যেসব কারণে টেক জায়ান্টদের কর্মী ছাঁটাইয়ের হিড়িক

২০২০ সালের কথা। কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকে বৈশ্বিক অর্থনীতি নাজেহাল, তাবৎ বড় বড় ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, প্রবৃদ্ধির জেরবার অবস্থা। কিন্তু সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধির ছুরি ঘুরিয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো। সবার লক্ষ্য যখন কোনোরকমে টিকে থাকা, তখন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চলেছে উল্টো পথে, বিশাল অঙ্কের মুনাফা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে কয়েক গুণ। কারণ ছিল একটাই- অতিমারীর কারণে মানুষ হঠাৎ করেই অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ে।

তবে পাশার দান উল্টে যেতে সময় লাগলো কেবল এক বছর। ২০২০ সালে অ্যাপল, অ্যামাজন, গুগল আর মেটার মতো টেক জায়ান্টদের শূন্যযাত্রা অব্যহত ছিল ২০২১ সালেও। তবে ২০২২ সালে গিয়ে অতিমারীর প্রভাবে মুদ্রার অন্যপিঠ দেখতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো।

Source: trueup.io/layoffs

কোভিডের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়তে শুরু করলে হঠাৎই প্রযুক্তি ব্যবসার দুরন্ত গতি খানিকটা কমে আসে। বৈশ্বিক মন্দার আগাম পূর্বাভাসে ওয়াল স্ট্রিটের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিতে শুরু করে। মাইক্রোসফট, টুইটার, অ্যামাজন, মেটার মতো টেক জায়ান্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযুক্তি সার্চ ইঞ্জিন গুগলের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান আলফাবেটের ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা। সম্প্রতি ডিজিটাল বিজ্ঞাপন আর ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে অ্যামাজন ও মাইক্রোসফটের কাছে বাজার হারিয়ে এরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে প্রতিষ্ঠানটি।

কে কত ছাঁটাই করলো?

‘লেঅফ ডট এফওয়াইআই’ নামক একটি কর্মী ছাঁটাই বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, গেল বছর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বজুড়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। তবে ২০২৩ সাল যেভাবে শুরু হলো, তাতে এই সংখ্যাটি নেহায়েত ছোটই মনে হচ্ছে। নতুন বছরে ৩ সপ্তাহ পার হতে হতেই বিশ্বজুড়ে ৩৮ হাজারের অধিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণ ইতোমধ্যে চলে এসেছে, খবর ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের!

বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক প্রবৃদ্ধির খাত প্রযুক্তিতে কেন হঠাৎ এই ছাঁটাইয়ের ছড়াছড়ি? এ প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে এক নজরে দেখে নেই বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাম্প্রতিক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা এবং তার প্রধান কারণগুলো

Image: Roar Bangla

কেন ছাঁটাইয়ের হিড়িক?

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাইয়ের পেছনে দেয়া ব্যাখ্যাগুলোর মোটামুটি প্রধান কারণ সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা। বিশ্বজুড়ে মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট এবং গতবছর শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে ২০০৯ পরবর্তী আরো একটি বৈশ্বিক মন্দা নিকটেই রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তথাপি এখনই খোলসের ভেতরে চলে যাওয়াকে ‘কপিক্যাট বিহেভিওর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেস-এর প্রফেসর জেফ্রি ফিফার।

“প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা না ভেবেই অন্যদের দেখে নিয়ে থাকে। যখন একটি প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়, এর প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানটিও (প্রয়োজন না হলেও) অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়,” স্ট্যানফোর্ড নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন প্রফেসর ফিফার।

২০২২ সালের শুরুতে কেবল পাঁচটি প্রতিষ্ঠান – অ্যাপল, মাইক্রোসফট, আলফাবেট, টেসলা আর অ্যামাজনের সম্মিলিত বাজার মূলধন ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায় যা বছরের শেষে নেমে আসে ৩.৪১ ট্রিলিয়নে, অর্থাৎ ৩৩ শতাংশের অধিক পতন। বিশেষজ্ঞরা একে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোর সিদ্ধান্তের পেছনে। সাথে লভ্যাংশে ঘাটতি আর মুদ্রাস্ফীতি তো আছেই।

Image Source: The New York Times

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল এবং আইএমএফের যুগ্ম এক প্রতিবেদনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে সাম্প্রতিক কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণ হিসেবে। অতিমারীর সময় হঠাৎ করেই মানুষ অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছিল। জুম, স্কাইপ, অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সের মতো প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তখন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। তবে কোভিডের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেতে মুখিয়ে থাকা মানুষজন শীঘ্রই কোভিড-পূর্ব জীবনে ফিরে যেতে শুরু করে। এতে করে সহসা ফুলেফেঁপে ওঠা বাজার আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে শুরু করেছে।

পরিস্থিতির উন্নতি হবে কবে?

একের পর এক বড় পরিসরে চাকরি কর্তনের খবরে আতংক ছড়াচ্ছে টেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের মনে। বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্স, ডেটা সায়েন্স, ইনফরমেশন টেকনোলজি পড়ুয়াদের স্বপ্নই যেখানে থাকে কোনো বৈশ্বিক টেক জায়ান্টে কাজ করার, সেখানে গণহারে কর্মী ছাঁটাইয়ের সংবাদ কিছুটা হলেও ভীতির উদ্রেক করেছে।

তবে অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা এখনও চিন্তার কারণ দেখছেন না। যেকোনো অর্থনৈতিক মন্দার আভাস পেলেই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কর্মী ছাঁটাই করে থাকে। অন্য সকল খাতের মতোই এই ইন্ডাস্ট্রিরও প্রবৃদ্ধির চাকা পুনরায় সচল হওয়া নির্ভর করছে বিভিন্ন বৈশ্বিক কার্যকরণ, যেমন- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি মূল্যের স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতির অবনমন ইত্যাদির উপর। এককথায়, বৈশ্বিক মন্দার যে পূর্বাভাস গতবছর থেকে দেয়া হচ্ছে, তার তীব্রতার উপরই নির্ভর করবে প্রযুক্তির বাজার এবং বাজারের জায়ান্টরা কোন পথে যাবে।

Language: Bangla
Topic: Layoffs in tech giant companies around the world
References: Hyperlinked inside
Feature Image: Africa News

Related Articles

Exit mobile version