বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বছরে ৪/৫ লাখ টাকা আয় করতে যেখানে নাভিশ্বাস, সেখানে উন্নত দেশগুলোতে বেকার বসে থেকে আয় করা যায় এর ১০ গুণেরও অধিক! ভাবছেন এ আবার কেমন কথা? হ্যাঁ, তারা কাজ তো কিছু একটা করে, কিন্তু সেগুলোর কয়েকটি আদৌ আপনার কাছে কাজ মনে না-ও হতে পারে! উন্নত দেশগুলোতে মানুষের জীবনমান যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ তত শৌখিন হয়ে উঠছে। ফলে কিছু কাজ থাকে যেগুলো করবার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, যদিও দেশে বেকার জনসংখ্যা থাকে যথেষ্টই। সেসব কাজের জন্যই নিয়োগদাতার এতো বড় অঙ্কের বেতন দেন যে তা শুনলে রীতিমত চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হয়। এরকম ১০টি অদ্ভুত চাকরির কথা জানবো আজ, যেগুলোর বেতন ঈর্ষণীয়।
গলফ বল ডাইভার
ডুবুরিদের বাৎসরিক আয় কত? বৈশ্বয়িক পরিসংখ্যান বলে ৫০-৮০,০০০ ডলার। সে তুলনায় কাজটাও নেহাত সহজ কোনো কাজ নয়। নদী বা সাগরের তলদেশে ডুব দিয়ে মরদেহ বা প্রাসঙ্গিক কোনো কিছু উদ্ধার করে আনা যথেষ্ট দুঃসাহসিক কাজ। কিন্তু একই পরিমাণ আয় যদি পুকুর নালার মতো অগভীর জলে ডুব দিয়ে আয় করা যায়, তাহলে যে কেউ সে কাজ লুফে নিতে রাজি থাকবে।
এমনই একটি কাজ হচ্ছে গলফ বল ডাইভিং। গলফ মাঠের পাশের পুকুরে বল চলে গেলে সে বল আপনাকে পুকুরের তলদেশ থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে। বিনিময়ে বছরে আয় করতে পারবেন ৫০ হাজার ডলার, যার বাংলাদেশি অর্থমান ৪০ লক্ষ টাকা! নিঃসন্দেহে কাজের তুলনায় অর্থের পরিমাণটা ঈর্ষণীয়। তবে হ্যাঁ, জলজ বাস্তুসংস্থান সম্বন্ধে একেবারে কিছু না জেনে এ কাজে যোগ দেয়াটা হবে বোকামি। কারণ, এসব পুকুরে ডুবুরির জন্য ওঁত পেতে থাকে নানা বিপদজনক জলজ প্রাণী। সাপ, কচ্ছপ, বিষাক্ত ব্যাঙ থেকে শুরু করে কুমির পর্যন্ত থাকতে পারে ডুবুরিকে ঘায়েল করবার জন্য!
পেশাদার আলিঙ্গনকারী
বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যাগুলো বর্তমান সমাজে প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে। নানা কারণে মানুষ একাকিত্ব বোধ করে এবং মানসিক জটিলতায় ভোগে। এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিতে বিশ্বজুড়ে প্রচলন বাড়ছে এক নতুন পেশার, যাকে বলা হচ্ছে স্নাগলার বা আলিঙ্গনকারী।
এই স্নাগলারের কাজ হবে একাকী সময়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা বা ঘুমিয়ে থাকা! বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ইদানীং এই অদ্ভুত পেশা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, এই পেশা আসলে ততটা সহজ নয়। একজন অপরিচিত মানুষকে আলিঙ্গন করে বসে থাকা, কিংবা চাহিদা অনুযায়ী ঘুমিয়ে পড়া চাট্টিখানি কথা নয়। আর তাই এই পেশায় টাকার অঙ্কটাও চোখ বড় করে দেয়ার মতো। একজন পেশাদার স্নাগলার ঘন্টায় গড়ে ৭০ ডলার আয় করে। তাহলে দৈনিক ৩ ঘন্টা কাজ করলেও বছরে আয় করা যাবে ৭৬ হাজার ডলার বা ৬০ লক্ষাধিক টাকা!
