কেন এভারেস্ট থেকে উঁচু কোনো পর্বত পৃথিবীর স্থলভাগে নেই?

নিশ্চিতভাবে আমাদের এই ছোট পৃথিবীতে অনেক পাহাড় পর্বত রয়েছে যেগুলো আকার আকৃতিতে একে অপর থেকে ভিন্ন। কোনোটি বড়, কোনোটি ছোট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট। এই কথা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এভারেস্ট পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত? এর থেকে উঁচু কোনো পর্বত নেই কেন? হিমালয় প্রায় ৯ কিলোমিটার উঁচু। কেন ৯ কিলোমিটার থেকে উঁচু কোনো পর্বত স্থলে নেই? এই যে ৯ কিলোমিটার, এটা কি পর্বতের উচ্চতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

মাউন্ট এভারেস্ট, Image Source: reference.com

একটি বিষয় এখানে লক্ষ্যণীয়, উঁচু পর্বতগুলোর মধ্যে প্রথম একশোটি পর্বতই ৭ কিলোমিটারের উপরে। এই প্যাটার্নটা আরও ভাবিয়ে তোলে যে, এই উচ্চতাগুলো বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ নিয়মের মধ্যে বাধা কিনা। এমন প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মাথায় অনেক আগেই এসেছিল। বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে তাদের মতামত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে একটি ধারণার কথা সবাই স্বীকার করেছেন যে, নির্দিষ্ট উচ্চতার একটি সীমার মধ্যেই পৃথিবীর পর্বতগুলো সীমাবদ্ধ থাকবে। এর উপরে যাবে না। এটি প্রকৃতির বাস্তবতা। এই বাস্তবতার জন্য দায়ী যেসব বিষয় সেগুলো হচ্ছে- মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, পৃথিবীতে মোট নিউক্লিয়নের সংখ্যা এবং পাহাড় পর্বতের শিলাখণ্ড যা দিয়ে পর্বতগুলো তৈরি।

এভারেস্টের গ্লেসিয়ার এর গলন (Arial Photography); Image Source: eorc.jaxa.jp

প্রস্তাবনা শেষ। এখন আসল কথায় আসা যাক। কেন পর্বতগুলো সীমাহীনভাবে বড় হয় না? সহজভাবে বললে, প্রথম কারণ হিসেবে যা আসবে তা হচ্ছে, বেশী উঁচু হলে ওজন বেড়ে যাবে। পৃথিবীর মাটি গ্রানাইট, কোয়ার্টজ, সিলিকন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। তাই পর্বতের অনেক বেশী পরিমাণ ওজন মাটি নিতে পারবে না। যে কারণে পর্বতগুলো মাটির নিচে কিছু পরিমাণ বসে যাবে। পর্বতের এই ওজনের কারণে নিচের দিকে যে বল কাজ করবে তার পরিমাণ পর্বতকে কিছুদূর পর্যন্ত বসিয়ে দিতে সক্ষম। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় Liquefaction। এর জন্য যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন তার পুরোটুকুই পর্বত মাটিতে বসে যেতে শুরু করলে যে পরিমাণ বিভব শক্তি (Potential Energy) খরচ হয় সেখান থেকে আসে।

পর্বতের এই ওজনের কারণে নিচের দিকে যে বল কাজ করবে তার পরিমাণ পর্বতকে কিছুদূর পর্যন্ত বসিয়ে দিতে সক্ষম। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় Liquefaction; Image Source: gentlewaybook.com

