রসায়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয়। আর বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক বিক্রিয়া তো একে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। এক রাসায়নিক পদার্থের সাথে আরেক পদার্থের কত রঙিন বিক্রিয়া ঘটে, কখনো দহন হয়, আবার কখনো অসতর্কতার কারণে বিস্ফোরণও হয়। বিক্রিয়ায় যা-ই হোক না কেন, বিক্রিয়া চলাকালীন কিংবা বিক্রিয়া শেষে, বিক্রিয়ক পদার্থের উৎপাদে পরিবর্তন বিস্ময়কর ঠেকে অনেক সময়। সেকেন্ডে সেকেন্ডে রঙের পরিবর্তন কিংবা বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন, সত্যিই বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। চলুন এরকম ১০টি কৌতূহলোদ্দীপক রাসায়নিক বিক্রিয়ার কথা জেনে আসি। পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতিটি বিক্রিয়ার আলোচনায় হাইপারলিংকে সে বিক্রিয়ার একটি ভিডিও লিংক যোগ করা হয়েছে।
থার্মাইট ও বরফের বিক্রিয়া
আমেরিকান টিভি সিরিজ ব্রেকিং ব্যাডের ভক্তরা অবশ্যই থার্মাইটের কথা জানেন। একটি এপিসোডে, মূল চরিত্র ওয়াল্টার হোয়াইট এবং জেসি পিংকম্যান, মেথলিমিন চুরি করতে গিয়ে গুদামের তালা ভাঙার জন্য থার্মাইট ব্যবহার করেছিল। কারণ যেখানে লোহার গলনাঙ্ক ১,৫১০° ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে থার্মাইটের দহন ২,৫০০° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা তৈরি করে। ফলে লোহা সহজেই গলে যায়। তবে থার্মাইট যদি বরফে প্রয়োগ করা হয় তখন কী হবে? একটি অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ হবে! হ্যাঁ, শীতল বরফের সাথে বিস্ফোরক থার্মাইটের বিক্রিয়া কীরূপ বিস্ফোরক হয়, তা দেখতে পারেন এই লিংকে।
ব্রিগস-রসচার ওসিলেটিং বিক্রিয়া
ব্রিগস-রসচার বিক্রিয়াকে অনেক সময় ব্রিগস-রসচার ওসিলেটিং বিক্রিয়াও বলা হয়। কারণ এই বিক্রিয়া চলাকালীন দ্রবণের রঙ বারবার পরিবর্তিত হতে থাকে। তাই নামের সাথে ‘ওসিলেটিং’ (Oscillating) বা দোদুল্যমান শব্দটি যোগ করা হয়। নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক পদার্থ, নিখুঁত পরিমাণে যোগ করে, তিনটি পৃথক পৃথক দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়। এই দ্রবণ তিনটি সম পরিমাণে একই পাত্রে মেশালে দশ মিনিট যাবত বিক্রিয়া চলতে থাকে। এ সময় দ্রবণের রঙ ক্রমাগত স্বচ্ছ থেকে পীতাভ (অ্যাম্বার) এবং পীতাভ থেকে গাঢ় নীল হতে থাকে। বিক্রিয়া শেষ হবার আগেপর্যন্ত রঙ পরিবর্তনের এই জাদু চলতে থাকে।
সুপারফ্লুইড হিলিয়াম
বায়বীয় পদার্থের বৈশিষ্ট্য কী? সাধারণ তাপমাত্রায় এদের অণুগুলোর মধ্যে বেশি দূরত্ব থাকে, যা চাপ বৃদ্ধি এবং তাপমাত্রা কমানোর সাথে সাথে কমে আসে। তাপমাত্রা কমাতে থাকলে বায়বীয় পদার্থ একসময় তরলে পরিণত হয়। তবে বায়বীয় পদার্থের মধ্যে অষ্টম শ্রেণীর মৌলগুলো অর্থাৎ, নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোকে তরলে পরিণত করতে অত্যন্ত কম তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে হিলিয়াম অন্যতম। আদর্শ চাপে -২৬৯° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হিলিয়াম গ্যাস তরলে পরিণত হয়। এই তাপমাত্রায় পৌঁছানোর পর, হিলিয়াম গ্যাস ‘হিলিয়াম-২’ এ পরিণত হয়। তখন একে বলা হয় সুপারফ্লুইড। সুপারফ্লুইড হিলিয়াম এক অদ্ভুত বিস্ময়কর পদার্থ। এই অবস্থায় এর কোনো সান্দ্রতা থাকে না। মহাকর্ষের টানও এর জন্য কোনো বাঁধা হতে পারে না। তরল হিলিয়ামের বিন্দুগুলো তখন কেবল উষ্ণতা খুঁজতে থাকে, আর পাত্রের গাঁ বেয়ে উপরে উঠে যায় অনায়াসে! আর সান্দ্রতা না থাকার কারণে ১০/৮ মিটার বা ১ মিটারের ১ কোটি ভাগের এক ভাগ সমান ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়েও প্রবেশ করতে পারে এই সুপারফ্লুইড!
