২০০৬ সাল, আমেরিকার স্বনামধন্য কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন একজন সাদামাটা মানুষ। নাম তার জেফরে বেল। পেশাগত জীবনে বইপত্রের দেখাশোনা করলেও গবেষণার জগতেও তার ছিল কৃতিত্বপূর্ণ অবদান। জানা ও জানানোর ঝুলি ছিল রঙ-বেরঙের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। বিভিন্ন সময়ে সাড়াজাগানো সব জার্নালে প্রকাশিত হওয়া তার আর্টিকেলই এসবের প্রমাণ। আর তাই নিকটাত্মীয়দের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছেও তার ছিল বেশ নামডাক।
কিছুদিন পর, ২০০৮ এর সূচনালগ্নে আশেপাশের মানুষজনও গবেষণা প্রবন্ধে লেখা প্রকাশে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অনেকেই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রকাশও করতে লাগলেন নিজেদের আর্টিকেল। সদ্য তৈরি হওয়া গবেষণার এমন সাড়াজাগানো পরিবেশ দেখে আনন্দে আটখানা বেল। কেননা, একজন গবেষকের জন্য এ যে এক দারুণ মুহূর্ত! তবে, একদিন একটি আর্টিকেল পড়ে থতমত খেয়ে যান তিনি। একা, আপনমনেই বলে ওঠেন- এ কী! সদ্য পড়ে শেষ করা লেখাটিতে খুঁজে পান অসঙ্গতির ছড়াছড়ি। ভুলে ভরা এ আর্টিকেল যে কারচুপির সাহায্যে প্রকাশিত হয়েছে তা বুঝতে দু’দণ্ডও ভাবতে হয়নি তার। সিদ্ধান্ত নিলেন- এসবের রহস্যোদঘাটনের নেপথ্যে কাজ করে যাবেন তিনি।
সময় গড়িয়ে যায়। বিজ্ঞ এ মানুষের অনুসন্ধিৎসু চোখেও একে একে ধরা দিতে লাগলো এসবের পেছনের ইতিবৃত্ত। উন্মোচিত হতে লাগলো সুশ্রী মুখাবয়বের পেছনের পৈশাচিক মুখোশগুলো। মুনাফার মোটা অংশ ভাগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে একাধিক ভুয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের অন্তঃসারশূন্য জার্নালে প্রকাশ করছিল এসব লেখা। প্রকাশনার অল্প খরচ আর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত হবে ভেবে নীরবে-নিভৃতে জেনে-না জেনে এসবের ফাঁদে পা দিচ্ছিলেন সেসব মানুষজন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও প্রখর বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে তিনি সুকৌশলে জড়ো করতে লাগলেন সেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও জার্নালের নাম। ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ প্রায় ২০টি ভুয়া প্রকাশনার নাম সংগ্রহ করতে সমর্থ হন তিনি, যাদের অধীনে রয়েছে প্রায় শতাধিক জার্নাল। ২০১০ সালে নিজের ব্লগে ছোট্ট এক পোস্টে এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নিকৃষ্ট কর্মযজ্ঞ তুলে ধরেন তিনি। তবে, অসাধারণ এ বিষয়ও জনসাধারণদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ ঘটনায় মর্মাহত হলেন বেল, যদিও থামিয়ে রাখেননি তার সংগ্রহ-কর্ম।
২০১২ সালে সংগ্রহের এ ধারাপ্রবাহকে শৈল্পিক অবকাঠামো দানে তিনি তার ছোট্ট ব্লগকে পরিবর্তন করেন ওয়ার্ডপ্রেসে। নাম দেন ‘স্কলারলি ওপেন এক্সেস’। ব্লগের এই নব্য সংস্করণে ভুয়া প্রকাশনা ও জার্নাল হিসেবে সন্দেহ হওয়া মাত্রই সংগ্রহ করে রাখতেন বেল। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে উন্মোচন করতেন সত্য-তথ্য। ২০১৭ সাল নাগাদ সংগ্রহের এই ধারা অব্যাহত রাখা হয়। এর মাঝে সংগ্রহ হয় প্রায় ১,১৬৩টি সাধারণ ও ১,৩১১টি অনুষঙ্গহীন (Stand-alone) জার্নাল!
