বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের জন্য একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ এবং শিল্প-কারাখানার ব্যবসায়ীদের জন্য এটা তেমন মাথা ব্যথার বিষয় নয়। তারা পরে গিয়ে হয়তো ভুক্তভোগী হবে যদি না বিজ্ঞানীরা এই বিষয় নিয়ে এখন থেকে চিন্তা না শুরু করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড। এই গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিন হাউজ। যতই দিন যাচ্ছে ততই গরমের তীব্রতাও যেন বেড়ে যাচ্ছে। এরকম হওয়ার কারণ হচ্ছে কার্বন গ্যাস আমাদের বায়ুমণ্ডলের ভিতরে আটকা পড়ে গিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানব সভ্যতার চিহ্ন এই পৃথিবীতে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই গরম কমানোর জন্য বিজ্ঞানীরা অভিনব এক পদ্ধতির আবিষ্কার করেছেন, সেটি হচ্ছে অঙ্গারক বা কার্বন মজুদ করা। মাটির নিচে কার্বন গ্যাসকে মজুদ করে রাখা হবে। তাহলে এই গ্যাস আর পরিবেশে বের হতে পারবে না। পরে গিয়ে এই মজুদকৃত গ্যাসকে মানব সমাজের জন্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে। এই গ্যাসকে কীভাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহার করা যায় সেটা নিয়েও এখন গবেষণা চলছে।
কার্বন মজুদের মূল ধারণাটি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেটার মাধ্যমে কলকারখানা এবং বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে যে পরিমাণ কার্বন তৈরি হয় সেগুলোর কমপক্ষে ৯০ শতাংশকে বন্দী করে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হবে। এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হচ্ছে কার্বনকে সংগ্রহ করা, সেগুলোকে উপযুক্ত জায়গায় নিয়ে যাওয়া এবং এরপর সেটাকে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন পরিবেশের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না এবং জলবায়ুর প্রতিকূলতা থেকেও নিজে দূরে থাকতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য যে, কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসকে একবার সংগ্রহ করে ফেলার পরই এটাকে তরলে পরিণত করা হয়। এরপর এই তরলকে কয়েকশো মাইল দূরবর্তী জায়গাতে নিয়ে যেতে হয় এবং সেখানে মাটির নিচে মজুদ করতে হয়।
এই মজুদকরণের জন্য উপযুক্ত জায়গার প্রয়োজন। সাধারণত ব্যবহার করা হয় না এমন কোনো গভীর স্যালাইন একুইফার কিংবা কোনো তেলের খনি– এমন সব জায়গা নির্বাচন করা হয় গ্যাস মজুদের জন্য। তেলের খনিগুলোতে গ্যাস পুঁতে রাখার জন্য একটি প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করতে হবে প্রকৌশলীদের। প্রক্রিয়াটি হচ্ছে Enhanced Oil Recovery। একদিক দিয়ে কার্বনকে মাটির নিচে পাঠিয়ে দেয়া হবে, আবার অপর দিকে সেখান থেকে তেল উপরে টেনে তোলা হবে। এতে তেল খনি থেকে আলাদাভাবে উঠানোর খরচও বেঁচে যাবে।
একটি প্রকল্প শুধু মুখে মুখে বললেই আসলে হয়ে যায় না। এর পেছনে থাকে অনেক পরিকল্পনা এবং অনেক গবেষণা। সাথে থাকে অর্থনৈতিক দিক এবং সেখান থেকে আয়-ব্যয় এর হিসাব। উপরের বর্ণনাগুলো শুনতে সোজা মনে হলেও কার্বন মজুদের এই প্রকল্প কিন্তু অনেক খরচের ব্যাপার। তরল কার্বনকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই অনেক খরচ। ব্রিটেনে এই কার্বন স্থানান্তরণের জন্য কেমন খরচ পড়তে পারে সেটার একটা হিসাব দেয়া হয়েছে। তরল কার্বনকে যদি পাইপ দিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে প্রতি মাইলে ১ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ পড়বে, অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় এই অংকের পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে প্রযুক্তিটি মোটেও খরচ সাপেক্ষ নয়, কিন্তু মানবকল্যাণে এমন একটি প্রযুক্তি দাঁড় করানো অতীব প্রয়োজন।
