“Not everyone can be a great artist. But a great artist can come from anywhere.” -Ratatouille
মনে করুন, আপনি এক প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে আয়েশ করে বসেছেন। বিরিয়ানির প্রতিটি ঝরঝরে ভাতের সুঘ্রাণ আপনি আলাদা করে টের পাচ্ছেন, বিরিয়ানির নরম তুলতুলে মাংস মুখে দেওয়ামাত্র গলে যাচ্ছে। এসময় এক চুমুক বোরহানি মুখে নেবার সাথে সাথে একটা অলীক অনুভূতি হল আপনার, কেমন লাগবে যদি সেই অনুভূতি হয় ভাল একটা বই পড়ার মতন, কিংবা চমৎকার একটা গান শোনার কাছাকাছি কিছু?
র্যাটাটুলি সিনেমাটি আপনাকে তেমনই এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। অ্যানিমেটেড ফিল্ম আমাদের কার না ভাল লাগে? আর সেটি যদি হয় ভোজনবিলাস আর রন্ধনচর্চা নিয়ে, তাহলে তো কথাই নেই! এই গল্প এক নির্ভীক রন্ধনযোদ্ধার গল্প, হাজার প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে যে পৃথিবীকে দেখাতে চায় নিজের রান্নার প্রতিভা, প্রমাণ করতে চায় নিজেকে।
গল্প শুরু হয় ফ্রান্সের ছবির মতো ছোট্ট সুন্দর এক গ্রামে, রেমি তার পরিবারের সাথে সে গ্রামেই বেড়ে ওঠে। বয়সের সাথে সাথে সে বুঝতে পারে, বাকিদের চাইতে সে আলাদা। নিজের মাঝে সে আবিষ্কার করে রান্নাবান্না করার এক তীব্র আগ্রহ, একটা খাবারের সাথে ভিন্ন আরেকটা খাবারের স্বাদ মিশিয়ে দিলে যে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার এক স্বাদ পাওয়া যায় সেটা সে বুঝে ফেলে নিজে নিজেই। আর তার এই আগ্রহে নতুন মাত্রা দেয় তার বিশেষ এক ক্ষমতা, রেমির প্রখর ঘ্রাণশক্তি আর অত্যন্ত সংবেদনশীল জিভ। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু রেমির ছোট একটি সমস্যা আছে। আর তা হলো, রেমি এক ছোট্ট নরম গোলগাল ইঁদুর।
এদিকে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে চলতে থাকে আরেক গল্প। অভাবনীয় রাঁধুনী অগাস্ট গুস্তাভোর বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় ময়লা পরিষ্কার করার কাজ পায় বোকাসোকা লিঙ্গুইনি। ঢিমেতালের লিঙ্গুইনি বহু কষ্টেও রেস্তোরাঁর হালচালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে পারে না। ছোট্ট রেমির মতন তারও একটা সমস্যা ছিল, আর তা হলো সে রান্নাবান্না সম্পর্কে কিছুই জানতো না!
পুরো সিনেমায় রেমি দুলকিচালে গল্প বলে যায়, ভাগ্যের পাকেচক্রে কী করে সে লিঙ্গুইনির দেখা পেয়ে যায় (বলে রাখা ভালো, রেমি আর লিঙ্গুইনির প্রথম দেখা হওয়াটা খুব বেশি সুখকর অভিজ্ঞতা না!)। বাবা ডি’জ্যাঙ্গোর হাজার বারণ সত্ত্বেও রেমি বারবার লোকালয়ে যায়, কারণ মানুষের নতুন কিছু আবিষ্কারের ঝোঁক যে তাকে তীব্রভাবে টানে! অর্বাচীন ছোটভাই এমিলকে পর্যন্ত সে যখন বিভিন্ন খাবারের অদ্ভুত অসাধারণ স্বাদের তীব্রতা বোঝাতে সক্ষম হয়, তখন রেমি বোঝে যে, চাইলে সে সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে পারে, “Anyone can cook”! পরিবারের সবাইকে ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে রেমি ফ্রান্সের মেঠো পথ ধরে পৌঁছে যায় প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের কাছাকাছি। তার এই বিচিত্র অভিযানকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পুরো সিনেমাজুড়ে।
পরিচালক ব্র্যাড বার্ড এর আগে The Incredibles আর Finding Nemo এর মতো অসাধারণ কিছু অ্যানিমেটেড ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। Ratatouille তার ব্যতিক্রম কিছু না। ছবিতে কোনো সুপারহিরো নেই, জাঁকজমকের লেশমাত্র নেই, নেই কোনো গভীর অনুভূতির দৃষ্টান্ত। কিন্তু তবুও এই সিনেমাটি তার গল্পের জোরে আর সারল্যের মাত্রায় অনেকের মনে স্থান করে নিয়েছে। চমৎকার এই অ্যানিমেটেড মুভিটিতে gourmet kitchen এর অন্তরালের গল্পটি দেখানো হয়েছে আকর্ষণীয় ভিজুয়াল ইফেক্টের সাহায্যে।
কচকচে সবুজ লেটুসের পাতা থেকে শুরু করে নরম সাদা মাশরুম, মাংসের লোভনীয় টুকরো আর শেফ (রাঁধুনি) এর অ্যাপ্রনের কোনায় লেগে থাকা স্যুপের দাগ পর্যন্ত উপভোগ করবে আপনার চোখ। এর সাথে সাউন্ড ইফেক্টের কারিগরি তো আছেই! রেমি যখন পনির, মাশরুম আর রোজমেরির মিলিত স্বাদ নিয়ে তৃপ্তির একটা শব্দ করে, মনে হবে আপনি নিজেই সেই স্বাদটি উপভোগ করছেন!
