দ্য এক্সরসিস্ট: কেবলই ভৌতিক সিনেমা নয়

The scariest movie of all time.

দ্য এক্সরসিস্ট সিনেমার পোস্টারে এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে এর পরিচয় দিতে গিয়ে। ‘সর্বকালের ভয়ংকরতম চলচ্চিত্র’- বাক্যের অনুবাদটি অনেকটা এরকম। সুতরাং পাঠক নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন, যেনতেন কোনো সিনেমা নিয়ে কথা বলতে আসিনি আজ। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই হরর ক্লাসিককে স্রেফ ভৌতিক সিনেমার তকমা দিলে বড় ধরনের ভুল হবে। ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ প্রথম হরর সিনেমা, যেটি সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড মনোনয়ন পায়।

‘দ্য এক্সরসিস্ট’ সিনেমার পোস্টার; Source: iTunes

কাহিনী সংক্ষেপ

রৌদ্রতপ্ত এক দুপুর। ইরাকের শহর হাত্রাতে খননকার্যে নিয়োজিত কিছু শ্রমিক ঘাম ঝরাচ্ছে অবিরাম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্যই চলছে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ। ক্যাথলিক পাদ্রী ফাদার ল্যাঙ্গাস্টার মেরিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। সুদূর আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছেন এই বৃদ্ধ ধর্মযাজক। খননকার্যের হর্তাকর্তা তিনিই, সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ফাদার মেরিন কিন্তু তার অশান্ত মানসিক অবস্থা প্রকাশ করছেন না। কেন যেন এই জায়গাটার অশুভ আবেদন টের পাচ্ছেন তিনি। সকাল থেকে কিছু খারাপ পূর্বাভাস দেখে চোখ-কান খোলা রাখতেই হচ্ছে। বিচলিত যাজকের কাছে আচমকা ছুটে আসে এক শ্রমিক। নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া গেছে, এমনটিই জানালো সে। আবিষ্কৃত নিদর্শনের কাছে ফাদার মেরিনকে নিয়ে যাওয়া হলো। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় ফাদারের, টপ টপ করে ঘাম বেয়ে পড়ে তার কপাল থেকে। এ যে এক প্রাচীন অপদেবতার মূর্তি! মূর্তির সামনে চিন্তামগ্ন ফাদার ভাবেন, “এতদিন ধরে যে অশুভ লক্ষণ টের পাচ্ছিলাম, তার নেপথ্যে কি এই মূর্তি দায়ী?”

অপদেবতার মূর্তির মুখোমুখি ফাদার মেরিন; Source: Geeksinaction.com

ইরাক থেকে চলুন এবার যাই আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। ওয়াশিংটনের এক অভিজাত এলাকা জর্জটাউন, সেখানে বাস করেন ক্রিস ম্যাকনেইল আর তার ১২ বছর বয়সী মেয়ে রেগান। ক্রিস পেশায় একজন অভিনেত্রী, ভালোই নামডাক কামিয়েছেন তিনি। মা-মেয়ে একটি প্রকাণ্ড বাড়িতে থাকে, সাথে নায়িকার ব্যক্তিগত সহকারী শ্যারন আর দুজন গৃহকর্মী। স্বামীর সাথে ক্রিসের বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও মা-মেয়ের দিন খারাপ যাচ্ছিল না। ক্রিস দিনের শুরুতেই বেরিয়ে পড়েন শ্যুটিংয়ের জন্য। যেদিন কাজের চাপ কম থাকে, সেদিন মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। আর বাসায় রেগানের দেখাশোনার জন্য শ্যারন তো রয়েছেই।

