অ্যাপোলো ১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প || পর্ব ১২

(পর্ব ১১ এর পর থেকে)

স্পেসক্রাফটে থাকা নভোচারীরা তাদের মজুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলেন। হাইসের সন্দেহ হচ্ছিল টেলমুর কাছ থেকে পাওয়া ইতিবাচক রিপোর্টগুলো আসলে দুঃসংবাদ আড়াল করার একটা প্রচেষ্টা ছিল। তিনি বারবার পরীক্ষা করে দেখেন টেলমুর কাছ থেকে পাওয়া হিসাবগুলো ঠিক আছে কিনা। টেলমুর মতো নভোচারীরাও পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। লাভেল গ্রাউন্ডে থাকা কন্ট্রোলারদের না জানিয়েই ঠিক করেন তাদের পান করার জন্য পানি খুব কড়াভাবে বরাদ্দ রাখবেন।

তিনি সুইগার্টকে নির্দেশ দেন কমান্ড মডিউল থেকে খাবার পানি লুনার মডিউলে স্থানান্তরিত করতে। জ্বালানি কোষে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমান্ড মডিউলে শুরুর দিকে অসীম পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ডিজাইনে ত্রুটি থাকায় কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউলে পানি স্থানান্তরিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। হাইসকে তখন প্লাস্টিকের জুসের প্যাকেট ব্যবহার করতে হয় এ কাজের জন্য। এটা করতে গিয়ে তার জুতার মধ্যে কিছু পানি পড়ে যায়।

স্পেসক্রাফটে থাকা নভোচারীরা; Image Source: NASA

পরবর্তীতে স্প্যান (SPAN) প্রকৌশলীরা কাজ করেন নভোচারীদের ব্যাকপ্যাক ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য। কারণ এতে পানি বহন করার পাত্র ছিল। সুইগার্টের জুতা শুকাতে দুই দিন সময় নেয়। কারণ এত যন্ত্রপাতি বন্ধ থাকায় স্পেসক্রাফটের আবহাওয়া শীতল হয়ে পড়ছিল। তার কাছে মনে হচ্ছিল তিনি ফুটো হয়ে যাওয়া কোনো নৌকার মধ্যে আছেন, যেখানে শুধু পানি প্রবেশ করছে। আসলে সুইগার্ট তিন নভোচারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি লুনার মডিউল সম্পর্কে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম জানতেন। তিনি ভেজা জুতা নিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পেছনে থাকা পৃথিবীর দিকে তাকান। তার কাছে তখন মনে হচ্ছিল আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেন না।

লাভেল আর হাইসের এত ব্যস্ততা ছিল যে, তারা দুশ্চিন্তা করার সময়ই পাচ্ছিলেন না। স্পেসক্রাফটের কোনো পাশ যেন সূর্যের কারণে অতি উত্তপ্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হচ্ছিল। সার্ভিস মডিউল থেকে তখনো মাঝে মাঝে অক্সিজেন বের হয়ে যাচ্ছিল, তবে এর তীব্রতা আগের চেয়ে কম ছিল। লাভেল বাম হাত দিয়ে লুনার মডিউলের ড্যাশবোর্ডে থাকা কন্ট্রোল থ্রাস্টা জেটের হ্যান্ড কন্ট্রোল ধরে রেখেছিলেন। এটা স্পেসক্রাফটের গতিপথ নির্দিষ্ট দিকে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল। এটা করতে তার অনেক সমস্যা হচ্ছিল। কারণ লুনার মডিউলের নকশা পুরো স্পেসক্রাফটের গতিপথ নিয়ন্ত্রণের মতো করা হয়নি। লুনার মডিউলের অবস্থান ছিল স্পেসক্রাফটের এক প্রান্তে। বাকি দুইটি মডিউল বহন করার জন্য এটা ছিল খুব বাজে অবস্থান। এর থ্রাস্টারগুলোও ছিল খুব দুর্বল, যা এর দ্বিগুণ পরিমাণ ভার বহন করার উপযোগী ছিল না।

