প্রযুক্তির উন্নতির ফলে গত কয়েক দশকে ন্যানো ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। আসলে ন্যানো ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করলে অনেকদিক দিয়েই সুবিধা। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে যেকোনো সমস্যার একদম শেকড় পর্যন্ত সমাধান করা সম্ভব। গত দশ বছরে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যবহার অনস্বীকার্য। বিশেষ করে আধুনিক কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক তৈরিতে কৃষিবিদরা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। একইসাথে কৃষিক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির সফলতা প্রমাণ করতে পেরেছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন ফসলের রোগবালাই দূর করা। কিন্তু ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হতো, সেগুলো পরিবেশবান্ধব ছিল না। কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করলে সেই জমিতে এবং জমির আশেপাশের জলাভূমিতে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেত, যার ফলে পানি দূষণ বেড়ে যেত। তাছাড়া তখন জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণও তুলনামূলক বেশি ছিল। বিজ্ঞানীদের এমন কিছু আবিষ্কার করতে হতো, যেটি কম করে ব্যবহার করা হবে কিন্তু ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। সেই লক্ষ্যে তারা ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে যান। যেহেতু কীটনাশক বিষ ছাড়া আর কিছু নয়, তাই পরিমাণের দিক দিয়ে এর ব্যবহার কমিয়ে ফসলের রোগজীবাণু যেন কমানো যায়, অন্যদিকে ফসলের উৎপাদন হারও যেন বাড়ানো যায় সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য।
ফসলের বৃদ্ধির জন্য ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুষ্টিকর পদার্থ তৈরি করা হয়। কিন্তু এসব পদার্থ যখন একটি চাষকৃত জমিতে প্রয়োগ করা হয় এবং এগুলোর পাস্তুরাইজেশন করা হয়, তখন তা থেকে উপকার পাওয়ার সাথে সাথে এদের খারাপ দিকও প্রকাশ পায়। যেমন- ফসলের আধুনিক প্রযুক্তির কীটনাশক এবং অন্যান্য ফসল উপযোগী ন্যানো পদার্থ ব্যবহার করলে আশেপাশের অঞ্চলের লেক কিংবা পুকুরে বিষাক্ত শৈবালের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। অন্তত নতুন গবেষণা তা-ই বলছে।
জুন মাসের ২৫ তারিখে Ecological Applications নামক একটি জার্নালে এই ব্যাপারে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। প্রবন্ধটির শিরোনাম হচ্ছে- Engineered nanoparticles interact with nutrients to intensify eutrophication in a wetland ecosystem experiment। সেখানে বলা হয়েছে যে বর্তমানে যেসব শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ আছে, সেগুলো দিয়ে খুব দক্ষতার সাথে নতুন নতুন ন্যানো পদার্থ তৈরি করা সম্ভব। এমনকি যেসব ১০০ ন্যানোমিটার থেকেও সূক্ষ্ম কৃষি উপযোগী পদার্থ তৈরি করা যাচ্ছে এবং শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে সেগুলোর উপর কাজও করা যাচ্ছে। শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে কাজ করতে পারার মূল সুবিধা হচ্ছে ন্যানো স্কেলেও বিজ্ঞানীরা খুব সহজেই অনেক বেশি পৃষ্ঠ ক্ষেত্রফল পেয়ে যায়, যে কারণে নতুন নতুন রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে হলে আণবিক স্কেলে যে স্বাধীনতা এবং প্রয়োগ ক্ষমতার প্রয়োজন, সেটা খুব সহজেই পাওয়া যায়।
তাই নতুন এই গবেষণাতে সূক্ষ্ম আণবিক স্কেলে যখন বিজ্ঞানীরা কীটনাশক তৈরিতে কাজ করছিলেন, তখন তারা ফসল বৃদ্ধির জন্য নতুন বৈশিষ্ট্যের পদার্থ তৈরি করেছিলেন যেটা কৃষি জমিতে নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা যাবে। কিন্তু এত সূক্ষ্ম স্কেলে কাজ করার সময় তারা বুঝতে পারেন যে, সেখানে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে যে বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে তার পাশাপাশি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আরও কিছু বিক্রিয়া হচ্ছে যেগুলো ফসলের জন্য ক্ষতিকারক না হলেও আশেপাশের অঞ্চলের পানির সাথে যদি তা মিশে যায়, তাহলে সেখানে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে ফেলতে পারে– এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে এমনটাই বলছেন এই প্রবন্ধের গবেষক মেরি সিমনিন এবং ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রফেসর এমিলি বার্নহার্ট।
