপার থালার মতো চাঁদের আলোর নিচে উত্তাল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে খেলনার মতো ভঙ্গুর একটি নৌকায় এগিয়ে চলেছেন এক নারী। সাগরের হিংস্র ঢেউ ক্রমেই গ্রাস করে নিতে চাইছে তাকে। হঠাৎ তিনি এক হাতে সুর তোলেন ‘শামিসেন’-এ। ব্যাঞ্জোর মতো দেখতে বাদ্যযন্ত্রটি থেকে ভেসে আসে এক বিষন্ন সুর। আর তখনই তার সামনে ঢেউগুলো এসে চূর্ণ হতে থাকে। তীরে পৌঁছাবার পর ক্লান্ত-ব্যথিত নারীর কাপড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ছোট একটি শিশু, যার একটি চোখ নেই। এক দমে সিনেমার এই পর্যায়ে এসে যেন একটু শ্বাস নেয়া যায়।
কুবো- সিনেমার প্রধান চরিত্র, যাতে কন্ঠ দিয়েছে বিখ্যাত সিরিজ গেম অফ থ্রোন্সের রিকন স্টার্কের ভূমিকায় অভিনয়কারী আর্ট পারকনসন। প্রগাঢ় কল্পনাশক্তির এই ছেলেটিই কাপড়ের পুঁটলির আড়ালে থাকা সেই ছোট শিশু। উত্তাল সাগরে ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় থাকে কুবো, সঙ্গে তার মা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া অবস্থায় প্রতিনিয়ত ভাসতে থাকে বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝামাঝি।
অসুস্থ মায়ের দেখভাল করার পাশাপাশি কুবোর নিত্যদিনের কাজ হলো দিনের বেলা অরিগ্যামির কাগজ ঝোলায় পুরে মায়ের শামিসেন হাতে নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামে ছুটে যাওয়া। শামিসেনের মায়াবী সুরে কুবো সেসব কাগজকে দিত নিজের ইচ্ছামতো রূপ। কখনও ফিনিক্স পাখি, কখনও শিকারা (নৌকা), আবার কখনো নিজের বাবা প্রয়াত সামুরাই হানজোর প্রতিকৃতি তৈরি করতো কাগজের ভাঁজে।
কপালের সামনে চৌকো করে কাটা চুলের আড়ালে থাকা অন্ধ চোখটির মতো কুবোকেও সন্ধ্যা নামার আগেই চলে যেতে হতো লোকচক্ষুর আড়ালে, পালিয়ে যেতে হতো পাহাড়ের চূড়ায়, মায়ের কাছে। কেননা এ ছিল মায়ের একমাত্র সাবধানবাণী। দুজন মিলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় মায়ের কোল ঘেঁষে বসতো কুবো, শুনতো তার ছোটবেলার কথা।
কী করে তার নানা, মুন কিং তার চোখ কেড়ে নিয়েছিল, জন্ম থেকেই নানার কাছ থেকে কী করে পালিয়ে বেড়ায় তার মা, কুবোকে বাঁচাতে কী করে তার সামুরাই বাবা প্রাণ দেয়- সবই বিভোর হয়ে কুবো শুনতো মায়ের কাছে। সন্ধ্যার পর আকাশে চাঁদ উঠলে কুবোর বাইরে বের হওয়া মানা। কারণ চাঁদ তাকে দেখে ফেললেই খবর পৌঁছে যাবে তার চাঁদের রাজা নানার কাছে। আর সে তখন কুবোকে খুঁজে বের করবে তার বাকি চোখটি কেড়ে নিতে। রাতে তার ঘুমানোর সঙ্গী ছিল কাঠের তৈরি বানরের একটি ছোট পুতুল, যাকে সে সবসময় সঙ্গে রাখতো।
কথায় বলে, যা ঘটার নয় ঠিক সেটিই মানুষের জীবনে ঘটে। কুবোও তার ব্যতিক্রম নয়। এক সন্ধ্যায় গ্রামের ‘ওবন’ উৎসব দেখতে গিয়ে দেরি হয়ে যায় কুবোর, আকাশের মস্ত চাঁদ দেখে ফেলে তাকে। খবর চলে যায় চাঁদের রাজার কাছে। কুবোর মা তখন ছেলেকে বাঁচাতে নিজের শেষ সঞ্চিত শক্তিটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন, আর নিজেই যান হারিয়ে। গল্পের শুরু আসলে এখানেই।
