ভারতবর্ষের বুক থেকে জন্ম নেওয়া বৌদ্ধ দর্শন পরিচিত পৃথিবীর অন্যতম নৈরাশ্যবাদী দর্শন হিসেবে। গৌতম বুদ্ধের মতে মানুষের নিয়তিতে দুঃখ অনিবার্য, যতক্ষণ মানব সত্ত্বা থাকবে ততক্ষণ দুঃখের অস্তিত্ব থাকবে। জীবনচক্র ধরে চলতে থাকবে দুঃখের যাত্রা, এখান থেকে মুক্তির উপায় হলো নির্বাণ লাভ করা। কেউ এই নির্বাণ লাভকে বুঝিয়েছেন সত্ত্বার অবলুপ্তি হিসেবে, এই নির্বাণ লাভে অনুসরণের কথা বলা হয়েছে মধ্যপন্থা। এই মধ্যপন্থায় রয়েছে অষ্টমার্গ বা আটটি প্রধান শিক্ষার কথা। যার মাধ্যমে এই বেদনাবিধুর জীবনচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এই আটটি প্রধান শিক্ষার মাঝে একটি হলো মনোনিবেশ করা, অর্থাৎ ধর্মের কাজে নিজের মনকে নিবিষ্ট করা। তাই অনেকটা প্রত্যাশিত ভাবেই বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা যেদিকেই ছড়িয়েছে সেখানেই ধ্যানচর্চার ধারণা বিকশিত হয়েছে নিজের মতো করে।
ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা, তিব্বত, চীন, জাপান সহ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কঠোর সাধনা আর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা লোখমুখে প্রচলিত হচ্ছে। তিব্ববতের বৌদ্ধ লামাদের ব্যাপারে প্রচলিত আছে তারা উড়ে বেড়াতে পারেন। আবার কোথাও লামা এবং ভিক্ষুরা মাসের পর মাস অল্প খাবার খেয়ে দীর্ঘ সাধনা করেন, সাধনারত অবস্থায় মৃত্যুর কথাও শোনা যায়। বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকের মাঝে প্রচলিত আছে একটি ধারা যেখানে সাধনারত অবস্থায় তারা নিজেকে মমিতে পরিণত করেন, মমিতে পরিণত হয়ে যাওয়া সাধককে মূর্তিতে সংরক্ষণ করে বৌদ্ধবহারগুলোতে রাখা হয়। সাধকের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বলে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাদের কাছে আসেন নিজেদের সমস্যা নিয়ে। বিশেষ করে চীনের বৌদ্ধবিহারগুলোতে তান্ত্রিকদের ওষুধবিদ্যার সুখ্যাতি ছিল পুরো মধ্যযুগ জুড়েই।
তবে এই মমিগুলো পরম পূজনীয় বলে এদের নিয়ে গবেষণার সুযোগ ছিল না তিব্বত, চীন কিংবা জাপানে। কিন্তু এই রহস্যময়তার আবছা বিবরণে কৌতূহল বেড়েছে পশ্চিমে। তবে পশ্চিমে সরাসরি এমন মমি না পাওয়া যাওয়ায় গবেষণার সুযোগও হয়নি। ঘটনাক্রমে চীনের ফুজিয়ান রাজ্য থেকে ১৯৯৫ সালে এমনই একটি বৌদ্ধমূর্তি চুরি যায়।
ঘটনাক্রমে হংকং থেকে এক ডাচ সংগ্রাহক একই বছর দুর্লভ ঠিক এমনই একটি বৌদ্ধমূর্তি সংগ্রহ করেন। দীর্ঘদিন এটি তার কাছেই ছিল। হাঙ্গেরির একটি প্রদর্শনীতে মূর্তিটিকে নিয়ে আসার পর এটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এর ধরন, পোশাক খোদাই করা নকশা দেখে অনেক গবেষক ধারণা করেন এটি শুধুই মূর্তি নয়। এর ভেতরে থাকতে পারে কোনো সাধকের মমি। দীর্ঘদিন পরে এই মূর্তি নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হয় নেদারল্যান্ডে। একপর্যায়ে সিটি স্ক্যান করে দেখা যায়, এটি শুধু একটি সাধারণ ধাতব মূর্তি নয়, দুর্লভ বোধিসত্ত্ব মূর্তি যার ভেতরে আসলেই মমির অস্তিত্ব আছে।
গবেষণার শুরু
