১৯৯৬ সাল। আজ থেকে ২২ বছর আগে সুইজারল্যান্ডের অণুজীববিজ্ঞানীরা বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেলেন, জুরিখ লেকে ব্যাকটেরিয়ার একটি প্রজাতি প্রাকৃতিকভাবে গ্যাসোলিনের অন্যতম উপাদান টলুইন উৎপাদন করে চলেছে। সম্প্রতি গবেষকরা এই প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত কলাকৌশল ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়া কেন টলুইন উৎপাদনের প্রতি ধাবিত হয়?
জয়েন্ট বায়ো-এনার্জি ইন্সটিটিউট (Joint BioEnergy Institute) এর এনভায়রনমেন্টাল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট হ্যারি বেলারের মতে, বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য Tolumonas auensis টলুইন তৈরির পদ্ধতি বেছে নেয়। আম্লিক পরিবেশে টলুইন তৈরির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া তার নিজের pH নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। টলুইন তৈরির প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে প্রোটন শোষিত হয়। প্রোটনের আধিক্যের ফলে ব্যাকটেরিয়ার নিজস্ব pH বেড়ে যায়। এভাবে পয়ঃবর্জ্য অথবা জলাশয়ের গভীরে অক্সিজেনশূন্য পরিবেশে জমে থাকা পললের মতো আম্লিক পরিবেশে টিকে থাকা ব্যাকটেরিয়ার জন্য সহজতর হয়।
টলুইন মূলত অকটেনের বুস্টার হিসেবে কাজ করে থাকে। জ্বালানীর মূল উৎস ভূগর্ভস্থ পেট্রোলিয়ামের লাগামহীন ব্যবহারের ফলে বিশ্ব এখন জ্বালানী সংকটে। জ্বালানীর উৎস হিসেবে ব্যাকটেরিয়া কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম, তা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইন যখন জ্বালানীর উৎস
গবেষকরা E. coli ব্যাকটেরিয়ার একটি নতুন স্ট্রেইন তৈরি করেছেন যেটি শর্করাকে তেলে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তেলের গুণগত মান, প্রচলিত ডিজেলের কাছাকাছি। ইউনিভার্সিটি অভ এক্সটারের অধ্যাপক জন লাভ এই বিষয়ে বলেন,
বাজারে প্রচলিত ধারণার মতো সাময়িক বিকল্প না খুঁজে আমরা বরং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথে এগোচ্ছি, যার ফলে গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং ভোক্তাগণ বাহ্যত কোনো পার্থ্যক্য খুঁজে পাবেন না।
গুণগত মানের বিষয়ে অধ্যাপক লাভ বলেন,
গাড়ির ইঞ্জিনের জন্য যে হাইড্রোকার্বনটি জ্বালানী হিসেবে সচরাচর ব্যবহার করা হয়ে থাকে তার সাথে প্রাপ্ত নতুন জ্বালানীর মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। দু’টিই সমভাবে ইঞ্জিনের জন্য উপযুক্ত এবং আণবিক গঠনেও তারা একই চেইন লেন্থের। মজা করে আমরা একে বলে থাকি বায়ো-ফসিল-ফুয়েল।
বিশেষায়িত ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেইনটি সাধারণত শর্করা বা চিনি জাতীয় বস্তুকে বিক্রিয়ক হিসেবে নিয়ে চর্বিতে পরিণত করে। গবেষকরা ব্যাকটেরিয়া কোষের অভ্যন্তরীণ কলাকৌশল পরিবর্তন করে দেওয়ার ফলে চিনির বদলে এখন সুনির্দিষ্টভাবে জ্বালানী তেলই পাওয়া যাবে। জিনগত পরিবর্তন সাধন করার মাধ্যমে অণুজীব এখন জ্বালানী তেলের কোষাগারে পরিণত হয়েছে। তবে জ্বালানী তেলের চাহিদা যতটা উত্তরোত্তর হারে বেড়েই চলেছে সেই তুলনায় ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক উৎপাদিত জ্বালানীর পরিমাণ সন্তোষজনক নয়। অধ্যাপক লাভ ও তার দল ১০০ লিটার ব্যাকটেরিয়া থেকে মাত্র ১ চা চামচ জ্বালানী তেল উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন!