রেমির সাথে লিঙ্গুইনির দেখা হবার পরের অংশটুকু বেশ মজার। লিঙ্গুইনির দৃশ্যত উপস্থিতি আর রেমির রান্নার মেধা- এই দুইয়ের সমন্বয়ে তারা দুজনে মিলে গুস্তাভো রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে একের পর এক নতুন নতুন রেসিপি উদ্ভাবন করতে থাকে। এর মাঝে গল্পকে মশলাদার করতে বার্ড সিনেমায় নিয়ে এলেন কলেট নামের এক সহকারী শেফকে, মেয়ে হলেও যে নিজেকে দাবি করে রান্নাঘরের সবচেয়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ শেফ হিসাবে। একপর্যায়ে লিঙ্গুইনি আর কলেটের মাঝে একটা রসায়ন দেখা যায়, গুস্তাভোর রান্নাঘরের রসায়নের চেয়ে তা কিছু কম নয় বটে! এখানেই একপর্যায়ে রেমির প্রতি লিঙ্গুইনির একনিষ্ঠতা আর কলেটের জন্য আবেগের একটা সংঘর্ষ বাধে।
মৃত গুস্তাভোর একটি হাসিখুশি প্রতিচ্ছবি সবসময়েই রেমির আশেপাশে দেখা যায়, রেমির দুঃসময়ে যে তাকে সান্ত্বনা দেয়, পিছিয়ে পড়া রেমিকে উৎসাহ দিয়ে সামনে টেনে আনে এই গুস্তাভোর প্রতিচ্ছবি। একটা সময়ে তার পরিবার আর নিজের জীবনের একমাত্র স্বপ্নের মাঝে একটা টানাপোড়েন চলে আসে, কিন্তু পরিচালক বার্ড এখানে কোনো ভুল করেননি। পরিবারের গুরুত্ব যেমন তিনি দেখিয়েছেন মজার কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে, তেমনি দেখিয়েছেন কারো স্বপ্ন কাউকে কতদূর পৌঁছে দিতে পারে।
গুস্তাভোর রেস্তোরাঁর খ্যাতিতে ভাটা পড়ে তখনকার প্রধান শেফ স্কিনারের জন্যে, গুস্তাভো মারা যাবার পর স্কিনার গুস্তাভোর খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে ফ্রোজেন ফুডের ব্যাবসা শুরু করবার চেষ্টা চালায়। পরিচালক বার্ড, ছোট্ট রেমিকে কাজে লাগিয়ে স্কিনারের এই অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেন, সিনেমার এই পর্যায়ে মনে বেশ একটা সন্তুষ্টি জাগে। তবে সিনেমার মোড় ঘুরে যায় একদম শেষ দিকে, যখন অ্যান্টন ইগোর আবির্ভাব হয় পর্দায়। বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) খাদ্য-সমালোচক ইগোর সমালোচনায় গুস্তাভোর রেস্তোরাঁ ইতোমধ্যে হারিয়েছে পাঁচটি তারার একটি, কিন্তু রেমির রান্না করা র্যাটাটুলির (একটি ফ্রেঞ্চ ক্লাসিক খাবার) স্বাদে অভিভূত হয়ে ইগো লেখেন, পৃথিবীতে সবাই শিল্পী না, কিন্তু শিল্পীর আবির্ভাব হতে পারে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই! এবং শেষমেশ এটিই হয়ে যায় র্যাটাটুলি সিনেমার একমাত্র দর্শন, চাইলে যে কেউ কালিনারি আর্টিস্ট (রন্ধন শিল্পী) হতে পারে, তা মানুষ কিংবা ইঁদুর!
