হ্যাকস রিজ: যুদ্ধে কোনো গুলি না ছুঁড়েও ‘মেডেল অফ অনার’ পাওয়ার গল্প

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে আমেরিকান মিলিটারিতে যোগ দিতে চাচ্ছে একজন। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছে কাউকে গুলি করবে না, মানুষ হত্যা করবে না। কীভাবে সম্ভব? যুদ্ধ মানেই তো হানাহানি, গোলাগুলি। তাই যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে হলে শত্রুদের হত্যা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ডেসমন্ড ডস নামের এক শান্তিকামী তরুণ সৈনিক। একজন মানুষকেও হত্যা না করে, একটি গুলিও না ছুঁড়ে তিনি বীরত্বের জন্য পেয়েছিলেন “মেডেল অফ অনার”। কীভাবে? সেই কাহিনি নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে “হ্যাকস রিজ” সিনেমাটি।

হ্যাকস রিজ সিনেমার একটি পোস্টার;

কাহিনি

ছোটবেলায় মারামারি করার একপর্যায়ে ইট দিয়ে ডেসমন্ড ডস নিজের ছোটভাই হ্যারল্ড ডসের মাথায় আঘাত করে ফেলে। হ্যারল্ড অজ্ঞান হয়ে যায়। কপাল খারাপ হলে সেই আঘাতে ছোটভাইটির মৃত্যুও হতে পারতো। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় ভোগে ডেসমন্ড ডস। জীবনে আর কখনও কারও সাথে মারামারি করবে না বলে মনস্থির করে। খ্রিস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে সে।

ডেসমন্ডের বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত একজন সৈনিক। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা তাকে মানসিকভাবে বদলে দিয়েছে। প্রায়ই মাতাল হয়ে থাকেন আর স্ত্রীকে মারধর করেন। মায়ের উপর বাবার নির্যাতনের ব্যাপারটি ছোটবেলা থেকে ডেসমন্ডকে পীড়া দিতো। তারুণ্যে পা দেয়ার পর ডেসমন্ড একদিন এর প্রতিবাদে বাবার উপর চড়াও হয় এবং একপর্যায়ে বাবার হাতে থাকা পিস্তলটি নিজের হাতে নিয়ে সেটাকে বাবার দিকে তাক করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে কাজটা ঠিক হয়নি। প্রতিজ্ঞা করে জীবনে আর কখনও অস্ত্র হাতে নেবে না।

মাতাল বাবার দিকে পিস্তল তাক করেছে ডস; source: Summit Entertainment

একদিন ডেসমন্ড গাড়ি মেরামত করতে গিয়ে আহত হওয়া রক্তাক্ত একজন প্রতিবেশীকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটে। হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানকার এক নার্সকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। ডরোথি নামের নার্সটির সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর লোভে হাসপাতালে রক্তদান করে ডেসমন্ড। পরদিন আবার হাসপাতালে যায় রক্তদান করতে। কিন্তু নার্স জানায়, এভাবে ঘনঘন রক্ত নেয়া যায় না। এককথায়, দুই কথায় ডেসমন্ড নার্সের সাথে খাতির জমায় এবং একপর্যায়ে দুজন একে অন্যের প্রেমে পড়ে যায়। ডরোথির কাছ থেকে মেডিকেলের বই নিয়ে পড়তে শুরু করে ডেসমন্ড, উদ্দেশ্য যুদ্ধের ময়দানে সেনাবাহিনীর হয়ে মেডিক হিসেবে যোগদান করা। পরিবার ও প্রিয়তমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিলিটারি ট্রেনিং নিতে চলে যায় ডস।

মিলিটারি ট্রেনিংয়ে ডেসমন্ড ডস; source: Summit Entertainment

ট্রেনিংয়ের প্রতিটি ধাপ কৃতিত্বের সাথে পার হলেও অস্ত্রচালনায় অংশ নিতে আপত্তি জানায় সে। উর্ধ্বতন অফিসাররা জানান, সবগুলো বিষয়ে কৃতকার্য না হলে যুদ্ধে যোগদান করতে দেয়া হবে না। অতএব অস্ত্রচালনা ডসকে শিখতেই হবে। গুলি ছুঁড়তেই হবে। কিন্তু ডস নাছোড়বান্দা। সে অস্ত্র ছোঁবেই না। ডসের এই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে অনেক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তারপরও নিজের সিদ্ধান্তে ডস অটল। ডস কি পারবে ট্রেনিংয়ে কৃতকার্য হয়ে যুদ্ধের ময়দানে যোগ দিতে? সে কি যুদ্ধে গিয়েও নিজের এই প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতে পারবে? কীভাবে সম্ভব? জানতে হলে দেখতে হবে ২টি অস্কার জিতে নেয়া দুর্দান্ত এই সিনেমাটি।