গাণিতিক বিশ্লেষণের সাহায্যে খুব সহজেই পর্বতের ন্যূনতম ভর এবং ন্যূনতম উচ্চতা বের করা যায়। এই মানগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারবো যে কেবল এই মানের উপরে উঠলেই পর্বতটি মাটিতে বসে যাবে, তার আগে নয়। এই মান বের করার জন্য আমাদের দরকার হবে পর্বতটির নিজের ভর, পর্বতের একক আয়তনে অণুর সংখ্যা, মাটির সাথে লেগে থাকা পর্বতের ভিত্তির ক্ষেত্রফল এবং পর্বতের Liquefaction হবার জন্য যতটুকু শক্তির দরকার তার মান। এই শক্তির মান আমরা পর্বতের তাপমাত্রা থেকে বের করতে পারি। পর্বতের মাটিতে বসে (Melting) যাবার জন্য যে সুপ্ত তাপমাত্রা (Latent Heat) কাজ করে তার পরিমাণ বের করতে পারলেই Liquefaction হবার শক্তির মানটুকু বের হয়ে যাবে। এই শক্তিকে যদি পর্বতের একক আয়তনে অনুর সংখ্যার পরিমাণ এবং মাটির সাথে লেগে থাকা পর্বতের ভিত্তির ক্ষেত্রফল দিয়ে গুণ দিয়ে ৯.৮১ (মহাকর্ষীয় বলের কারণে যে ত্বরণ হয় তার মান) দিয়ে ভাগ দিয়ে দেই তাহলে একটি নির্দিষ্ট মান পাওয়া যাবে। এই মান থেকে যদি পর্বতের নিজের ভরের মান কম হয় তাহলেই কেবলমাত্র পর্বতটি নিজের জায়গায় সুস্থিত থাকবে, গলে বা বসে যাবে না। এর থেকে ভরের ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে গেল।

এখন বাকি হচ্ছে পর্বতের উচ্চতা। Liquefaction শক্তির মানকে আমরা যদি পর্বতের ভিত্তির ক্ষেত্রফল, পর্বতটি যে পদার্থ দিয়ে গঠিত তার আণবিক ভর এবং ৯.৮১ দিয়ে ভাগ দেই, তাহলে আমরা একটা নির্দিষ্ট মান পাবো। এই মানের সাথে পর্বতের উচ্চতার মানের তুলনা করলে যদি উচ্চতা এই মানের থেকে বেশী হয় তখনই পর্বত গলতে বা বসে যেতে শুরু করবে, এর আগে নয়। ভর এবং উচ্চতার যে মানের কথা এতক্ষণ বর্ণনা করা হল, এই মান দুটি হচ্ছে ক্রান্তিক মান (Critical Value)।

বরফ গলে যাবার কারণে উচ্চতা কমে যায়; Image Source: yahoo.com

এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দরকার। উপরের বর্ণনায় যে liquefaction শক্তির কথা বার বার বলা হচ্ছে সেই শক্তিটা আসলে কি? এই শক্তি বর্ণনা করলে একটা মজার বিষয় জানা যাবে। অনেক বেশী ওজনের কারণে এবং অনেক সময় অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার কারণে পর্বত যখন গলতে শুরু করে, তখন সেটি কঠিন থেকে তরল অবস্থায় আসে। তরল অবস্থায় আসার পর কঠিন অবস্থার পুরো আণবিক বন্ধন ভেঙে যায় না, কিন্তু বন্ধনের দিক ভেঙে পরিবর্তন হয়ে যায়, যে কারণে তরল প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। এই দিক পরিবর্তন করার জন্য যতটুকু শক্তির দরকার সেটা আবার মূল বন্ধন ভাঙার শক্তি থেকে অনেক কম। এই শক্তি পরিমাপ করা আবার একটু জটিল। তাই অনেক সময় প্রবাহিত হবার শক্তিটুকু (Melting Energy) মূল বন্ধন শক্তির (Binding Energy) দশ ভাগের এক ভাগ ধরা হয়।