রেমি কী করে সাদাসিধে সবজি দিয়ে তৈরি র্যাটাটুলি রেঁধে ইগোর মন জয় করলো, তা সিনেমা না দেখে বোঝা সম্ভব না। এর প্রতিটি চরিত্রে পরিচালক বার্ড ঢেলে দিয়েছেন পরিমিত পরিমান হিউমার (রসবোধ), মানুষের (এবং ইঁদুরের) বাস্তব সীমাবদ্ধতা, উইটিনেস (ধূর্ততা) আর আবেগ। প্রধান চরিত্র থেকে শুরু করে গৌণ চরিত্রগুলোও কম শক্তিশালী নয়। রেমির ভাই এমিল, গুস্তাভোর সহকারী শেফ, এমনকি খুব কম সময়ের জন্যে পর্দায় আসা হেলথ ইন্সপেক্টর পর্যন্ত দর্শকের দৃষ্টি কেড়ে নেয় সহজেই। মোটকথা, সিনেমাটিতে ফ্রান্সের রোমান্টিক আবহের সঙ্গে রসনা বিলাসের রসায়ন খুব ভালোমতোই ঘটিয়েছেন পরিচালক বার্ড, যার সঙ্গে বিখ্যাত মিশেল গিয়াশিনোর মিউজিক তো আছেই।
প্রথমদিকে নিতান্ত খেলো রকমের মনে হলেও ফাঁকেফোকরে সিনেমাটিতে বার্ড বেশ কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন দর্শকদের। প্রথমেই এসে পড়ে মানুষ আর ইঁদুরের বেশ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ মেলামেশার ব্যাপারটি। রেমি বিশ্বাস করে, সব মানুষ তাদের ঘৃণা করে না। তাই তো বাবা ডি’জ্যাঙ্গো মানুষের কাছে যেতে মানা করে যখন তাকে বলে, “You can’t change nature”, রেমি গভীর বিশ্বাসের স্বরে বলে, “Change is nature”। এদিকে রেমিকে গুস্তাভোর প্রতিচ্ছবি একদিন বলে, “A cook makes. A thief takes”। মোটকথা, পুরো সিনেমাতে একটি সরলরৈখিক গল্পকে ঘিরে হাস্যরস, রোমাঞ্চ, রসায়ন আর অ্যাডভেঞ্চারের ছড়াছড়ি, আর উপরিপাওনা হিসেবে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটি তো রয়েছেই!
এবারে জেনে নেয়া যাক র্যাটাটুলির কিছু মজার তথ্য। এই সিনেমাটি তৈরির সময়ে এক বছরেরও বেশি সময় স্টুডিওর হলওয়েতে পোষা ইঁদুর ছেড়ে রাখা হয়, যাতে করে অ্যানিমেটররা ইঁদুরের লোম, গোঁফ, কান ইত্যাদি ভালো করে লক্ষ্য করতে পারেন। সিনেমার প্রায় ১৬ মিনিটের সময় রেমিকে একটি কুকুরের তাড়া খেয়ে পালাতে দেখা যায়, যদিও কুকুরটিকে দেখা যায় না, শুধু তার ছায়া দেখা যায়। এই কুকুরটি আর কেউ নয়, জনপ্রিয় Up (২০০৯) সিনেমার ডাগ, সিনেমাটি তখন নির্মাণাধীন ছিল। এছাড়া আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, সময় আর মেমোরি বাঁচাতে এই সিনেমায় সমস্ত মানুষের চরিত্রের ডিজাইন করা হয়েছিল পায়ের আঙ্গুল ছাড়াই! শুধু তা-ই নয়,পরিচালক ব্র্যাড বার্ড এবং প্রযোজক ব্র্যাড লুইস কিছু ক্রুকে নিয়ে সিনেমাটি তৈরির আগে প্যারিস ঘুরতে যান। মোটরসাইকেলে করে তারা প্যারিসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান, খাওয়া দাওয়া করেন প্যারিসের ৫টি নামজাদা রেস্তোরাঁয়।
২০০৭ সালে রিলিজ পাওয়া Pixar এর Ratatouille সিনেমাটি বক্স অফিসে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে এর গল্পশৈলি আর নিখুঁত ভিজুয়াল ইফেক্টের জন্যে। চাঞ্চল্যকর এই সিনেমার ঝুলিতে রয়েছে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোবসহ আরো অনেক পুরষ্কার, IMDb তে রেটিং পেয়েছে ৮। নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার এই সিনেমাটি দেখলে আসলে মনে আশা জাগে একটি সিক্যুয়েলের, কেননা ছোট্ট রেমির রান্নার অভিযান তো আসলে শেষ হয়ে যায়নি, অনেক দূর যাওয়া বাকি তার! তাই যারা ভোজনরসিক, রান্না করতে ভালবাসেন এবং একইসাথে অ্যানিমেটেড সিনেমার ভক্ত, তাদের জন্যে এই সিনেমাটি হবে একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা।
ফিচার ইমেজ: Pixar