প্রথমেই বলে রাখা ভালো, খাবার আর সিনেমার রিভিউ ব্যক্তিভেদে আলাদা হওয়াটাই অতি স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত রুচি, বোধগম্যতা আর পছন্দের উপর নির্ভর করে একটি সিনেমা নিয়ে বিভিন্ন মানুষের আলাদা আলাদা রকম মন্তব্য থাকে। যেকোনো ধরনের ‘শিল্প’ কারো উপর চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তাই কোনো রিভিউকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই। এই লেখাটি ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া বলিউড ফিল্ম ‘ফ্যান্টম’ এর রিভিউ সম্পর্কিত। ছবিটি পরিচালক কবীর খানের অন্যান্য ছবির মতো বিশাল ব্যবসা করতে পারেনি, অন্তত একই বছরের প্রথম দিকে মুক্তি পাওয়া ‘বজরাঙ্গি ভাইজান’ এর ব্যবসার কাছে ‘ফ্যান্টম’ কিছুই না। কিন্তু শুধু উপার্জনের উপর ভিত্তি করে যদি আপনি একটি ছবির ‘ক্লাস’ বিচার করেন, তবে আপনি শুধু ঠকবেনই না, বরং অনেক সুখাদ্য ছবির স্বাদ আস্বাদন থেকেও বঞ্চিত হবেন।
পটভূমিকা
‘ফ্যান্টম’ ২০১৫ এর ২৮ আগস্ট মুক্তি পাওয়া স্পাই অ্যাকশন থ্রিলার। এর কাহিনীর পটভূমিকায় রয়েছে ২০০৮ সালের ২৬/১১ এর মুম্বাই হামলার ঘটনা। প্রখ্যাত লেখক ও প্রাক্তন ক্রাইম রিপোর্টার হুসাইন জাইদীর ‘মুম্বাই অ্যাভেঞ্জার্স’ বই থেকে এর চিত্রনাট্য অনুপ্রাণিত। এই বইয়ে কয়েকজন মানুষের চরিত্রায়ন করেন জাইদী, যারা মুম্বাই হামলার পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের একে একে হত্যা করে। কিন্তু ছবিতে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে কয়েকজনের পরিবর্তে মাত্র একজন মানুষকে দেখানো হয়েছে, একজন ফ্যান্টম।
গল্পের গড়ে ওঠা
ছবির শুরুতেই দেখানো হয়, পাকিস্তানী এক সন্ত্রাসী সংগঠন আবারও ভারতের সীমান্ত দিয়ে তাদের হামলাকারী প্রেরণ করেছে। অল্পের জন্য সে হামলাকারী ধরা পড়ে যায় বিএসএফ এর হাতে। বারবার এমন চোরাগুপ্তা হামলা থামানোর উপায় নিয়ে চিন্তিত ‘র’ এর প্রধানের কাছে এক তরুণ অফিসার বুদ্ধি দেন যে, ওদের পাল্টা জবাব না দিলে এমনটা চলতেই থাকবে। মুম্বাই হামলার ৭ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও তারা যখন এই হামলার মূল হোতাদের কিছুই করতে পারেনি, তখন সন্ত্রাসীদের এমন দুঃসাহস স্বাভাবিক। তাই এমন দক্ষ কাউকে মিশনে পাঠানো হোক যে একইসাথে মুম্বাই হামলার সকল নীলনকশাকারীকে একে একে হত্যা করবে, আবার যাকে চিহ্নিত করার মতো কোনো অতীত রেকর্ডও পাওয়া যাবে না। কেননা, এই মিশনের পেছনে র এর আঁতাতের কথা চাউর হলে ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধে গড়িয়ে যাবে।
স্বভাবতই, এই মিশনে সরকারের অনুমোদন হলো না। কিন্তু র নিজ গরজেই এমন একজনকে খুঁজে বের করলো, যার অতীত বলতে শুধু ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে ডিউটি অবজ্ঞার কারণে বহিষ্কারের রেকর্ডই আছে। রেশন কার্ড, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, কোথাও তার কোনো নিশানা নেই, এককথায় যেন ফ্যান্টম। এমনই এক রহস্যময় অস্তিত্বধারী দানিয়াল খানকে এই মিশনে পাঠায় র। না, যতটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, ততটা মোটেও না। কেনই বা দানিয়াল খান এমন সুইসাইড মিশনের জন্য রাজি হলো, তারও সুন্দর উত্তর আছে। যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য করেই দানিয়াল খানের চরিত্র ও ব্যক্তিগত কাহিনী সাজানো হয়েছে। প্লটের কোনো ‘লুপহোল’ একেবারে অনুপস্থিত এই ছবিতে। এরপর দানিয়াল খান কী করে একে একে মুম্বাই হামলার ঘাতকদের হত্যা করে, আদৌ সবাইকে হত্যা করতে পারে কিনা, কিংবা এই মিশন শেষে সে জীবিত ফিরে আসতে পারে কিনা, সবমিলিয়ে টানটান উত্তেজনায় ২ ঘন্টা ১৫ মিনিট কাটবে আপনার। প্রচলিত বাণিজ্যিক সিনেমার ক্যাটাগরিতে ফ্যান্টমকে ফেলা যায় না। অতিশয় বাস্তবসম্মত এর কাহিনী ও চরিত্রায়ণ।
