সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী সার্বজনীন এক ক্যানসার টেস্ট আবিষ্কার করেছেন। এই টেস্টটি করতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট! শরীরের ঠিক কোথায় ক্যানসার হয়েছে এবং এটি কতটা গুরুতর- এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে না পারলেও ক্যানসার হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বেশ নিখুঁতভাবেই তথ্য দিতে পারে এই টেস্ট।
ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ডের গবেষক লরা ক্যারাস্কোসা জানিয়েছেন, “এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এটি অত্যন্ত সুলভমূল্যের এবং প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ। তাই যেকোনো ক্লিনিকেই এই টেস্ট করানোর ব্যবস্থা রাখা সম্ভব।”
পুরো ব্যাপারটির গুরুত্ব বোঝার জন্য আগে কিছু জিনিস সম্পর্কে একটু জানা থাকা প্রয়োজন। ক্যানসার আছে কি না এবং সেটি কী ধরনের ক্যানসার, এটি বোঝার জন্য প্রথমে বায়োপসি করে রোগীর দেহ থেকে নমুনা কোষ সংগ্রহ করে ডিএনএ সিকুয়েন্সিং করতে হয়। পুরো পদ্ধতিটি অনেক জটিল, অসম্ভব ব্যয়বহুল এবং বেশ সময়সাপেক্ষ। এসব কারণে সব হাসপাতালে ক্যানসার শনাক্ত করারও কোনো উপায় ছিল না। নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশগুলোর হাসপাতাল, দেশের মানুষের গড় আয় ইত্যাদির কথা ভাবলেই ব্যাপারটির গুরুত্ব বেশ বোঝা যাবে।
নতুন আবিষ্কৃত এই টেস্টের সফলতার হার ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জন রোগীর ৯০ জনের ক্ষেত্রে এই টেস্ট সফলভাবে ফলাফল জানাতে পারে। কাজেই, পরবর্তীতে ব্যয়বহুল টেস্টগুলো আর করানোর প্রয়োজন আছে কি না, এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এটি অনেক সহায়ক হবে।
কীভাবে কাজ করে
টেস্টটিতে রং পরিবর্তন করতে পারে, এমন এক ধরনের তরল ব্যবহার করা হয়। দেহের যেকোনো জায়গায় ক্যানসারে আক্রান্ত কোনো কোষ থাকলে এটি শনাক্ত করতে পারবে এবং রং পরিবর্তন করে ১০ মিনিটের মাঝেই এ ব্যাপারে জানান দেবে।
কিন্তু সব ধরনের ক্যানসার এক না এবং এরা মানবদেহকে একভাবে আক্রান্ত করে না। একেক ক্যানসার একেকভাবে কাজ করে। সেজন্য, এ ধরনের একটি টেস্ট ডেভেলপ করার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল এমন সাধারণ কোনো চিহ্ন খুঁজে বের করা, যেটি সব ক্যানসারের ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গবেষক দল দেখলো, সাধারণ ডিএনএ এবং ক্যানসার আক্রান্ত ডিএনএ ধাতব পৃষ্ঠতলের উপরে ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখায়। এবং এই বৈশিষ্ট্য বেশ প্রকটভাবে বোঝা যায়। সাধারণ স্বাস্থ্যবান কোষ যে ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তাদের মাঝে থাকা ডিএনএ দিয়ে একধরনের প্যাটার্ন তৈরি করে, যাতে মিথাইল গ্রুপের স্পষ্ট উপস্থিতি থাকে। ক্যানসার আক্রান্ত কোষে এই প্যাটার্ন বিঘ্নিত হয়। দেখা যায়, সাধারণ কোষের মাঝের ডিএনএ-তে থাকা মিথাইল গ্রুপের জন্য পুরো কোষ জুড়ে বিন্দু বিন্দু এক ধরনের প্যাটার্ন তৈরি হয়। কিন্তু যেসব কোষের ডিএনএ-তে ক্যানসার হয়েছে, এসব কোষের কেবল সামান্য কিছু অংশে এরকম প্যাটার্ন দেখা যায় এবং বেশিরভাগ অংশ জুড়ে কিছুই দেখা যায় না। বিজ্ঞানীরা এই বৈশিষ্ট্যটিকে ফিল্টার হিসেবে ব্যবহার করলেন।