রেডিওকার্বন প্রক্রিয়ায় এই মমির বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। দেখা গেছে মূর্তির ভেতরে থাকা এই বৌদ্ধ সাধক ১০২২ থেকে ১১৫৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই গবেষকরা বলছেন এই সাধক চীনের ‘সং সাম্রাজ্য’ চলাকালীন বেঁচে ছিলেন। সং ডাইনেস্টির সময়কালটি চীনের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে পরিচিত অস্থিরতার সময় হিসেবে। নতুন নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে চীনের আকার বাড়ছে, নতুন এলাকা দখলে আসছে। চীনের স্থানীয় দর্শন তাওইজম এবং কনফুসিয়াজমের দর্শনের প্রভাবও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চীনের ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতি নতুন এক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তখন।
বৌদ্ধ দর্শনের সাথে এই দর্শনের সংঘাতও শুরু হয়েছিল সং সাম্রাজ্যের সময়কালেই। দীর্ঘদিন যাবৎ বৌদ্ধ দর্শনকে বহিরাগত দর্শন হিসেবে দেখার একটি প্রয়াস ছিল চীনে, তবে বৌদ্ধ দর্শনও এ সময়ে নিজের প্রয়োজনে নিজেকে অনেক বেশি আধ্যাত্মিকতা চর্চার দিকে নিয়ে যায়। গবেষকদের ধারণা, যে বৌদ্ধ সাধকের মমি পাওয়া গেছে তাকে ‘লিউ কুয়ান’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এবং ধারণা করা হয়ে থাকে এই সাধক ‘চা’আন স্কুল অফ মেডিটেশন’ এর সাথে যুক্ত ছিলেন।
এই বৌদ্ধ সাধকের কাপড় চোপড় থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন গবেষকরা। তার কাপড়ের দুইটি স্তর বিদ্যমান, উপরে সোনালী রঙের ড্রাগন আর ফুলের নকশাখচিত আবরণ। এটি থেকে গবেষকরা ধারণা করেছেন তিনি সাধকের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি ছিলেন। নীচের স্তরে ছিল সাধারণ সাধকের মতোই পোশাক।
একটি আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই সাধকের অভ্যন্তরীণ কিছু অঙ্গ সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এবং সেখানে রাখা আছে প্রাচীন চীনা ভাষায় লেখা কিছু স্ক্রোল। ধারণা করা হচ্ছে এই সমস্ত স্ক্রোলে লেখা আছে বৌদ্ধ মন্ত্র, এখনো সেই লেখার পাঠ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
নিজেকে নিজে মমি করে ফেলা
লেখার শুরুটাই হয়েছিল বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের অনিবার্যতা নিয়ে। বৌদ্ধ সাধু, ভিক্ষু কিংবা লামারা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে খুবই সল্পাহারী, খাদ্যের লালসা ত্যাগ করা মূলত খুবই প্রাথমিক একটি পর্যায়। তাই নিয়মিত শরীরচর্চা, ধ্যানের পাশাপাশি দিনের পর দিন উপবাস থাকার চর্চাও আছে এই সাধকদের মাঝে। আধ্যাত্মিক গুরু লিউ কুয়ান চীনের ফুজিয়ান রাজ্যের ইয়াংচুন গ্রামের মানুষদের মাঝে চিকিৎসার সেবার জন্য পরিচিত ছিলেন। তবে বর্তমান গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে বড়জোর ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন এই সাধক।