মূল চরিত্র
দানিয়াল খানের চরিত্রে সাইফ আলী খানের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করতে হয়। বলিউডে মূল ধারার স্পাই থ্রিলার সম্ভবত সাইফের হাত দিয়েই শুরু, ‘এজেন্ট বিনোদ’ ছবির মাধ্যমে। জটিল প্লটবিশিষ্ট ও ব্যবসায়িকভাবে অসফল ছবিটি দিয়ে স্পাই চরিত্রে সাইফ তার অভিনয়ের ধার ভালোই দেখিয়েছিলেন। সেই ধার পুরোপুরি অবিকৃত রয়েছে ফ্যান্টমে। মূলত সাইফের দৈহিক নমনীয়তা ও অঙ্গভঙ্গি, এমনকি চোখের চাহনিও স্পাই চরিত্রের সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। বন্দুক হাতে তার ক্রল করা বা ভারি মেশিনগান নিয়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গিমা দেখলে তাকে একজন প্রশিক্ষিত সামরিক ব্যক্তিত্বের থেকে কোনো অংশে কম মনে হবে না।
সাইফের সাথে তাল মিলিয়ে ক্যাটরিনা কাইফও অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার চরিত্রটি। র এর ইনফর্মার নওয়াজের চরিত্রে ক্যাটরিনা অনেক বেশি দক্ষতা ও সাবলীলতা দেখিয়েছেন। ক্যাটরিনার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে একশ্রেণীর মানুষ সর্বদা সমালোচনামুখর থাকেন। তাদের অভিনয় বিশ্লেষণের মাপকাঠি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্যণীয়, ক্যাটরিনা ‘এক থা টাইগার’ ছবির মাধ্যমেই স্পাই থ্রিলারে তার আলাদা কর্মকৌশল দেখিয়েছিলেন। লম্বা, চওড়া ও নমনীয় দেহ সৌষ্ঠব এবং চরিত্রের সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারার কারণে অ্যাকশন থ্রিলারগুলোতে তার চাহিদা কয়েক বছরে বেশ বেড়ে গেছে। ফলে তার হাতে এসেছে ফ্যান্টম, ব্যাং ব্যাং, টাইগার জিন্দা হ্যায় এর মতো ছবিগুলো। ফ্যান্টমে সাইফের সহযোগীর চরিত্রটি যথেষ্ট সুন্দর ও বাস্তবসম্মত করেই মেলে ধরেছেন ক্যাটরিনা।
র এর চিফের ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং র অফিসারের চরিত্রে জিশান আইয়ুব নিজেদের ভালোভাবেই উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া নৌবাহিনীর কমান্ডার, লাহোরের হোটেল মালিক, হোটেল বয়, ডাক্তারসহ অন্যান্য ছোট কিন্তু গুরুত্ববহ চরিত্রগুলো অত্যন্ত সুচারুরূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
স্থান নির্বাচন ও রূপায়ন
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংঘাতবিক্ষুব্ধ এলাকাসমূহে দীর্ঘদিন ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করেছেন কবীর খান। এসব এলাকার মানুষ ও স্থানগুলো সম্পর্কে তাই তার বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর তাই ফ্যান্টমে কোনো চরিত্রায়ণ বা কোনো স্থান সজ্জাই অবাস্তব মনে হবে না। এই ছবিতে সিরিয়ার একটি সংঘাতের তুলে ধরা হয়েছে। এই অংশটি সিরিয়াতেই চিত্রায়ণ করতে চেয়েছিলেন কবীর খান, কিন্তু চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। সিরিয়ার অংশটি তাই লেবাননের বৈরুতের আশেপাশে শ্যুট করা হয়। কিছু সত্যিকারের আমাল শিয়া বিদ্রোহী সিরিয়ার গোলাগুলির দৃশ্যটিতে অংশ নেন। সুতরাং এই ছবিতে যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়ার প্রায় বাস্তব একটি রূপের সাথে বাস্তব মিলিট্যান্টও দেখতে পাবেন দর্শক।