এর একটি ভাল উদাহরণ হতে পারে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় ব্যবহৃত শব্দের নয়েজ কন্ট্রোলিং। এ পদ্ধতিতে ফিল্টার সার্কিট ব্যবহার করে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দগুলো নয়েজ বা অপ্রয়োজনীয় গোলমেলে শব্দ, সেসব শব্দকে ছেঁকে বাদ দিয়ে শুধু প্রয়োজনীয় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দগুলো শোনার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে পৃথিবীর এক মাথায় দাঁড়িয়ে কথা বললেও আরেক মাথায় কানে ফোন ধরে রাখা মানুষটি সবকিছু মোটামুটি স্পষ্ট শুনতে পারে। তেমনভাবে সাধারণ কোষগুলোকে মিথাইল গ্রুপের এই প্যাটার্ন তৈরির বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ছেঁকে ফেললে এই প্যাটার্ন বা গঠণ নেই- এমন কোনো কোষ থাকলে কেবল তাদের অস্তিত্বই চিহ্নিত করা সম্ভব।
স্তন, প্রস্টেট, কোলোরেক্টাল ক্যানসার এবং লিম্ফোমা ক্যানসার- সবই এদিক থেকে একইরকম আচরণ করে। শুধু তা-ই নয়, গবেষণা থেকে দেখা গেছে, এই প্যাটার্নের ভিন্নতা ডিএনএ’র রসায়নের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। ফলে সাধারণ ডিএনএ এবং ক্যানসার আক্রান্ত ডিএনএ পানিতে ভিন্নরকম আচরণ করে।
এই ব্যাপারটি নিয়ে বেশ অনেকভাবে পরীক্ষানিরীক্ষার পরে গবেষকরা দারুণ এক জিনিস দেখতে পেলেন। স্বর্ণের ন্যানোপার্টিকেল মেশালে পানি গোলাপী হয়ে যায়। এ পানিতে পরীক্ষণীয় ডিএনএ মেশালে সেটি ক্যানসার আক্রান্ত কি না- এর উপরে ভিত্তি করে সেটি ন্যানোপার্টিকেলের সাথে এমনভাবে বিক্রিয়া করে যে, পানির রং পুরোপুরি বদলে যায়। পরীক্ষণীয় ডিএনএ ক্যানসার আক্রান্ত হলে তরলটি আবার তার আগের রঙে ফিরে যায়। কিন্তু পরীক্ষণীয় ডিএনএটি ক্যানসার আক্রান্ত না হলে তরলের রং হয়ে যায় নীল।
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বিজ্ঞানী ম্যাট ট্রাউয়ের নেতৃত্বে ২০০ ক্যানসার আক্রান্ত মানব ডিএনএ’র নমুনা এবং সুস্থ ডিএনএ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন। ট্রাউ জানিয়েছেন, এ পরীক্ষা থেকে সব ক্যানসারই ১০০ ভাগ সফলতার সাথে নির্ণয় করা যাবে কি না, সেটি যদিও এখনো বলা যাচ্ছে না, তবে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে, তা বেশ আশাব্যঞ্জক। তাছাড়া, এ পরীক্ষা ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের মতো জটিল বা ব্যয়বহুল না, কাজেই কারো ক্যানসার হয়েছে কি না- এ ব্যাপারে সহজেই নিশ্চিত হয়ে নিয়ে পরবর্তী করণীয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
আবু আলী ইবনে সিনা
পুরো ব্যাপারটি অবশ্যই সবার জন্য বেশ আনন্দের। তবে, সেই আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছেন ড. আবু আলী ইবনে সিনা। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই বিজ্ঞানী Development of point of care technology for the detection of cancer biomarkers নামের ১০ মিনিটে ক্যানসার শনাক্তকরণ প্রজেক্টের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। পিএইচডি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ ফেলো হিসেবে হিসেবে কাজ করছেন।
পরবর্তী ধাপ
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এ নিয়ে ক্লিনিক্যাল স্টাডি করা হবে। পরীক্ষা করে দেখা হবে, ঠিক কতটা আর্লি স্টেজের ক্যানসার এ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব এবং চিকিৎসাধীন রোগীদের ক্ষেত্রে ক্যানসার চিকিৎসার কার্যকারিতা কতটুকু হচ্ছে, এ পরীক্ষার মাধ্যমে সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় কি না।
যদিও খালি চোখে এত সহজে ক্যানসার শনাক্ত করাটা ক্যানসারের চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে দেবে, তবু গবেষকরা মনে করছেন, এখনও পুরো ব্যাপারটিতে উন্নতির অনেক জায়গা আছে। হয়তো এর সাথে সাথে আরো কিছু সাধারণ পরীক্ষা করেই ভবিষ্যতে বলে দেয়া যাবে, রোগীর দেহে ক্যানসার থাকলে সেটি কী ধরনের এবং এখন কোন পর্যায় চলছে। এ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। কাজেই, প্রক্রিয়াটি আসলে ঠিক কতটা কাজে আসবে, এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।