রিভিউ

সিনেমার প্রথমাংশে রয়েছে পারিবারিক ড্রামা, খুনসুটি আর প্রেম, যা দর্শককে আনন্দ দেবে, হাসাবে, মুগ্ধ করবে। পরের অংশে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য- ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, যা দর্শককে শিউরে উঠতে বাধ্য করবে। পরিচালক মেল গিবসন দুটো অংশই সুনিপুণভাবে পরিচালনা করেছেন। ব্রেভহার্ট, অ্যাপোক্যালিপ্টোর মতো অ্যাকশনধর্মী সিনেমা যিনি সুনামের সাথে উপহার দিয়েছেন, তিনি যে এবারও যুদ্ধ চিত্রায়নে মুন্সিয়ানা দেখাবেন তাতে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন, আবেগ, ড্রামা ও প্রেম চিত্রায়নেও যে মেল গিবসন সমানভাবে পারদর্শী তার প্রমাণ পাওয়া যায় হ্যাকস রিজ সিনেমায়। পরিচালক হিসেবে নাম কুড়ানোর আগে মেল গিবসন নিজেও একসময় স্বনামধন্য অভিনেতা ছিলেন। তাই অভিজ্ঞতার দিক থেকেও তিনি সমৃদ্ধ সেটা বলা যেতেই পারে।

সিনেমার মুখ্য চরিত্র অর্থাৎ ডেসমন্ড ডসের ভূমিয়ায় অভিনয় করেছেন অ্যামেজিং স্পাইডার খ্যাত অভিনেতা অ্যান্ড্রু গার্লফিল্ড। মিষ্টি হাসি আর সরল চাহনি দিয়ে মন কেড়ে নিয়েছেন দর্শকদের। ডেসমন্ড ডস চরিত্রের সাথে এতটাই মিশে গিয়েছিলেন যে একবারও মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন। ফলশ্রুতিতে, সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিলেন তিনি।

সিনেমাটিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন অ্যান্ড্রু গার্লফিল্ড; source: Summit Entertainment

ডসের বাবার চরিত্র অভিনয় করেছেন ম্যাট্রিক্স সিনেমার ভিলেন এজেন্ড স্মিথ খ্যাত অভিনেতা হিউগো ওয়েভিং। দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ডসের প্রেমিকা ডরোথির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন টেরেসা পালমার। নীল চোখের অধিকারিণী এই নারীর চাহনি থেকে শুরু করে হাসি পর্যন্ত সবই মুগ্ধ হওয়ার মতো।

ডরোথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন টেরেসা পালমার; source: Summit Entertainment

ক্যাপ্টেন জ্যাক গ্লোভার নামের একটি পার্শ্বচরিত্রে রয়েছেন অ্যাভাটার খ্যাত অভিনেতা স্যাম ওরথটিংটন। পর্দায় তার উপস্থিতি কম হলেও অভিনয়ে কমতি ছিল না।

সিনেমার দৃশ্য ধারণের দায়িত্বে ছিলেন সাইমন ডাগেন। ক্যামেরার চোখ দিয়ে দর্শকের কাছে যুদ্ধকে খুব বাস্তবমুখী ও নিষ্ঠুরভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। দর্শকের মনে হবে যেন নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছেন।

সিনামাটির মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন দুই মেধাবী সঙ্গীত পরিচালক রুপার্ট গ্রেসন-উইলিয়ামস। নিজেদের কাজ খুব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন তারা। বিভিন্ন দৃশ্যের সাথে তাদের করা যথোপযুক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দর্শকের কাছে সিনেমাটি আরও উপভোগ্য করে তুলেছে।

পুরষ্কার ও মনোনয়ন

অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, বিএএফটিএ সহ মোট ১০৯টি মনোয়ন এবং ৪৩টি পুরষ্কার ঝুলিতে পুড়েছে সিনেমাটি। এছাড়াও ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে ৭৩ তম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করা হলে মুভি শেষে মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধায় মোহবিষ্ট উপস্থিত দর্শকরা ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেন।

রেটিং

আইএমডিবি: ৮.২/১০ (২,৮১,০০০+ ভোট)

রটেন টমেটোস: ৮৬% (২৪৪ রিভিউ)

আপনি যে জনরার সিনেমাপ্রেমী হন না কেন সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত যুদ্ধবিরোধী এই সিনেমাটি আপনার মনে দাগ কেটে যাবে বলে আশা করা যায়।

বাস্তবজীবনের ডেসমন্ড ডস ও তার প্রেমিকা পরবর্তীতে স্ত্রী ডরোথি; Source: Summit Entertainment

শান্তির জন্য কাজ করে যাওয়া বাস্তব জীবনের ডেসমন্ড ডস পরবর্তীতে তার প্রেমিকা ডরোথিকে বিয়ে করেছিলেন এবং স্ত্রীর মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তিনি। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ৮৭ বছর বয়সে ডেসমন্ড ডস ইহলোক ত্যাগ করেন।

মুভি প্রোফাইল

সিনেমার নাম: হ্যাকস রিজ (Hacksaw Ridge)

মুক্তির তারিখ: ৪ঠা নভেম্বর, ২০১৬ (আমেরিকা)

ভাষা: ইংরেজি

ব্যপ্তি: ২ ঘণ্টা ১৯ মিনিট

পরিচালক: মেল গিবসন

প্রযোজক: বিল মেকানিক, ডেভিড পারমেট, টেরি বেনেডিক্ট, পল কারি, ব্রুস ডেভি, ব্রায়ান অলিভার, উইলিয়াম ডি. জনসন

প্রোডাকশন কোম্পানি: ক্রস ক্রিক পিকচার্স, ড্রিমারেস্ট ফিল্মস, পেন্ডেমোনিয়াম ফিল্মস, পারমেট প্রোডাকশনস, ভেনেডিয়ান এন্টারটেইনমেন্ট

বাজেট: ৪ কোটি ডলার

বক্স অফিস: ১৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার+

ফিচার ইমেজ: special-ops.org

Related Articles

Exit mobile version