আগামী দিনগুলোতে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদনমুখিতা বৃদ্ধি করা। জৈব জ্বালানীর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হিসেবে ভাবা হচ্ছে, এর কার্বন নিরপেক্ষতাকে। পরিবেশ দূষণে পেট্রোল বা ডিজেলের মতো বহুল ব্যবহৃত জ্বালানীর দহনে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসৃত হচ্ছে। এতে অত্যধিক পরিমাণ গ্যাস শোষণ করার জন্য পর্যাপ্ত বনভূমি বর্তমানে পৃথিবীতে নেই। অন্যদিকে অণুজীব থেকে প্রাপ্ত জ্বালানী কার্বন নিরপেক্ষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কারণ এদের দহনের ফলে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ গাছপালা কর্তৃক শোষিত হওয়ার মতো সীমায় থাকবে।
জৈব জ্বালানী হিসেবে বিভিন্ন পদার্থের ব্যবহার
বায়োডিজেল
বায়োডিজেল উৎপাদনের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যেমন মাইক্রোপ্রসেসিং, ব্যাচ প্রোসেসিং, সুপার ক্রিটিকাল প্রসেসিং ইত্যাদি। কর্মপদ্ধতি ভিন্ন হলেও প্রতিটির ক্ষেত্রেই মূলত ট্রাইগ্লিসারাইডসের ট্রান্সএস্টারিফিকেশন করা হয়ে থাকে।
উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে খুব সহজলভ্য একটি জৈব অণু হলো ট্রাইগ্লিসারাইড যেটি কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সহযোগে গঠিত হয়। ট্রাইগ্লিসারাইড অণুর দুইটি অংশ। একটি ট্রাইগ্লিসারাইড অণুতে তিনটি ফ্যাটি অ্যাসিড চেইন থাকে এবং অন্য অংশটিকে বলা হয় গ্লিসারল। ফ্যাটি অ্যাসিড চেইনগুলো সাধারণ হাইড্রোকার্বনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় বিজ্ঞানীরা জৈব জ্বালানী উৎপাদনের ক্ষেত্রে একেই কাজে লাগিয়ে থাকেন।
ট্রান্সএস্টারিফিকেশন পদ্ধতির মাধ্যমে গ্লিসারল ও ফ্যাটি অ্যাসিড চেইন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পাওয়া যায় তিনটি এস্টার (প্রতি চেইন ফ্যাটি অ্যাসিডের জন্য একটি করে) ও গ্লিসারল। প্রতি ১০ মেট্রিক টন বায়োডিজেলের উৎপাদনে উপজাত হিসেবে ১০০ কেজি গ্লিসারল পাওয়া যায়।
ইনডিরেক্ট ফার্মেন্টেশন
জৈব জ্বালানী হিসেবে ইথানলের রয়েছে প্রসিদ্ধ ব্যবহার। ইনডিরেক্ট ফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে উদ্ভিজ্জ পদার্থকে পাইরোলাইসিসের মাধ্যমে সিনগ্যাস (Syngas) তৈরি করা হয়। প্রাথমিকভাবে সিনগ্যাসে উপস্থিত পদার্থসমূহ হলো কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড ও হাইড্রোজেন।
অ্যাসিটোজেনিক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সিনগ্যাস রূপান্তরিত হয় ইথানলে। অ্যাসিটোজেন হলো সম্পূর্ণভাবে অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়া যার মাধ্যমে এই রূপান্তর ঘটে থাকে। Wood–Ljungdahl pathway’র মাধ্যমে অ্যাসিটোজেনিক ব্যাকটেরিয়ারা সাধারণত অ্যাসিটেট তৈরি করে থাকে। তবে মিডিয়ায় pH বৃদ্ধির ফলাফল হিসেবে অ্যাসিটেটের বদলে কাঙ্ক্ষিত বস্তু ইথানল পাওয়া যায়।
কনসলিডেটেড বায়োপ্রসেসিং