ওয়াটার স্লাইড টেস্টার
উন্নত বিশ্বের বিনোদন পার্কগুলোতে একই বিনোদনের উপকরণ দিয়ে বছরের পর বছর চালিয়ে দেয়া হয় না। বরং প্রতিনিয়ত বিনোদনের উপকরণগুলোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা সংস্কার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে ওয়াটারস্লাইড রাইডিং এর কথাই ধরুন না।
বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত কীভাবে এই রাইডকে আরো আনন্দদায়ক করা যায় তা নিয়ে গবেষণা চলছেই। আর এই গবেষণার ফলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ওয়াটারস্লাইড টেস্টার’ নামক অভিনব এক পেশারও। একজন ওয়াটারস্লাইড টেস্টারের কাজ হচ্ছে পার্কের নতুন তৈরি করা ওয়াটারস্লাইড রাইডারে চড়ে নিজের অভিজ্ঞতা কর্তৃপক্ষকে বলা। অভিজ্ঞতা বলতে রাইডটি কতটুকু আনন্দদায়ক কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ তা বর্ণনা করাই টেস্টারের কাজ। আদতে এটি কোনো কাজ? যে রাইডে চড়ার জন্য সাধারণ মানুষ অর্থ ব্যয় করে, সে রাইডে চড়ার বিনিময়ে আপনি বরং অর্থ আয় করবেন! ছোটখাটো অঙ্ক নয়, বছর আয় করতে পারবেন ৩০-৪০ হাজার ডলার!
পেট ফুড টেস্টার
মানুষ ভোজনরসিক প্রাণী। খাবারের স্বাদ কীভাবে আরেকটু বাড়ানো যায় তা নিয়ে চেষ্টার শেষ নেই। তবে পোষা প্রাণীর খাবার কতটুকু সুস্বাদু তা কি মানুষ জানে? উত্তর হলো জানে, কেবল পেট ফুড টেস্টাররাই জানে। হ্যাঁ, উন্নত বিশ্বের আরেকটি অদ্ভুত চাকরির নাম পেট ফুড টেস্টিং।
আপনার পোষা কুকুর কিংবা বিড়ালটি তার খাবার খেয়ে কতটা সন্তুষ্ট তা যদি আপনি জানতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এর খাবার নিয়ে আপনার বিশেষ ভাবনার প্রয়োজন হতো না। আর এই স্বাদ আপনাকে জানাবে পেট ফুড টেস্টার। তার কাজ হলো বিভিন্ন রকম পোষা প্রাণীর খাবারের স্বাদ নেয়া এবং সেগুলো সম্পর্কে নিজের মন্তব্য লিখে ফেলা। এই মন্তব্য একইসাথে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের কাজে লাগে। উল্লেখ্য, একজন পেশাদার পেট ফুড টেস্টার অবশ্যই পশুখাদ্য খেয়ে ফেলেন না। তার কাজ কেবল সামান্য একটা অংশ মুখে পুড়ে তার স্বাদ নিয়ে ফেলে দেয়া। তারপর কুলি করে অন্য নমুনার স্বাদ নেয়া। পেট ফুড টেস্টারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কীভাবে খাবারের স্বাদ বর্ধন করা যায় সে বিষয়ে বুদ্ধি দেয়া। আর এই কাজ করতে গিয়ে বছরে ৪০ হাজার ডলার আয় করে থাকেন একজন পেট ফুড টেস্টার।
পেপার টাওয়েল স্নিফার
এখন পর্যন্ত আলোচিত কাজগুলোর মধ্যে সহজতম হচ্ছে পেপার টাওয়েল স্নিফিং। কাজ বলতে, গন্ধ শোকার প্রখর শক্তি থাকলেই আপনি এই কাজের উপযুক্ত। বিক্রয়ের জন্য উন্মুক্ত করার পূর্বে কোম্পানির পেপার টাওয়েলগুলো নিয়ে শুঁকে শুঁকে দেখতে হবে যে তাতে কোনো অস্বস্তিকর গন্ধ আছে কিনা। ব্যস, এই কাজের জন্যই বছরে ৫০ হাজার ডলার বেতন পেয়ে থাকেন একজন পেপার টাওয়েল স্নিফার! তবে এতটুকু জানার পরই যদি উৎসাহী হয়ে ওঠেন, তাহলে জেনে রাখা ভালো, এই চাকরি করার চেয়ে চাকরি জোটানোই অনেক কঠিন। দুর্মূল্যের বাজারে সকলেই অল্প পরিশ্রমে অধিক আয় করার এমন লোভনীয় চাকরি লুফে নিতে চায়। কিন্তু এই চাকরি যে প্রায় সোনার হরিণের মতোই দুষ্প্রাপ্য। আমেরিকায় তাই একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, “পেপার টাওয়েল স্নিফারের চেয়ে হলিউডে অভিনেতা হওয়া সহজ!”