কৃষিকাজে ব্যবহার করার জন্য যে বিভিন্ন ন্যানোপদার্থ তৈরি করা হয়েছে, সেখানে বর্তমানে কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া খুব সূক্ষ্ম আকারের সিলভার, টাইটানিয়াম-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য আরও কিছু পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।
ন্যানোপ্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে যেকোনো বাণিজ্যিক পণ্য খুব দ্রুত তৈরি করা যাচ্ছে, নিজে থেকেই নিজেকে পরিষ্কার করে ফেলতে পারে এমন ফেব্রিক তৈরি করা যাচ্ছে, হালকা ওজনের ইলেক্ট্রনিকস পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে। তাই সব ক্ষেত্রেই ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া ন্যানোপদার্থ ব্যবহার করে কোনো পণ্য তৈরি করলে সেখান থেকে উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। সেকারণে দ্রুত বাজারজাত করতে পারলেই পণ্যগুলো খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, সে কারণে দিন দিন চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আশংকার কথা হচ্ছে পরিবেশের উপর এই প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে খুব বেশি এখনও পর্যন্ত জানা নেই। তাই এই বিষয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ রয়েছে।
কিছু পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ব্যাপারটি আরও বিশদভাবে বোঝা যাবে। যেমন- প্রতি বছর সারা বিশ্বে ২৬০০০০ থেকে ৩০৯০০০ মেট্রিক টন ন্যানোপদার্থ নির্মিত পণ্য তৈরি হয়, যার বেশিরভাগ ব্যবহার করার পরে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে ল্যান্ডফিল্ডগুলোতে ফেলে দেয়া হয়। সেখান থেকে প্রায় ৮০৪০০ মেট্রিক টন বর্জ্য মাটির সাথে মিশে যায় এবং ২৯২০০ মেট্রিক টন বর্জ্য পুকুর, লেক ইত্যাদি প্রাকৃতিক পানি ধারণকৃত জায়গাতে গিয়ে মিশে যায়। এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র ন্যানোপদার্থ নির্মিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এসব পণ্য শুধুই পানির সাথে মিশে থাকে না, বরং সেখানে অনেকগুলো বিক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে যায়। বিশেষ করে পানির উপরে শ্যাওলার আবরণ তৈরি করে ফেলে, যা পানিতে বসবাসরত প্রাণী এবং উদ্ভিদের জন্য বিপজ্জনক। পানিতে শ্যাওলার উপস্থিতি আগেও দেখা গিয়েছে, কিন্তু কৃষিকাজে অতিরিক্ত ন্যানো নির্ভর কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এর পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। পানিতে নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের উপস্থিতি এই শ্যাওলার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে একদিক দিয়েই ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা কীটনাশক এবং অন্যদিকে উদ্ভিদের জন্য ন্যানো প্রযুক্তি নির্ভর পুষ্টিকর উপাদান দুই মিলে আশেপাশের পানিতে দূষণ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করার মূল উদ্দেশ্য ছিল দূষণ কমানো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, জলজ জীব সেখানে থাকতে পারছে না এবং শ্যাওলার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি সমাধানে আসা গেলেও প্রত্যেকটি সমাধানের পাশাপাশি একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। কৃষিকাজে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও সেটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা নতুন ধরণের পানি দূষণের মুখোমুখি হচ্ছি, যা মোটেও কাম্য নয়।
ফিচার ইমেজ সোর্স- cserc.org