পাকিস্তানের দৃশ্যগুলো কবীর চিত্রায়ণ করেছেন মালারকোটলায়। মালারকোটলা ভারতের পাঞ্জাবের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর। বহুল সংখ্যক মসজিদ, সরু গলি এবং সার্বিক স্থাপত্যশৈলির কারণে মালারকোটলাকে পাকিস্তানী এলাকা হিসেবে বেশ ভালোভাবেই সাজাতে পেরেছে কবীর খানের টীম।
বিশেষ দৃশ্য ও সঙ্গীত
কোনো অহেতুক বা অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যের অবতারণা নেই ফ্যান্টমে। নায়ক-নায়িকাকে জোর করে প্রেমে পড়ানোর বা অবশ্য কর্তব্য হিসেবে তাদের মিলন ঘটানোর অযাচিত তাড়না নেই ছবিতে। সহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে গড়ে ওঠা সূক্ষ্ম স্নেহ আর বন্ধুত্বের আবহ আছে। সিরিয়াস মিশনে পা বাড়ানোর আগমূহুর্তে স্থানীয়দের মতো পোশাক পরা নায়ককে নায়িকা যখন বলে “জামাটা রেখে দিও, ভালো লাগছে”, সেটাই বোধহয় একমাত্র রোমান্টিক সংলাপ। লস্কর-ই-তৈয়্যবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সায়িদকে এই ছবিতে চিত্রায়িত করা হয়েছে হারিস সায়িদ নামে। এক দৃশ্যে দানিয়াল খান (সাইফ) গাড়ি উল্টে পড়ে থাকা আহত হারিস সায়িদকে গুলি করার আগে বলে, “আপনি বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন না, ইন্ডিয়া কী চায়? ইন্ডিয়া চায় ন্যায়।” এই দৃশ্যটি পুরো ছবিটির ভাববস্তু এক বাক্যে তুলে ধরে।
প্রীতম চক্রবর্তীর অসাধারণ মিউজিক এই ছবিতে অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। পুরোপুরি পাকিস্তানী আবহে তৈরি সৈয়দ আসরার শাহ’র ‘আফগান জালেবি’ গানটি কথা ও সুরে তুলে এনেছে পাকিস্তানী সংস্কৃতি ও আনন্দ উৎসবের বাস্তব প্রকৃতি। আত্মবিশ্লেষণমূলক ‘নাচদা’ গানটি প্রধান চরিত্রের সাথে পুরোপুরি মানানসই। ছবির শেষে অরিজিৎ সিংয়ের গাওয়া ‘সাওয়ারে’ ক্লাইম্যাক্স এর সাথে সাদৃশ্য রেখে এবং বেদনার সাথে অপূর্ণতার ছাপ রেখে তৈরি করা হয়েছে। মন উদাস করতে এবং অন্তরাত্মায় শূন্যতা তৈরি করতে জুড়ি নেই গানটির। সকল গানই কাহিনী ও চরিত্রদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কোনো ভিত্তিহীন, অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত গান বা আইটেম নাম্বারের সন্নিবেশ নেই এতে। এছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক উত্তেজনাকর অ্যাকশন দৃশ্যগুলোর সাথে সম্যক সামঞ্জস্যপূর্ণ।
খুব স্বাভাবিক কারণেই হাফিজ সায়ীদের পিটিশনের পরে লাহোর হাইকোর্ট পাকিস্তানে ফ্যান্টম নিষিদ্ধ করেছিল। IMDb-তে 5.7 রেটিং পাওয়া ফ্যান্টম ভারতে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছিল। ফ্যান্টমের কাহিনী বাস্তব নয়, তবে এটি দেখার পর সবাই ভাবতে বাধ্য হবেন, যদি এটিই সত্যি হতো! ছবিটির ট্যাগলাইনই হলো, “A story you wish were true”। তাই স্পাই থ্রিলারের ভক্ত হয়ে থাকলে এবং এখনও ফ্যান্টম না দেখে থাকলে বসে পড়তে পারেন এটি নিয়ে। আপনার অন্যতম পছন্দের অ্যাকশন ফিল্ম হিসেবে অনায়াসে জায়গা করে নেবে ফ্যান্টম।
ফিচার ইমেজ: UTV