অ্যাপোলো-১৩ স্পেসক্রাফট থেকে পৃথিবীর দৃশ্য; Image Source: NASA

স্পেসক্রাফট দুর্ঘটনার কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় নভোচারীদের অনেকে কন্ট্রোল সেন্টারে চলে আসেন কোনো সাহায্য করতে পারেন কিনা দেখার জন্য। তারা একটা কাজ করতে পারতেন, সিমুলেটরে তারা যে পরিস্থিতি নিয়ে কখনো কাজ করে দেখেননি সেটা পরীক্ষা করে দেখা। অর্থাৎ, অ্যাপোলো-১৩ এর নভোচারীদের মতো পরিস্থিতির সিমুলেশন তৈরি করে দেখা এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কিনা।

লুনার মডিউলের সিমুলেটরের দায়িত্বে ছিলেন বিকল্প লুনার মডিউল পাইলট চার্লস ডিউক। লুনার মডিউল ককপিটের রেপ্লিকাকে আরটিসিসিতে থাকা পাঁচটা ছোট কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করা হয়। সেখানকার কর্মীরা ইতোমধ্যে একে মহাকাশে থাকা প্রকৃত লুনার মডিউলের পরিস্থিতি অনুযায়ী ডেটা দিয়ে প্রোগ্রাম করেন। এমনকি এলোমেলোভাবে অক্সিজেনের ফুটোর প্রভাবও আনা হয়। ডিউক পরীক্ষা করে দেখেন লুনার মডিউলে থাকা থ্রাস্টারগুলো ধীরে ধীরে চালু করলে পুরো স্পেসক্রাফট নিয়ে পাড়ি দিতে পারে, নাকি দ্রুত চালু করলে পারে। দ্রুত চালু করায় দেখা গেল ভালো কাজ করছে। এই তথ্য মহাকাশযানে থাকা লাভেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

সিমুলেটরে উৎপন্ন গতির সাথে স্পেসক্রাফটের গতি যে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বরং লাভেল ডিউকের মতো সহজে স্পেসক্রাফটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারছিলেন না। এফডিএআই বলগুলোর সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় তাকে কম্পাস ছাড়া স্পেসক্রাফট পরিচালনা করতে হচ্ছিল। তাকে শুধুমাত্র ড্যাশবোর্ডে থাকা কৌণিক অবস্থানের হিসাবের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল। তাছাড়া তিনি এতই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন যে, মহাকাশযান ঘোরানোর জন্য ডান দিকে ঘোরাবেন না বাম দিকে, সেটা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন।

লুনার মডিউলের ছবি; Image Source: NASA

এগুলো ছাড়াও লুনার মডিউলের রেডিও দিয়ে ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের সাথে যোগাযোগেও সমস্যা হচ্ছিল তার। এতে ক্রমাগত বিপ বিপ শব্দ হচ্ছিল, যে কারণে লাভেল বা ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা কেউই কারো কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন না। এই আওয়াজটা আসছিল স্পেসক্রাফটকে নিয়ে উড্ডয়ন করা স্যাটার্ন রকেটের ট্রান্সমিটার থেকে, যেটা চাঁদের দিকে যাচ্ছিল। ট্রান্সমিটারটা বিপ বিপ করছিল যেন গ্রাউন্ড থেকে রকেটের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। এটার ফ্রিকুয়েন্সি ছিল লুনার মডিউলের ফ্রিকুয়েন্সিতে।

নাসা এই প্রক্রিয়ার পক্ষে সাফাই দেয় এতে যন্ত্রের খরচ কমানো হয়েছিল। আর রকেট চাঁদে বিধ্বস্ত হওয়ার আগে লুনার মডিউল চালু করার কথা ছিল না। একপর্যায়ে হাইস ক্যাপকমকে বলেন, তার কথা প্রায় কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। ক্যাপকম তখন জরুরি কিছু নির্দেশনা দিয়ে দেন যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও নভোচারীরা সে অনুযায়ী পৃথিবীতে আসতে পারেন।

সৌভাগ্যবশত ইনকোর (INCO) এই সমস্যা সমাধানের কৌশল মনে পড়ে যায়। তিনি নভোচারীদের বিশ মিনিটের জন্য রেডিও বন্ধ রাখতে বলেন। এই সময়টায় তিনি রকেটের ট্রান্সমিটারে ভিন্ন ফ্রিকুয়েন্সির সিগন্যাল পাঠান। এতে ট্রান্সমিটারের ফ্রিকুয়েন্সি কিছুটা পরিবর্তিত হয়। অতি আত্মবিশ্বাসী ডিজাইনের যন্ত্রটিতে ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের শুধু এই একটা ঘটনাতেই কৌশল খাটানো সীমাবদ্ধ ছিল না।