কুবো এন্ড দ্য টু স্ট্রিংস নিতান্ত একটি সাধারণ গল্প বলে মনে হয়। কিন্তু ট্রেভিস নাইট জাপানি লোকগাঁথা হিসেবে এই গল্পকে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে। মায়ের পরাজয়ের পর কুবোর অভিযান শুরু হয় নিজের অস্তিত্বের ইতিহাস খুঁজে বের করা, সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে। এই অভিযানে একটা সময়ে তার সঙ্গী হয় কথা বলা এক বানর আর মানুষের আকারের এক অতিকায় গুবরে পোকা।
এই তিনটি ভিন্ন প্রাণীর একসঙ্গে পথচলা শুরু হয়। কুবোর বাবা হানজোর তিনটি বিশেষ জিনিস খুঁজে পেতে হবে তাদের। একটি হলো অভেদ্য বর্ম, অনাক্রম্য শিরস্ত্রাণ এবং একটি বিধ্বংসী তলোয়ার। এই তিন জিনিসের সমন্বয়েই পরাজিত করা যাবে চাঁদের রাজাকে।
কিন্তু কুবোর আসল অভিযান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাহ্যিক এই অভিযাত্রার আড়ালে ছিল তার হৃদয়ের গভীর এক স্পৃহা, একটি পরিবার খুঁজে বেড়ানো। করুণ সুন্দর পরিণতি হয় কুবোর আত্মিক এই অভিযানের।
ঘোরলাগা এই সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এর গল্পের চাইতে গল্প বলার ভঙ্গিমা হাজার গুণে সুন্দর করে তুলেছে পুরো ব্যাপারটিকে। এখানে দর্শকের চাহিদা মেটাবার সবরকম উপাদানই রয়েছে। রোমাঞ্চ, রসায়ন, সংশয়, রহস্য, পৌরাণিক আবহ- মোট কথা, কোনো কিছুরই অভাব নেই। সমস্ত সিনেমা নিখুঁত আর মসৃণভাবে শেষ হয়েছে। ‘গন্তব্যের চাইতেও যাত্রাপথ বেশি গুরুত্বপূর্ণ’- এ কথাটির বাস্তব উদাহরণ কুবো এন্ড দ্য টু স্ট্রিংস। পুরো গল্পটির ঘন্টা দেড়েক সময় কুবো আর তার দুই সঙ্গীর সাথে কেটে যাবে চোখের পলকে। প্রথম উক্তিটির মতো বলতে গেলে, চোখের পলক ফেললেই মনে হয়, এই বুঝি কিছু একটা চোখ এড়িয়ে গেল!
সত্যিই, কোনো কিছুর কমতি নেই অ্যানিমেশন জগতে হৈ চৈ ফেলে দেওয়া এই সিনেমায়। কুবোর সঙ্গী অতিকায় গুবরে পোকা, যার নামই থাকে ‘বিটল’, তাকে দিয়ে কৌতূক আর হাস্যরসের দিকটি ভরাট করা গেছে খুব চমৎকারভাবে। অন্যদিকে কুবোর আরেক সঙ্গী সেই কথা বলা বানরকে (নাম মাঙ্কি!) দেখানো হয়েছে খুব গম্ভীর আর রাশভারী চরিত্র হিসেবে। কোথাও খুব বেশি গাম্ভীর্য নেই, আবার কোনো কৌতূকই গল্পের গভীরতাকে হালকা করে দেয় না। আর এই দুইয়ের ভারসাম্য ঠিক রাখতে ছোট্ট কুবো তো রয়েছেই।
চাঁদের রাজার সহচরী হিসেবে কুবোর মুখোমুখি হয় তার আপন দুই যমজ খালা। সিনেমার এই জায়গাটা দেখলে খানিকটা ভয় না লেগে পারা যায় না। সমস্ত সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে ধূসর একটি পটভূমিতে, প্রবল নীরবতার মাঝেও একটি সুরেলা নৈরাজ্য বিরাজমান। এরই মাঝে দুই যমজ বোনের অপার্থিব আগমনে গায়ে কাঁটা দেয়, শীতল একটা অবশ অনুভূতি হয় তাদের গলার স্বর শুনে, যা কোনো ভৌতিক সিনেমার চাইতে কম নয়।
সবচেয়ে বেশি বাহবা দিতে হয় সিনেমার কারিগরদের। লাইকা এন্টারটেইনমেন্ট বরাবরের মতো ভিজুয়াল ইফেক্টের জাদুতে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে দর্শকদের এই সিনেমায়। প্রধান অ্যানিমেটর হিসেবে কাজ করেছেন ডিরেক্টর ট্রেভিস নিজেই! কুবোর শামিসেনের বিষণ্ণ সুরে কাগুজে পাখির বাতাসে ভেসে বেড়ানো থেকে শুরু করে যমজ দুই বোনের কুয়াশায় ভর করে খিলখিলিয়ে হেসে সামনে এগোনো, সব ক’টি দৃশ্যই দৃষ্টি আটকে রাখে।