বেড টেস্টার
যে কেউ একবাক্যে মেনে নেবে যে বেড টেস্টারের চাকরিতে আদতে কোনো কাজই নেই। কারণ আরামদায়ক বিছানায় দৈনিক ৬-৮ ঘন্টা শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা আবার কীসের কাজ? অলস মানুষের জন্য এটি হতে পারে স্বপ্নের মতো চাকরি। কেবল ঘুমানোর জন্য বছরে ৫৫-৬০,০০০ হাজার ডলার আয় করা যায়, এ কথা ভাবতেও চোয়াল খুলে পড়ে যাবার অবস্থা হয়। কিন্তু বাস্তবে বেড টেস্টারের চাকরিটি অতটাও সহজ নয়। বিশেষত যখন আপনাকে শো-রুমে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে ঘুমাতে হবে তখন তো একেবারেই না।
কোনোদিন ঘুমানোর পূর্বে আপনাকে ক্যাফেইন খাওয়ানো হবে, কোনোদিন বা অ্যালকোহল, তাপমাত্রা ওঠানামা করবে, থাকবে যান চলাচল ও হর্নের শব্দ। অন্ধকারে ঘুমানোর সুযোগ তো নেই বললেই চলে। অনুজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝেই ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমাতে হবে। তবে সবচেয়ে বিব্রতকর যা হতে পারে, তা হলো শোরুমে দিনভর আসতে থাকা ক্রেতারা। আপনি একটি বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন আর সে বিছানাটি ক্রমাগত নতুন নতুন মানুষ এসে দেখছে, দাম আলোচনা করছে, এরকম পরিস্থিতে ঘুম হবে? এখন নিশ্চয়ই এই চাকরিটিকে দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে?
লাইন সিটিং
লাইন সিটিংকে লাইন স্ট্যান্ডিংও বলা যেতে পারে, কিন্তু কাজ একই। এই কাজটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজগুলোর একটি, যদিও এখানে কোনোরূপ পরিশ্রম করতে হয় না। কী কাজ? অফিসে, স্কুলে, ব্যাংকে, ডাক্তারখানায় কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে, যেখানে দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি হয় গ্রাহকদের, সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা যে কতটুক বিরক্তির কাজ তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। তবে, এই বিরক্তি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য লাইন সিটার নিয়োগ দিচ্ছে অনেক কোম্পানি। চাইলেই সেখান থেকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে লাইন সিটার ভাড়া করা যাবে, যিনি আপনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আপনার কাজটি সম্পন্ন করবেন! যদিও কাজটি বিরক্তিকর, তথাপি লাইনে দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন ঘেটে কয়েক ঘন্টা পার করে দিতে পারলেই ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করা যায়। একজন লাইন সিটার দৈনিক ১০০ ডলার আয় করতে পারেন। অর্থাৎ, একপ্রকার বেকার থেকেই বছরে আয় করা যায় ৩৬,০০০ ডলার।
পারসোনাল শপার
শপিং করতে কে না ভালোবাসে? তবে সবার শপিং একরকম হয় না। কেউ ভালো পোশাক পরিচ্ছদ বেছে কিনতে পারেন, কিন্তু দামাদামি করতে পারেন না। আবার কেউ যথেষ্ট দামাদামি করলেও ভালো পণ্য কিনতে ব্যর্থ হন। তবে, ভালো পণ্য বাছাই করতে পারেন এবং একইসাথে দামাদামিতে পটু, এরকম মানুষ একেবারেই হাতেগোনা। আর এই হাতেগোনাদের জন্যই রয়েছে একটি লোভনীয় চাকরি, যার নাম পারসোনাল শপিং। ঘন্টায় ৬০ ডলারের বিনিময়ে কেবল একজন ক্রেতাকে তার পছন্দসই পণ্য কিনতে সহায়তা করতে হবে। দৈনিক ৫ ঘন্টা করে কাজ করলে একজন পারসোনাল শপারের পক্ষে বছরে ১ লক্ষ ডলারের বেশি আয় করা সম্ভব!
গার্বেজ ম্যান
‘গার্বেজ ম্যান’ বা ময়লা পরিবহন করার কাজ মোটেও কোনো অদ্ভুত কাজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বসে এ কাজকে অদ্ভুত মনে হবে এর চোখ কপালে তোলা বেতনের জন্য। ময়লা পরিবহন করার কাজ করে একজন গার্বেজ ম্যান বছরে ৫০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ ডলার পর্যন্ত আয় করেন! হ্যাঁ, অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবচেয়ে অবহেলিত এই চাকরিতেই উন্নত দেশে আছে অর্থের ঝনঝনানি। বিশেষত ইউরোপীয় দেশগুলোতে কিংবা আমেরিকার উন্নত শহরগুলোতে ময়লা বহনের কাজ করার মানুষ নেই বললেই চলে। ফলে, মানুষকে এই চাকরির প্রতি আকৃষ্ট করতে কোম্পানিগুলো মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে থাকে।
ফিচার ছবি: interplasp.com