মা ক্রিস ম্যাকনেইল আর মেয়ে রেগান; Source: ihorror.com

সকালের মিষ্টি রোদে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় ঝলমল করছে। আজ ক্রিস এর সিনেমার শ্যুটিং স্পট এই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গন। জনপ্রিয় নায়িকাকে দেখার জন্য উৎসুক জনতার ভীড়। ভীড় সামলে শ্যুটিং চলছে অবিরাম। সংলাপ আওড়াতে ব্যস্ত ক্রিস, হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন, বেশ কিছুক্ষণ যাবত একজন লোক তাকে দূর থেকে চোখে চোখে রাখছে। লোকটার পোশাক দেখেই বোঝা যে তিনি একজন ক্যাথলিক পাদ্রী। বয়স বড়জোর পঁয়ত্রিশ। চোখে-মুখে সংশয়ের ছাপ স্পষ্ট তরুণ পাদ্রীর মুখাবয়বে, সে কি ক্রিসকে কিছু বলতে চায়?

এই তরুণ পাদ্রী সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। নাম তার ডেমিয়েন কারাস। ফাদার কারাস শুধু একজন ধর্মযাজক নন। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে বক্তৃতা দেন তিনি। মনোবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করা ফাদার কারাস জাদুবিদ্যা সম্পর্কেও অগাধ জ্ঞান রাখেন। সিনেমায় তার আবির্ভাব ঘটে একজন বিমর্ষ-চিন্তাগ্রস্ত মানুষ হিসেবে। তার মা অর্থাভাবে এক মানসিক হাসপাতালে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অপরদিকে তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। ঈশ্বর, ধর্মগ্রন্থ আর শয়তানের অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন তিনি। কোনো এক অজানা কারণে দীর্ঘদিন লালন করা বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন তিনি। একজন ক্যাথলিক পাদ্রী হয়ে এমন অবিশ্বাসী আচরণ তাকে প্রচণ্ড পীড়া দেয়।

ফাদার ডেমিয়েন কারাস; Source:  Oscarchamps.com 

শ্যুটিং শেষে একসময় ঘরে ফেরেন ক্রিস। পায়চারি করার সময় কিছু অদ্ভূত আওয়াজ শুনতে পান। গৃহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, ওপরের তলায় ইঁদুরের প্রচণ্ড উৎপাত। ইঁদুরগুলোই রাতভর হুটোপুটি করে, সেই আওয়াজ শুনেই ভড়কে গেছেন ক্রিস।

ক্রিস আর রেগান আলাদা ঘরে শোয়। ঘুমুতে যাবার আগে মেয়েকে কিছুক্ষণ সময় দেন ক্রিস। মিনিটখানেক গল্প করার পর বাতি নিভিয়ে নিজের রুমে ফিরে যান তিনি।

ঘর গোছাচ্ছিলেন ক্রিস, একটি ওইজা বোর্ড খুঁজে পেয়ে বেশ বিস্মিত হলেন তিনি। মৃত মানুষের সাথে যোগাযোগ করার এক পদ্ধতি হচ্ছে ‘ওইজা বোর্ড’। যদিও ব্যাপারটা নিছক খেলার ছলেই করা হয়, বাস্তবে আত্নার সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটি কেউ গুরুত্বের সাথে নেয় না। রেগানকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ওইজা বোর্ড দিয়ে সে এক অদৃশ্য বন্ধুর সাথে গল্প করে। ছেলেমানুষি হিসেবে উড়িয়ে দিলেও ক্রিস অবচেতন মনে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করেন। রেগানের অসংলগ্ন আচরণ ক্রিসকে ভাবায়। একদিন রঙ-তুলি নিয়ে রেগান ছবি আঁকছিল। ছবিগুলো ক্রিসের চোখে পড়ে যায়। বিচিত্র কিছু পশু পাখির ছবি এঁকেছে ক্রিস, যেগুলো দেখলেই কেমন শিরশিরে অনুভূতি হয়। তাছাড়া কয়েকদিন যাবত রেগান অভিযোগ করছিল রাতের বেলা ঘুমের সময় তার বিছানা নাকি নড়াচড়া করে। ওইজা বোর্ড, অদ্ভূত ছবি আর রাতে খাট নড়ার ঘটনা- সব মিলিয়ে মেয়েকে নিয়ে চিন্তার সাগরে ডুবে যান ক্রিস। ডাক্তারের কাছে গিয়ে রেগানকে নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে যায়, কোনোভাবেই তারা রেগানের সমস্যা ধরতে পারছে না। রেগান কি শারীরিক কোনো সমস্যার শিকার? নাকি নিতান্তই মানসিক অবসাদের কারণে অসংলগ্ন ব্যবহার করছে?