তাই দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত উঁচু হবার কারণে পর্বতের মাটিতে বসে যেতে যতটুকু শক্তির দরকার, সেই শক্তিটুকু খুব সহজেই চলে আসে। বিজ্ঞানীরা এ সবকিছু হিসেব করে দেখেছেন যে, উচ্চতা ৩০ কিলোমিটারের বেশী কখনোই হবে না। অর্থাৎ কোনো পর্বতের উচ্চতা যদি ৩০ কিলোমিটারের কম হয়, তাহলেই কেবল পৃথিবীর মাটিতে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। এই ৩০ কিলোমিটার কিন্তু ধ্রবক নয়। কারণ পর্বতগুলো সাধারণত খুব সহজেই উত্তপ্ত হয়ে liquefy করে। আমরা পৃথিবীতে এখন যেসব পাহাড়-পর্বত দেখি, সেগুলো অনেক বছরের পুরনো। তাই ক্ষয় হয়ে হয়ে পর্বতগুলো এখন ছোট পাহাড়, বড় পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভারেস্টের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ঘটেছে।  তাই ৩০ কিলোমিটার উচ্চতার যে হিসাব করা হয়েছে, সেটা অতিরিক্ত অনুমান করা হয়েছে।

মঙ্গল গ্রহের পাহাড়গুলোর উচ্চতার ক্রান্তিক মান ১৮ থেকে ২১ কিলোমিটারের মধ্যে হতে পারবে, কারণ সেখানে মধ্যাকর্ষণ পৃথিবী থেকে অনেক কম; Image Source: jpl.nasa.gov

অন্যান্য গ্রহগুলোর পর্বতগুলো হয়তো আরও উঁচু হতে পারে। কারণ সেসব গ্রহতে মহাকর্ষীয় বলের কারণে যে ত্বরণ হয় তার মান ভিন্ন এবং সেসব গ্রহের পাহাড়গুলো ভিন্ন ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি হতে পারে। যেমন- মঙ্গল গ্রহের পাহাড়গুলোর উচ্চতার ক্রান্তিক মান ১৮ থেকে ২১ কিলোমিটারের মধ্যে হতে পারবে, কারণ সেখানে গ্র‍্যাভিটি প্রায় ৩.৭ মিটার/সেকেন্ড^২।

বর্তমান গবেষণা থেকে জানা যায়, এই উচ্চতা অনেক বেশী নির্ভর করে পর্বতগুলোতে অনুভূমিক বল প্রয়োগ করলে যে ব্যবর্তন বা মোচড়ের (Shear Stress) সৃষ্টি হবে তার উপর; Image Source: National Science Foundation

বর্তমান গবেষণা থেকে জানা যায় এই উচ্চতা অনেক বেশী নির্ভর করে পর্বতগুলোতে অনুভূমিক বল প্রয়োগ করলে যে ব্যবর্তন বা মোচড়ের (Shear Stress) সৃষ্টি হবে তার উপর। এই ব্যবর্তন বল পৃথিবীর তাপমাত্রা এবং চাপের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এছাড়া টেকটনিক প্লেটের নড়াচাড়া এবং বর্তমান জলবায়ুর পরিবর্তন পর্বতগুলোর উচ্চতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাহাড়-পর্বতগুলো গলে গিয়ে যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে সে কথা তো সবাই জানে।

খুব সহজ করে এই বিষয় নিয়ে উপরে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমে এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় ৯ কিলোমিটার বলা হয়েছিলো। কিন্তু তাত্ত্বিক হিসেবে আমাদের এসেছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। যে সময় এই হিসাব করা হয়েছিলো, তখন Liquefaction নিয়ে খুব বেশী গবেষণা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে নতুন আরও কিছু বৈজ্ঞানিক উপাদান, যেগুলো পর্বতের উচ্চতার সাথে জড়িত, সেগুলো নিয়ে যখন গবেষণা করা হলো তখন দেখা গেল এই তাত্ত্বিক উচ্চতা আসলে ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু এই লেখায় যে প্রাথমিক হিসেবগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, এখনও এই হিসেব উপযুক্ত তত্ত্ব হিসেবেই গণ্য করা হয়।

তথ্যসূত্র:
1)  Weisskopf, V.F. (1969). Modern Physics from an Elementary Point of View, CERN Summer Lectures, Geneva, pp. 8-10

ফিচার ইমেজ- history.com

Related Articles

Exit mobile version