এই মাসের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বাজেট বিলে সই করেন যেটা প্রাকৃতিক শক্তি এবং জলবায়ু গবেষকদের জন্য একটি সুখবর বয়ে নিয়ে এসেছে। এই বাজেটটি ছিল Tax Credit নিয়ে। এই বাজেট বিল পাস হবার কারণে শিল্প কারখানা থেকে নির্গত কার্বন গ্যাসকে কমিয়ে আনা যাবে এবং পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর মধ্যে যে একটা অর্থনৈতিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা অনেকাংশে কমাতে পারবে বলে বিশ্বাস বিজ্ঞানীদের।
গবেষকদের মতে এই বাজেট পাস করার আগপর্যন্ত এই প্রকল্প শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু কিছু জায়গায় প্রোটোটাইপ হিসেবে কাজ যদিও শুরু হয়েছে, যেমন- বাতাস থেকে কার্বনকে ধরে মাটিতে পুঁতে ফেলার প্রযুক্তি; কিন্তু সত্যিকারের এবং আরও বড় পরিসরের কাজ এখন থেকে শুরু করা যাবে। যেহেতু বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন প্রায় লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে, চাই বা না চাই আমাদেরকে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতেই হবে। তাই এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে যতটুকু পারা যায় দুর্যোগের তীব্রতা কমানোর ব্যবস্থা করা। আর সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব কার্বন মজুদকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়া উচিত। উক্ত বাজেটের কারণে বিজ্ঞানীদের আশা যে আগামী দুই বা তিন বছরের মধ্যে প্রায় দশ থেকে বারোটি এরকম প্রকল্প বাস্তবায়ণ করা সম্ভব হবে।
প্যারিসে জলবায়ুর যে চুক্তি সই হয়েছিলো সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে কার্বন মজুদের দিকে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবেই। কিছু গবেষণাপত্র বের হয়েছে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে একমাত্র কার্বন মজুদকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আগামী ১০০ বছরে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভিতর রাখা সম্ভব।
যেহেতু কার্বন মজুদকরণ প্রকল্প একটি মেগা এবং অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ একটি প্রকল্প, তাই এর আয় এবং ব্যয়ের হিসাবের দিকে একটু চোখ বোলানো যাক। গণনা করে দেখা গিয়েছে যে, যে বাজেট পাস হয়েছে এর মধ্যে কাজ করতে হলে প্রতি মেট্রিক টন কার্বনকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে খরচ হবে ৫০ ডলার এবং ৩৫ ডলার করে খরচ হবে অন্যান্য কাজে। এর মধ্যে কোল বা কার্বন জাতীয় প্ল্যান্টগুলো থেকে নিয়ে আসা কার্বনের ক্ষেত্রে খরচ পড়বে ৬০ ডলার এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন করা প্ল্যান্টগুলো থেকে নিয়ে আসা কার্বনের জন্য খরচ পড়বে ৭০ ডলার। তাছাড়া প্রতি মেট্রিক টনে ১১ ডলার করে খরচ পড়বে কার্বন স্থানান্তরণের জন্য।
মোটামুটি ঠিক হয়েই গিয়েছে যে কার্বন মজুদ নিয়ে এখন বড়সড় সব কাজ হবে। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু এরপরেই প্রশ্ন আসে যে এত এত কার্বন শুধু কি মজুদ রাখাই হবে? এই তরল কার্বনগুলোর কাজ কী? এগুলোকে কি কোনোভাবে মানব সভ্যতার কাজে লাগানো যায় না? কোনভাবে কি এগুলো অন্যকিছু বানাতে ব্যবহার করা যায় না?
বিজ্ঞানীরা এসব নিয়েও ভেবেছেন এবং উপায় বের করেছেন। এই মজুদকৃত কার্বন দিয়ে বিকল্প তেল তৈরি করা যেতে পারে, বড় বড় দালানকোঠা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া ইথানল, কৃষিকাজের জন্য সার, ইথিলিন অক্সাইড ইত্যাদি কাঁচামাল তৈরি করা যেতে পারে। এগুলো তৈরি করতে নয় থেকে ত্রিশ ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। সিমেন্ট এবং ষ্টীল তৈরির কারখানা থেকে যে পরিমাণ কার্বন বের হয় সেগুলো মজুদ রাখার জন্য যে খরচ পড়বে তা প্রতি টনে প্রায় একশো ডলারের কাছাকাছি।
ফিচার ইমেজ: wired.com