জৈব জ্বালানী শিল্পে ব্যয় সাশ্রয় একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিমিত ব্যয়ের মাঝে জৈব জ্বালানী উৎপাদনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো কনসলিডেটেড বা সংকুচিত পদ্ধতি। অন্যান্য পদ্ধতি থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে, এটি এক ধাপেই সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ উদিজ্জ পদার্থ থেকে সরাসরি জ্বালানী। এই পদ্ধতিতে কোনো স্যাকারোলাইটিক এনজাইমের প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে ব্যবহৃত সকল জৈব জ্বালানীর তুলনায় এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন সম্ভব। এই পদ্ধতির উপর সর্বাধিক সংখ্যক গবেষণায় পাথেয় হিসেবে কাজ করছেন ডার্টমাউথ কলেজের অধ্যাপক লি লিন্ড ও তার দল। তারা এই পদ্ধতির জন্য ব্যবহার করে থাকেন থার্মোফিলিক থার্মোকিউটিস ব্যাকটেরিয়া। এই পদ্ধতিতে জ্বালানী হিসেবে পাওয়া যায় ইথানল।
জৈব জ্বালানীর সুবিধাসমূহ
জৈব জ্বালানীর সুবিধাসমূহ হলো-
· তুলনামূলক স্বল্প খরচে জ্বালানীর উৎপাদন সম্ভব।
· জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎস পেট্রোলিয়ামের তুলনায় জৈব জ্বালানীর উৎস অনেক বেশি। বিভিন্ন রকমের শস্য, গাছ কিংবা উদ্ভিদের উচ্ছিষ্ট অংশও হতে পারে জৈব জ্বালানীর কাঁচামাল।
· নবায়নযোগ্যতা জৈব জ্বালানীর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক।
· জীবাশ্ম জ্বালানীর তুলনায় জৈব জ্বালানী দহনে যথেষ্ট কম পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঘটে।
জৈব জ্বালানীর অসুবিধাগুলো
পরিবেশের সুরক্ষার কথা চিন্তা করলে এক কথায় জৈব জ্বালানীর বিকল্প নেই। তবে একথাও সত্য যে, শক্তির সরবরাহের ক্ষেত্রে জৈব জ্বালানী কখনোই সর্বোত্তম নয়। এর অসুবিধাগুলো হলো।
· জ্বালানীর উৎপাদন খরচ কম হলেও বিভিন্ন পদ্ধতিতে দরকার হয় পরিশোধনের যা একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।
· জ্বালানী উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল চাষাবাদের জন্য দরকার হয় প্রচুর পরিমাণ পানির। যার ফলে আশঙ্কা থেকেই যায় আঞ্চলিক জলাশয়গুলো শূন্য হয়ে যাবে কিনা।
· যেহেতু উদ্ভিজ্জ পদার্থসমূহকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাই বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিশেষায়িত করা হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। বৃহৎ পরিসরের জমি যখন শুধু জ্বালানীর কাঁচামাল চাষে ব্যবহৃত হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য ঘাটতি দেখা যায় এবং ফলশ্রুতিতে দামের ঊর্ধ্বমুখিতা লক্ষ্য করা যায়।
জৈব জ্বালানী এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ সাফল্য এনে দিতে পারেনি। যদিও জীবাশ্ম জ্বালানীর এক চমৎকার বিকল্প হিসেবে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য এ কথা ভুলে যাওয়া যাবে না যে, জৈব জ্বালানীর উপর পূর্ণ মাত্রায় নির্ভর করা যাবে না। শক্তি উৎপাদনের সম্ভাব্য সকল পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার এবং জৈব জ্বালানীকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপকারী করতে সবার আগে দরকার কাঁচামাল হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত উদ্ভিজ্জ পদার্থকে খুঁজে বের করা।
ফিচার ইমেজ: shutterstock.com