হাসপাতালে রেগানের চিকিৎসা চলছে; Source: cheerfulcynicism.com

ডাক্তারি পরীক্ষায় রেগানের অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। দিশেহারা হয়ে পড়েন ক্রিস। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে একজন তাকে এক অদ্ভূত সুপারিশ করে বসে। ডাক্তার রেগান কে ‘এক্সরসিজম’ করানোর পরামর্শ দেয়। রোমান ক্যাথলিক ধর্মমতে, অশুভ আত্না বা শয়তান যখন মানুষের শরীরে ভর করে, তখন সেই সত্তাকে বিতাড়িত করার জন্য বাইবেলের বাণী ব্যবহার করে যে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা হয়, তাকেই ‘এক্সরসিজম’ বলে। ধর্মে অবিশ্বাসী ক্রিস এমন প্রস্তাব উড়িয়ে দেন। কিন্তু আচমকা রেগানের সাথে এমন কিছু ঘটতে শুরু করে, নিরুপায় ক্রিস সিদ্ধান্ত নেন রেগানকে সুস্থ্ করার জন্য তিনি ‘এক্সরসিজম’ করবেন। ঘটনাচক্রে তার সাথে মুখোমুখি হন ফাদার ডেমিয়েন কারাস। রেগানের আধিভৌতিক আচরণে ভয়ার্ত ক্রিসের পাশে এসে দাঁড়ান ফাদার কারাস। এ রহস্যের কুলকিনারা করেই ছাড়বেন তিনি!

বাকি গল্পটা না হয় সিনেমা দেখেই জানবেন। ফাদার মেরিন ফিরে আসবেন জর্জটাউনে, ইরাকে দেখা সেই অপদেবতার মূর্তির বিশেষত্ব উদঘাটিত হবে। রেগানের ভেতরে কে বাস করছে, সেটার জবাবও অপেক্ষা করছে ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ সিনেমায়।

মুক্তির পর সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘দ্য এক্সরসিস্ট’। সিনেমা হলে বসে দর্শক মুহুর্মুহু চিৎকার করেছে রেগানের কার্যকলাপ দেখে। দুটি অস্কার জিতে হরর সিনেমার মর্যাদা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল এই কালজয়ী সৃষ্টি। ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ মূলত উইলিয়াম পিটার ব্লেটি রচিত একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল। লেখক নিজেই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, সেরা চিত্রনাট্য বিভাগে অস্কার ট্রফিটি সে বছর তার ঘরেই যায়। ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ এর সাফল্যে পরবর্তীতে এই সিরিজের বেশ কয়েকটি সিক্যুয়েল নির্মিত হয়, কিন্তু কোনোটিই প্রথম পর্বের সমতুল্য জনপ্রিয়তা পায়নি।

লেখক উইলিয়াম পিটার ব্লেটি; Source: Find a Grave

কিংবদন্তী লেখক হুমায়ূন আহমেদ ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ বইটির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সিনেমার স্বাদ পুরোপুরি পেতে চাইলে বইটিও পড়ে দেখতে পারেন।

সিনেমা: দ্য এক্সরসিস্ট
পরিচালক: উইলিয়াম ফ্রেডকিন
আইএমডিবি রেটিং: ৮.০

ফিচার ইমেজ: Bloody Disgusting

Related Articles

Exit mobile version