হিউস্টোনে ভোর হওয়ার ঠিক আগে স্পেসক্রাফট হঠাৎ করে বাঁক নিল। লাভেল লুনার মডিউল জেটের ট্রান্সলেশন মুড ব্যবহার করে স্পেসক্রাফটকে স্থিতিশীল করতে সক্ষম হলেন। পরের ধাপে স্পেসক্রাফটকে ঘূর্ণায়মানভাবে এগিয়ে নিতে হচ্ছিল তাপ রোধের জন্য। কিন্তু লুনার মডিউলের গাইড্যান্স সিস্টেম ঘূর্ণায়মান গতির জন্য উপযুক্ত ছিল না। কারণ চাঁদে সামান্য সময়ের ভ্রমণের জন্য ঘূর্ণায়মান গতির দরকার ছিল না। ডিউক এটা নিয়ে সিমুলেটরে কাজ করছিলেন। ক্যাপকম তখন লাভেলকে রেডিওর মাধ্যমে জানান প্রতি ঘণ্টায় স্পেসক্রাফটকে প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোণে ঘুরাতে হবে। ক্যাপকম প্রতিশ্রুতি দেন তাকে প্রতি বার এটা মনে করিয়ে দেবেন।

ঘুমন্ত হাইস; Image Source: NASA

ভোর চারটার দিকে লাভেল হাইসকে বলেন কমান্ড মডিউলে তার কাউচে গিয়ে ঘুমিয়ে আসতে। কমান্ড মডিউলকে নভোচারীরা এখন ‘উপরতলা’ বলা শুরু করেছেন। ভ্রমণের বাকি সময়টাতে এটা তাদের জন্য শোয়ার ঘরে পরিণত হয়েছে। হাইস সর্বশেষ ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিলেন সাত ঘণ্টা আগে দুর্ঘটনা হওয়ার পূর্বে। তিনি সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার জন্য মাঝখানের সময়টাতে হঠাৎ করে সমাধানের অযোগ্য সমস্যার মুখোমুখি হওয়াকে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।

নভোচারীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আলোচনা করছেন ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা; Image Source: NASA

সকাল আটটার দিকে ক্রাঞ্জ আর তার হোয়াইট টিমও ঘুমাতে চলে গিয়েছেন। তখন কন্ট্রোল রুমের পেছনের দিকে কাঁচ ঘেরা দর্শনার্থী কক্ষে চল্লিশ জনের মতো দর্শনার্থীকে দেখা গেল। তাদের মধ্যে ছিলেন স্পেসক্রাফট সেন্টারের পরিচালক রবার্ট আর গিলরুথ, ক্রিস্টোফার সি ক্রাফট জুনিয়র; এবং অ্যাপোলো স্পেসক্রাফট প্রোগ্রাম ম্যানেজার জেমস এ ম্যাকডিভিট। ব্ল্যাক টিমের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে তখন কাজ করছিল গোল্ড টিম। ম্যাকডিভিট মাঝেমাঝে গোল্ড টিমের ফ্লাইট কন্ট্রোলার হিসাবেও কাজ করতেন। তিনি উকি দিয়ে দেখলেন কী হচ্ছে সেখানে।

তখন সিদ্ধান্ত হচ্ছিল চাঁদকে ঘিরে আসার পর সম্ভাব্য তিন উপায়ের কোনটিতে নভোচারীরা রকেট চালনা করবেন। সময়টা ঠিক করা হয়েছিল পেরিসিনথিয়নের দুই ঘণ্টা পর, যাকে বলা হচ্ছিল ‘পিসি+২ বার্ন’ (PC+2 burn)। পেরিসিনথিয়ন হচ্ছে স্পেসক্রাফট যখন চাঁদের নিকটতম দূরত্বে থাকে। তখন সাধারণত সার্ভিস মডিউল থেকে রকেট নিক্ষেপ করা হয় স্পেসক্রাফটকে লুনার অরবিটে রাখার জন্য। এটা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সে সময়ের দুই ঘণ্টা পর জরুরিভাবে স্পেসক্রাফটকে পৃথিবীর দিকে নিয়ে আসতে রকেট চালু করতে হয়। কারণ লুনার মডিউলের রকেটকে প্রস্তুত করতে দুই ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়।

(এরপর দেখুন পর্ব ১৩ তে)

Related Articles

Exit mobile version