১৯১৪ সালের ৮ই ডিসেম্বর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। অপ্রতিরোধ্য জার্মানদের প্রতিরোধ করতে যুদ্ধবাহিনী পাঠায় ব্রিটিশরা। ফকল্যান্ড আইল্যান্ডের কাছে দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যেখানে যুদ্ধ হয় তার অক্ষাংশ ছিল ৫০ ডিগ্রী দক্ষিণ অর্থাৎ দক্ষিণ আটলান্টিকের দিকে। ব্রিটিশদের গোলা-বারুদ ঠিকভাবে লক্ষ্য করেই ছোঁড়া হচ্ছিল। কিন্তু কেন জানি গোলাগুলো লক্ষ্য থেকে প্রায় একশো মিটার বামে আঘাত করছিল। যুদ্ধের জন্য এটি দারুণ সমস্যা সৃষ্টি করছিল।
একইরকম হচ্ছিল জার্মানদের বেলায়ও। তারা তাদের বিশাল বিশাল আর্টিলারি ১১ কিলোমিটার দূর থেকে নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের গোলাগুলোও লক্ষ্যবস্তু থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়ছিল। দুই দেশ কি গাণিতিক হিসাব না করেই যুদ্ধে নেমে গিয়েছিল? তখন দুই দেশই ছিল পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ, বিশেষ করে বিজ্ঞানের দিক দিয়ে। তবুও যুদ্ধে কোনোরকম হিসাব ছাড়াই আনাড়ির মতো কি তারা গোলা ছুঁড়ছিল? জার্মানরা প্রথম যখন তাদের দূরপাল্লার আর্টিলারি তৈরি করে এবং সেটি পরীক্ষা করে দেখে, তখন ফলাফল আসে যে, যদি কামানের গোলাগুলোকে ৪৫ ডিগ্রী থেকে বেশি কোণে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে তা অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছাবে। বরং ৪৫ ডিগ্রীতে নিক্ষেপ করলে যতদূর যাবে এর থেকে বেশি কোণে নিক্ষেপ করলে প্রায় দ্বিগুণ দূরত্ব অতিক্রম করবে।
উপরের আলোচনা থেকে বৈজ্ঞানিক কিছু প্রশ্ন এসে যায়। সেটা হচ্ছে, গোলাগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে কেন আঘাত করছিলো? আবার ৪৫ ডিগ্রি থেকে বেশি কোণে নিক্ষেপ করলে কেন গোলাগুলো বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছিলো? এই লেখার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এই দুটি প্রশ্নের সমাধান নিয়ে আলোচনা করা।
দূরপাল্লার প্রাস গতি সম্পন্ন এসব গোলা বা শেলগুলো এই ধরনের বিচ্যুতির ব্যাখ্যা করিওলিস বল (Coriolis Force) এর মাধ্যমে করা যায়। মূলত পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণনের ফলে এরকমটি হয়। উত্তর গোলার্ধে এই বিচ্যুতি হবে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এই বিচ্যুতি হবে বাম দিকে। অক্ষাংশগুলোতে এই বিচ্যুতি বেশি লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু বিষুবরেখাতে এই বিচ্যুতি হবে শূন্য।
যখন একটি বড় দূরপাল্লার শেল নিক্ষেপ করা হয়, তখন সেটা শুধু নিজের গতি নিয়েই ছুটে যায় না, বরং এর সাথে যুক্ত থাকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে যে গতি যোগ হয় সেটাও। শেল যখন ছোঁড়া হয় এবং যখন এটা নিজের গতিপথ দিয়ে ছুটে চলে, তখন লক্ষ্যবস্তু কিন্তু স্থির থাকে না। পৃথিবীর ঘূর্ণনের জন্য সেটাও কিন্তু ঘুরতেই থাকে। তাই গোলা নিক্ষেপ করার সময় হিসেবের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুর গতিও গণনায় ধরতে হবে, না হলে ঠিক ঠিকভাবে গোলা ঠিক জায়গায় আঘাত হানতে পারবে না।