জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এর ফলে সংগঠিত আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে অনেককাল আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। যত দিন যাচ্ছে তত অবস্থা আরও প্রকট হচ্ছে, আরও খারাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বছর ঘিরে ঋতুর যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি, তা কিন্তু এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে।
গরম পড়লে অস্বাভাবিক গরম, ঠাণ্ডায় অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা, প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিন দিন যেন আরও অসহ্য হয়ে পড়ছে। এর সাথে আবার আছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, যেটির কারণে বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়েই চলেছে এবং বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে, এভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে থাকলে পৃথিবী হয়তো আর মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকবে না।
Science Advances নামক জার্নালে Unprecedented Climate Change: Historical Changes, Aspirational Targets, and National Commitments শিরোনামের সাম্প্রতিক এক গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বৈশ্বিক আবহাওয়ার ভবিষ্যৎ এবং এর বিরূপ প্রভাব প্রবলতর হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। স্ট্যানফোর্ড এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে এখানে সতর্কতা জারি করা হয়েছে যে, বর্তমান সময়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের যে ধারা দেখা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের বিপরীতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করা যাবে।
সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামিটে বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলো যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, সেটি যদি বাস্তবায়িত না হয় তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমগ্র মানব সমাজকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্যারিসে অনুষ্ঠিত COP21 (21st Conference of the Parties), UN Framework Convention on Climate Change (UNVCCC) এ বিশ্বের ১৭০টি দেশের রাষ্ট্রনায়ক যোগ দেন এবং এখানেই প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে বলা হয় যে, ২১০০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভিতরে নিয়ে আসা হবে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা এই সম্মেলনে বিশ্বনেতারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ২০১৭ এর নভেম্বর মাসের মধ্যে ১৯৫টি UNFCCC এর সদস্য দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অবশ্য পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
যা-ই হোক, উক্ত গবেষণায় দেখা গেছে, যদি বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে উত্তর আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণভাগ এবং ইউরোপের অনেক অংশে কিছুদিনের মধ্যে তীব্র আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে। তাপমাত্রা যদি অনেক দিন পর্যন্ত এমন বর্ধিষ্ণু অবস্থায় থাকে, তাহলে এসব অঞ্চলে বর্তমানের থেকে তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি খারাপ আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে।
আরও খারাপ সংবাদ হচ্ছে এই, যদি জলবায়ু নিয়ে প্যারিস চুক্তিতে যে আশার বাণী এবং অঙ্গীকার করা হয়েছে তা সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত করা শুরু হয়; তাহলেও বৈশ্বিক উষ্ণতা কমপক্ষে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আর যদি বাস্তবায়ন আরও দেরিতে শুরু হয়, তাহলে তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
গবেষণাটিতে মূলত সংগৃহীত উপাত্ত (Historical Data) ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই উপাত্তগুলোর ভিত্তি করে গাণিতিক মডেল দাঁড় করানো হয়েছে। এই মডেলটির কাজ হচ্ছে অতীত এবং ভবিষ্যতের জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া, যার উপর ভিত্তি করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা যাতে নেওয়া যায়। এই গবেষণার উপাত্তগুলো ছিল উত্তর আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপ থেকে সংগৃহীত। গণিত ব্যবহার করে এখানে দেখানো হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু চরম মুহূর্ত। যেমন- দিনে এবং রাতের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কখন হতে পারে, সবচেয়ে বেশি আর্দ্রতা কী পরিমাণ এবং কখন হতে পারে, পরিবেশে শুষ্কতার পরিমাণ কতটুকু ছিল এবং ভবিষ্যতে কোন সময়ে কতটুকু হতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়েছে এখানে। এবং এই গবেষণার উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এখানে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, রাতের দিকে তাপমাত্রার বৃদ্ধি কিছু কিছু জায়গায় ইতিপূর্বে শুরু হয়ে গিয়েছে এবং এই পরিস্থিতি কিছু কাল পরেই ইউরোপে এবং এশিয়াতে প্রায় ৫ গুণ পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বিরাজ করছে। আর্দ্রতা এবং শুষ্কতার যে ভারসাম্য এখন মোটামুটিভাবে বজায় আছে, সেটিও সারা বিশ্বে সাম্যাবস্থা হারাবে বলে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
প্যারিসে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেটি যদি ধরে রাখা যায় এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা যায়, তাহলে বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সম্ভাব্য আগত বিপদের অনেকখানি কমে যাবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভিতর রাখলেও, যে যে এলাকায় এই গবেষণা করা হয়েছে সেই এলাকাগুলোতে কিছু জলবায়ুর বিপর্যয় ঘটবে সেটি এর মধ্যেই নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। হয়তো অনেক বেশি পরিমাণে বিপর্যয় দেখা যাবে না, কিন্তু মাঝে মাঝেই পরিবেশের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখা দিতে পারে। এর থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক যদি কাজ না করা হয় এবং আগে থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে আখেরে বড় মাপের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এই গবেষণার মূল লেখক ডিফেনবাফের মতে, “The aspirational U.N. targets are both likely to substantially reduce the risk of unprecedented extreme events, but still carry an increased risk relative to the present”
এই গবেষণাটি মাত্র চারটি মহাদেশ নিয়ে হলেও, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশ, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও এই ভবিষ্যদ্বাণী খাটবে বলে ধারণা গবেষকদের। কারণ, যে গাণিতিক মডেল তৈরি করা হয়েছে তা অনেক শক্তিশালী উপাত্তের উপর ভিত্তি করে তৈরি। প্রচুর তথ্য-উপাত্ত এবং শক্তিশালী সঠিক গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে তৈরি মডেল মোটামুটি সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাচ্ছে কিনা এবং কত শতাংশ সঠিকভাবে তা করা যাচ্ছে এগুলো জানারও গাণিতিক পদ্ধতি আছে। উক্ত গবেষণায় যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এবং যে মডেল তৈরি করা হয়েছে, সেখানে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত প্রয়োগ করলে ফলাফলে সামঞ্জস্যতা বজায় থাকবে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। কারণ, সারা বিশ্ব বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বিপর্যস্ত পরিবেশের শিকার হচ্ছে। তাই উপাত্তগুলোর মধ্যে মিল থাকতে বাধ্য।
ব্যাপারটি এখন হয়ে গেছে ‘Do or Die‘ এর মতো। এখন সমন্বিতভাবে সবাইকে প্রচেষ্টায় নামতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারকে বুঝতে হবে যে, পৃথিবীর আবহাওয়ার যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। এখন যতটুকু পারা যায় সেই ক্ষতিগুলো হ্রাস করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, জলবায়ুর এই পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাবার আশঙ্কাই শেষ কথা নয়। এর সাথে সাথে পরিবেশের আর্দ্রতা এবং শুষ্কতার ভারসাম্যের উপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ, প্রকৃতির প্রতিটি অংশই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির একটি অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এতে এর অন্যান্য অংশেরও ক্ষতি হয়ে যাবেই। প্রকৃতি তার ভারসাম্য বজায় রাখবেই।
ফিচার ইমেজ: engineersjournal.ie