ততদিনে বেল লিস্ট পরিচিত পেয়ে গেছে পুরো দুনিয়ায়। নজর কেড়েছে বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের, যারা তাদের গবেষকদের অনুরোধ করেন, আর্টিকেল প্রকাশনার পূর্বে অবশ্যই বেলের এই লিস্ট ধরে যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার। তবে, গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট এসব সৎ প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের কাছে এই লিস্ট তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেও আতে ঘাঁ লাগে মুনাফালোভী সেসব অন্তঃসারশূন্য প্রকাশনার। ভাটা পড়ে মুনাফা সংগ্রহের সোনাজলে।
আর তাই, সংগ্রহের এই বিশাল ভান্ডারে যাদের জার্নালের নাম এসেছে, তারা বেলকে অনুনয়-বিনয় করা শুরু করলেন। একের পর এক ইমেইল পাঠিয়ে পূর্ণ করতে লাগলেন বেলের ইনবক্স। পাঠানো শুরু হলো কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ইমেইলেও, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন বেল। এতেও কাজ না হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা হয় বেলের সঙ্গে। অফার করা হয় মোটা অঙ্কের ডলার। রাজি হননি বেল। তবে একদিন হুট করেই ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে ফেলেন তার লিস্ট!
চারধারে গুঞ্জন শুরু হয় বেলের লিস্ট সরানো নিয়ে। কেউ কেউ তুলে ধরেন ভুয়া প্রকাশনাগুলোর চাপের কথা, কেউ বা আবার প্রশ্ন তুলেন লিস্টের পরিপূর্ণ স্বচ্ছতায়। যদিও, কিছুদিন পর বেল নিজেই তার একটি লেখায় তুলে ধরেন সরিয়ে ফেলার অস্বচ্ছ কারণ। সেখানে তিনি বলেন, “আমি ভীত ছিলাম, কেননা তারা আমাকে হামলা-মামলা ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিল।“
তবে, তিনদিন পর বেলের সান্নিধ্যে থাকা লিউনিড স্নেইডার নামক একজন লেখক ‘ফর বেটার সাইন্স’ এর আর্টিকেলে তুলে ধরেন মূল কারণ। কারণটি ছিল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ফ্রন্টিয়ার্সের সৃষ্ট চাপ। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বেলকে অনুরোধ জানালে বেল তা নাকচ করে দেন। অতঃপর তারা দারস্থ হয় কৌশলের। বেলের নিয়োগকর্তাদের সাথে মোটা অঙ্কের চুক্তি করে তারা। উভয়পক্ষে সমঝোতা হয়- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেলকে কড়া নোটিশ দেওয়া হবে। এতেও কাজ না হলে দেখানো হবে চাকরি হারানোর ভয়। ফেলা হবে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বিসর্জনের মামলায় (যদিও পরবর্তীকালে ফ্রন্টিয়ার্স নিজেদের স্বচ্ছতা প্রমাণ করেই বেরিয়ে আসে লিস্ট থেকে)।
চাকরি হারানোর ভয়ে, অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা-মামলা এড়াতে বেল বাধ্য হন অনলাইন থেকে তার সংগ্রহ সরাতে। ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি অকস্মাৎ, কোনোরূপ আগাম বার্তা ছাড়াই বেল ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলেন তার এই যুগান্তকারী লিস্ট। বেল যখন তার মূল লিস্ট সরিয়ে ফেলেন, তখনও কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে থেকে যায় এর কপি। পরবর্তীকালে বেলের এই মহান কাজকে স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে এবং অসাধু মুনাফালোভীদের রুখে দিতে এটি পুনরায় প্রকাশ করা হয় ইন্টারনেট জগতে, ছড়িয়ে দেওয়া হয় পুরো বিশ্বের আনাচে-কানাচে, যা আজ অবধি গবেষণার জগতে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
২০১০ সালের শুরুর দিকে কিছু ভিত্তিহীন, অসাড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও জার্নালের ছোট্ট এক অনুসন্ধান থেকে গড়ে উঠেছে আজকের এই সুবিশাল বেল লিস্ট। এর পেছনে রয়েছে অতিসাধারণ একজন মহৎপ্রাণ মানবের মোহনীয় কর্মস্পৃহা, যা এক অভিশপ্ত ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত করেছে পুরো পৃথিবীকে। প্রদান করেছে শুদ্ধ-বিশুদ্ধ ও আস্থাপূর্ণ এক স্বপ্নিল ভুবন সৃষ্টিশীল গবেষক ও সৃজনশীল গবেষণাকে।