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। যেমন, আমরা একটি শেলের উৎক্ষেপণ স্থান ঠিক করলাম যেটা উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। লক্ষ্য ঠিক করলাম উৎক্ষেপণ স্থান থেকে আরও উত্তর দিকে। দুটি স্থানই কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথের উপর পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে। কিন্তু এখানে একটি জিনিস লক্ষ্যণীয়, সেটা হচ্ছে লক্ষ্য যে জায়গায় অবস্থিত সেটার অক্ষাংশ কিন্তু উৎক্ষেপণ স্থানের থেকে উপরের দিকে। আনুভূমিকভাবে পৃথিবীর চারপাশে যে অনেকগুলো গোল সমান্তরাল রেখা আঁকা হয়, সেগুলো হচ্ছে অক্ষাংশ। উপরের দিকে লক্ষ্যবস্তুর অক্ষাংশ হওয়ায় সেই বিন্দু দিয়ে পৃথিবীর চারপাশে যদি বৃত্ত আঁকা হয় তাহলে সেটা উৎক্ষেপণ স্থানের বৃত্ত থেকে ছোট হবে। অর্থাৎ লক্ষ্য যে জায়গায় ঠিক করা হয়েছে সেই স্থান উৎক্ষেপণ স্থানের তুলনায় আস্তে আস্তে ঘুরবে। তাই যখন আমরা শেল উৎক্ষেপণ করবো তখন এর মধ্যে পৃথিবীর গতি থাকবে এবং এই গতির কারণে যখন এটি আকাশে উড়ে যেতে থাকবে তখন এর গতিপথ কিন্তু থাকবে পূর্ব দিকে। আবার যেহেতু লক্ষ্যবস্তুর স্থানের ঘূর্ণন গতি কম, তাই শেলটি ঠিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত না হেনে এর পূর্ব দিকে সরে গিয়ে আঘাত করবে। তাই এক্ষেত্রে যদি লক্ষ্যবস্তুর গতি ঠিকঠাক মতো হিসেবের মধ্যে না আনা হয় তাহলে শেলটি গন্তব্যস্থল থেকে ডান দিকে অনেক বেশি সরে যাবে [১]।
সাধারণত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ভুলভ্রান্তি বুঝে এরপর বিচ্যুতি হিসাব করা হয়, কিন্তু ঠিকভাবে লক্ষ্যতে আঘাত করতে হলে বেশিরভাগ সময় নির্ভর করা হয় অক্ষাংশের উপর। তবে পৃথিবীর দুই গোলার্ধের জন্য হিসেব দুই রকম হতে হবে। হিসেবের সময় এটা মাথায় থাকতে হবে, নাহলে বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
এই যুদ্ধে যেটা হয়েছিলো সেটা হচ্ছে, ব্রিটিশদের দূরপাল্লার শেল এবং বন্দুকগুলো ইংল্যান্ডের অক্ষাংশের জন্য ঠিকঠাক কাজ করেছিলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ফকল্যান্ড আইল্যান্ডের জন্য সেটা ঠিকভাবে কাজ করেনি, কারণ আইল্যান্ডটি ছিল দক্ষিণ অক্ষাংশে। তাই সেটার জন্য হিসেব ইংল্যান্ডের অক্ষাংশের হিসেব থেকে ভিন্নভাবে করতে হতো। অপরদিকে জার্মানরা তাদের যে বিগ বার্থা নামক শেলগুলো নিক্ষেপ করেছিলো সেখানে কিন্তু ঠিকভাবে বিচ্যুতির এই ব্যাপারগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিলো এবং তাদের হিসেবও ঠিক ছিল। কিন্তু তাদের শেলগুলো অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করে আঘাত হেনেছিল [2]।
এর কারণ ছিল খুবই সাধারণ। যখন তারা পরীক্ষা করে দেখল যে ৪৫ ডিগ্রির বেশী কোনে নিক্ষেপ করলে তা বেশী দূরত্ব অতিক্রম করবে, তখন তাদের আরেকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর পাতলা কিংবা গভীর বায়ুস্তরের উপস্থিতি রয়েছে। কোনো বস্তুকে যত বেশী কোনে নিক্ষেপ করা হয় সেটা উলম্ব দিকে তত বেশি দূরত্ব অতিক্রম করবে এবং এরপর প্রাসের গতিপথ অনুযায়ী সামনে এগিয়ে যাবে। জার্মান শেলগুলো ৪৫ ডিগ্রির বেশী কোনে নিক্ষেপ করার ফলে এরা বায়ুমণ্ডলের পাতলা স্তর দিয়ে চলে গিয়েছিলো, যে কারণে বাতাসের সাথে এর ঘর্ষণ বল কমে গিয়েছিলো বিধায় শেলের উপর বাতাসের drag force কম কাজ করেছিলো। সেজন্য আশ্চর্যভাবে শেলগুলো অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করে আঘাত হেনেছিল [৩]।
ফিচার ইমেজ সোর্স: Pinterest.com
তথ্যসূত্রঃ
[১] Burns, G. P. (1971). Deflection of projectiles due to rotation of the Earth. American Journal of Physics, 39, 1329-1332
[2] Walker, J. (2007). Flying Circus of Physics. John Wiley & Sons, Inc.
[৩] Johnson, W (1991). Some monster guns and unconvential variations. International Journal of Impact Engineering, 11, No. 3, 401-439