নিজেকে কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে মমি করার বেদনাদায়ক এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে সেই ব্যাপারে ১৯৬০ সালে জাপানের নিগাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়েছিল। জাপানের ইয়ামাগাতা অঞ্চলে এ ধরনের কিছু মমির উপর গবেষণা করেছিলেন মাতসুমোতো আকিরা। কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে, খাদ্য কমিয়ে এনে, চলাফেরা সীমিত করে একজন সাধক মমি হওয়ার পথে অগ্রসর হন, এই প্রকিয়াকে বলা হয় সকুশিনবুতসু (Sokushinbutsu)। দীর্ঘ এই সাধনার শুরুতেই খাদ্যতালিকা থেকে সব ধরনের দানা জাতীয় জিনিস যেমন চাল, গম, সয়াবিন, ডাল এসব বাদ দেওয়া হয়। খেতে হবে বাদাম, গাছের শিকড়, পাইনের কাঁটা ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এই খাদ্যতালিকায়ও কাটছাঁট করা হয়, পানীয় হিসাবে শুধু পানি এবং ভেষজ উপাদান দিয়ে তৈরি চা।
এর পরের ধাপে লোকচক্ষুর আড়ালে একটি কোঠরে প্রবেশ করে দীর্ঘ ধ্যানের শুরু হয়। এই কোঠরের শুধুমাত্র একটি ছোট ছিদ্র দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে। সেখান থেকে তার সূত্রপাঠের আওয়াজ এবং ঘন্টার শব্দের মাঝে বোঝা যাবে তিনি জীবিত আছেন। খাদ্য আর পানীয়ও খুব সীমিত হয়ে আসবে। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে মৃত্যু, ঘণ্টা আর সূত্রপাঠের শব্দ কমে আসলে তার ঐ ছোট ছিদ্রটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর তিন বছর অপেক্ষা করা হয়, তিন বছর পরে তার মমিটিকে অন্য কোথাও সংরক্ষণ করা হয়।
লিউ কুয়ানের মমিটিও প্রায় একইরকম ঘটনার মাঝে দিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস গবেষকদের। তবে আরেকদল মতামত দিচ্ছেন যেহেতু তার অভ্যন্তরীণ কিছু অঙ্গ নেই, এবং সেখানে সূত্র লিখিত কাগজ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তিনি হয়তো অন্য প্রক্রিয়ার মাঝে দিয়েও মমিকৃত হয়ে থাকতে পারেন। তবে তিনি যে উচ্চ পর্যায়ের সাধক ছিলেন এবং মমি হবার আগে চরম কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
চীন-নেদারল্যান্ড দ্বন্দ্ব
মূর্তিতে থাকা মমিটিকে প্রদর্শন করার পর চীনের ফুজিয়ান রাজ্যের লোকজন দাবি তুলেছেন মমিটি তাদের। সেখানে থাকা অনেকেই দাবি করেছেন ১৯৯৫ সালে চুরি যাওয়া মমিটি হাতবদল হয়ে ডাচ সংগ্রাহকের হাতে এসে পৌঁছেছে। নাম ও পরিচয় গোপন রাখতে আগ্রহী ডাচ সংগ্রাহক জানিয়েছেন এই মূর্তিটি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন হংকং থেকে। তবে তার উত্তর খুব একটা সন্তোষজনক নয়।
বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন নিয়ে ডাচ অনেক গবেষকের মতামত, এই মূর্তিটি যেহেতু মানবদেহের অংশ বহন করছে তাই এটিকে জাদুঘর বা প্রদর্শনীতে না দিয়ে বরং ফুজিয়ান প্রদেশে যেখানে ঐ মূর্তিটি থাকার কথা সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। ফুজিয়ান প্রদেশের মানুষও এই মূর্তিকে তাদের ‘যুসি’ হিসেবে আরাধনা করে থাকেন, যা চীনা ভাষায় পূর্বপুরুষ এবং ধর্মগুরু দুটি বুঝাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে।
চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের লোকজন ডাচ প্রধানমন্ত্রীর কাছে মূর্তি ফেরত চেয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। তবে সৌজন্যতা, কূটনৈতিক আলাপ কিংবা আইনি লড়াই কোনোটাতেই সুরাহা হয়নি, চীনে গিয়ে এখনো পৌঁছায়নি। লিউ কুয়ানের মমিটি এখনো নেদারল্যান্ডের ড্রেন্টস জাদুঘরেই সংরক্ষিত আছে।