সবচেয়ে বেশি মোহময় লাগে, কুবোর শামিসেনের সুরে যখন হাজার হাজার গাছের পাতা জুড়ে গিয়ে তৈরি হয়ে যায় একটি জাহাজ। ভিজুয়াল ইফেক্টের নিখুঁত কারিশমা দেখতে হলে একটু পর পর বাতাসে কুবোর চুলের আলোড়ন লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, এর পেছনে অ্যানিমেটরদের কতখানি শ্রম দিতে হয়েছে।
তবে ‘কুবো এন্ড দ্য টু স্ট্রিংস’ এর একটি অন্যতম চালিকাশক্তি হলো এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। একাডেমি পুরষ্কার বিজয়ী ডারিও মারিয়ানেলি সুচারুরূপে সুরের বাঁধনে বশ করতে পেরেছেন সবাইকে। আপনার যদি সিনেমার কোনো দৃশ্য কোনো কারণে একঘেয়ে লাগে তাহলে মিউজিকের বদৌলতে সেই ঘাটতি পুষিয়ে যাবে।
যেখানে অপরূপ শ্রুতিময় সুরের দরকার সেখানে পরিমিত সুরেলা মিউজিক, আর দৃশ্যের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন কর্কশ বেসুরো ধ্বনি। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করবে আপনাকে রেজিনা স্পেক্টারের কণ্ঠে বিটলস ব্যান্ডের ‘While my guitar gently weeps’ গানটি, বিচিত্র একটি কাতরতায় হারিয়ে যাবেন এই গানের সাথে।
সিনেমাটি তৈরি করতে লাইকা স্টুডিও নিয়েছে ৫ বছরেরও বেশি সময়, আর কুবোর চরিত্রটি তৈরি করতে লেগেছে পাক্কা ১৯ মাস। কুবোকে প্রাণবন্ত ও স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলতে, অভেদ্য বর্মের উজ্জ্বলতা প্রভাকে দূর থেকেই চোখে ফোটাতে, এমনকি প্রতিটি ছায়ার চুল থেকে দাঁত পর্যন্ত স্পষ্ট করে তুলতে কী পরিমাণ কাজ করতে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সময়ে অসময়ে কুবোর শামিসেনের সুরের মিশ্রণ পূর্ণতা দিয়েছে সমস্ত দৃশ্যপটকে।
সিনেমার সমাপ্তিতে কী ঘটে সেটির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সমাপ্তি কীভাবে ঘটে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা একটি নীরব বিষণ্ণ ক্রন্দন চলতে থাকে গোটা সিনেমা জুড়ে। কুবোর মনের ভেতরের শূণ্যতা, আপনজনকে আঁকড়ে ধরার আকুলতা দর্শককে আক্রান্ত করে সহজেই। সাহসী সামুরাইয়ের করুণ প্রেমের গল্পের ভাঁজে ছোট্ট কুবো’র নির্ভীকতার গাথা লেখা হয়ে যায়। কুবো’র পরিবারের কাছে থাকতে পারার কাতরতা সবাইকে স্পর্শ করে, কিন্তু সে টেরই পায় না, পুরোটা যাত্রার সময়ে সে পরিবারের মাঝেই থাকে, যখন বুঝতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
IMDb তে ৭.৮ রেটিং পাওয়া এই সিনেমাটি বক্স অফিসে কুড়িয়ে নিয়েছে অনেক প্রশংসা। স্পেশাল ইফেক্টের কারিগরি, অদ্ভুত সুন্দর মিউজিক আর মসৃণ গল্প বলার ঢং- এই তিনের মিশেল সিনেমাকে করেছে আরও অভাবনীয়। প্রাচীন উপকথা যাদের পছন্দ, আর অ্যানিমেটেড মুভি পেলেই যারা লুফে নেন, এই সিনেমাটি অবশ্যই দেখার জন্য সুপারিশ থাকলো।
ফিচার ইমেজ: Laika Studio