হট আইস!
প্রিজারভেটিভ হিসেবে সোডিয়াম অ্যাসিটেটের ব্যবহার পরিচিত। তাছাড়া ভিনেগার ও চিপসে ব্যবহার করা হয় স্বাদবর্ধক হিসেবে। তবে এসব ব্যবহারের বাইরে এর একটি অদ্ভুত ব্যবহার আছে, সেটা জানা আছে কি? সোডিয়াম অ্যাসিটেটকে বলা হয় ‘হট আইস’ বা গরম বরফ! গরম বরফের ব্যাপারটা একটু উদ্ভট ঠেকছে, তাই না? ব্যাখ্যা করা যাক। সোডিয়াম অ্যাসিটেটের দ্রবণকে উত্তপ্ত করলে এটি অতি-সম্পৃক্ত (Super Saturated) হয়ে যায়। তখন একে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করলে এটি ‘সুপারকুল’ হয়ে ওঠে!
ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। সোডিয়াম অ্যাসিটেটের গলনাঙ্ক ৫৮° ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তরলে পরিণত হবার পর সোডিয়াম অ্যাসিটেট এর গলনাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায়ও তরলই থাকে। আর তখনই শুরু হয় এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া। যেকোনো বস্তুর সংস্পর্শে আসলে তখন এই তরল সোডিয়াম অ্যাসিটেট স্ফটিকাকার (দানা বাঁধে) ধারণ করে। যেমনটা দেখতে পাচ্ছেন ছবিতে, কোনো বস্তু এর সংস্পর্শে আনলে কিংবা কোনো পৃষ্ঠে ঢাললে এটি কঠিন হয়ে যায়। আর এই ব্যাপারটা ঘটে সম্পূর্ণ কক্ষ তাপমাত্রায়। তাই এক বলা হয় ‘হট আইস’।
ড্যান্সিং গামি বিয়ার বিক্রিয়া
‘পাইরোটেকনিকস’ বা আতশবাজির একটি চমৎকার উদাহরণ এই ড্যান্সিং গামি বিয়ার বিক্রিয়া। পটাসিয়াম ক্লোরেটের মাঝে একটি গামি বিয়ার ছেড়ে দিলেই দুরন্ত গতিতে ‘নাচতে’ শুরু করবে গামি বিয়ারটি! এই ছোটাছুটির পাশাপাশি প্রচুর তাপ উৎপন্ন হবে আর তৈরি হবে বেগুনী বর্ণের আগুন। অবশ্য এখানে গামি বিয়ারের মধ্যে বিশেষ কিছু নেই। পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করে মূলত চিনির উপর। জারক হিসেবে পটাসিয়াম ক্লোরেটের ব্যবহার তো সর্বজনবিদিত। আর এই বিক্রিয়ায় চিনি কাজ করে জ্বালানির মতো। ফলে দুটো একসাথে হলেই শুরু হয়ে যায় তীব্র বিক্রিয়া। তাই গামি বিয়ারের পরিবর্তে যেকোনো চিনিযুক্ত চকলেট বা চুইংগাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
সোডিয়াম-ক্লোরিন বিক্রিয়া
সোডিয়াম এবং ক্লোরিন একত্রে বিক্রিয়া করে উৎপন্ন করে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা সাধারণ খাবার লবণ। এই তীব্র তাপোৎপাদী বিক্রিয়া তাপ উৎপন্ন করার পাশাপাশি ব্যাপক আলো বিকিরণ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সোডিয়াম এবং ক্লোরিন গ্যাস একত্রে রেখে দিলেও খুব একটা তীব্রতা দেখা যায় না। আসল তীব্রতা শুরু হয় পানি ঢালার সাথে সাথে। বিক্রিয়া চলাকালীন উজ্জ্বল হলুদাভ কিরণ দেখতে খুবই সুন্দর।
এলিফ্যান্ট টুথপেস্ট বিক্রিয়া!
এটি মূলত হাইড্রোজেন পারক্সাইডের বিয়োজন বিক্রিয়া। আয়োডিনের আয়ন প্রভাবক হিসেবে উপস্থিত থাকলে এই বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এই বিক্রিয়ায় ব্যাপক পরিমাণে উত্তপ্ত, বাষ্পীয় ফেনা উৎপন্ন হয়। উপরন্তু বিক্রিয়ায় রঙ যোগ করলে ফেনাও রঙিন হয়। রঙিন এই ফেনা দেখতে অবিকল বাহারি রঙের টুথপেস্টের মতো মনে হয়। কিন্তু বিক্রিয়ার নাম কেন এলিফ্যান্ট টুথপেস্ট দেয়া হলো? কারণ এত বড় আকারের পেস্ট কেবল হাতির দাঁতেই প্রয়োজন হতে পারে!
সুপারকুল ওয়াটার
পানি সাধারণত ০° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বরফ হতে শুরু করে। কক্ষ তাপমাত্রায় পানির অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক দূরত্ব কম থাকার ফলে, অণুগুলো মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে। কিন্তু তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে অণুগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে এবং এরা কঠিন পদার্থের মতো জমাটবদ্ধ হতে থাকে। তবে এই জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু করাটা পানির জন্য বেশ কঠিন কাজ। অবিশুদ্ধ পানিতে নানান দূষক পদার্থই পানির ক্রিস্টালাইজেশন বা জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু করতে সহায়তা করে। তাই বিশুদ্ধ পানির ক্ষেত্রে, কোনো প্রকার বাড়তি দূষকের অনুপস্থিতিতে অণুগুলো সহজে জমাট বাঁধতে পারে না। তখন পানি ঠান্ডা করলে তা ‘সুপারকুল’ হয়। অর্থাৎ পানি হিমাঙ্কের নিচেও বরফে পরিণত হয় না। কারণ জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য কোনো দূষক বা প্রভাবক পানিতে থাকে না। এরকম সুপারকুল এক বোতল পানি হাতে নিয়ে জোরে ঝাঁকুনি দিন, দেখবেন চোখের সামনে পুরো বোতলের পানি বরফে পরিণত হবে! অথবা ধীরে ধীরে কোনো বাটিতে ঢালতে থাকুন। দেখবেন পানি বোতল থেকে বাটিতে পড়ছে, আর বরফে পরিণত হচ্ছে।
সুগার স্নেক
‘সুগার স্নেক’ বা ‘চিনির সাপ’ তৈরির বিক্রিয়াটি, অবস্থার পরিবর্তনের একটি বিস্ময়কর উদাহরণ। চিনি বা সুক্রোজকে আগুনে পোড়ালে তা কালো হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুধু কালো না হয়ে যদি কালো সাপ হয়ে যায়, তাহলে ভয় পাবেন না তো? একটি বিকার বা গ্লাসে অল্প পরিমাণ চিনি নিয়ে, তার উপর সালফিউরিক অ্যাসিড ঢেলে দিলেই অ্যাসিড ও সুক্রোজের মধ্যে তীব্র বিক্রিয়া শুরু হয়। চিনি পোড়ার গন্ধের পাশাপাশি এই বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় প্রচুর পরিমাণে কার্বন আর ঘন কালো বাষ্প। এই বাষ্প বিকার বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, ঠিক একটি মোটা সাপের মতো! এই মজার বিক্রিয়াটি ঘরে বসেও করা যেতে পারে। তবে নিরাপত্তার জন্য সালফিউরিক অ্যাসিডের পরিবর্তে বেকিং সোডা ব্যবহার করতে হবে। সালফিউরিক অ্যাসিড ও বেকিং সোডার মিশ্রণে সামান্য অ্যালকোহল ঢেলে, তাতে আগুন ধরিয়ে দিন আর মিশ্রণ থেকে সাপ বেরিয়ে আসার দৃশ্য উপভোগ করুন।
সুপার অ্যাবজরভেন্ট পলিমার
রসায়নকে অনেকে জাদু বলে অভিহিত করেন। বিচিত্র সব রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখার পর, দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ কমই থাকে। রসায়ন আসলেই তো জাদু। আর এই জাদুর আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে সোডিয়াম পলিঅ্যাক্রিলেট বা সুপার অ্যাবজরবেন্ট পলিমার। এই পলিমার নিজের আয়তনের তিন গুণের অধিক পানি শোষণ করে নিতে সক্ষম! বাচ্চাদের ডায়াপার ও ন্যাপকিন তৈরিতে, শোষক হিসেবে এই পলিমার ব্যবহার করা হয়। এই পলিমারের এমন বিস্ময়কর শোষণ ক্ষমতার জন্য একে ‘হাইড্রোজেল’ও বলা হয়। একটি পাত্রে হাইড্রোজেল রেখে তাতে পানি ঢেলে দিন। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হাইড্রোজেল সব পানি শোষণ করে নেবে এবং জমাট বেঁধে যাবে! আবার এই জমাট বাঁধা হাইড্রোজেলের সাথে লবণ মিশিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করুন, আপনার বিস্ময় আরো বাড়িয়ে তা পুনরায় তরল পানিতে পরিণত হবে!
ফিচার ছবি: Pond5