মহাবিশ্বের এক অপার রহস্যের নাম ব্ল্যাক হোল। এর আকর্ষণ ক্ষমতা এতই বেশি যে এর আশেপাশের সকল কিছু এমনকি আলোকেও নিজের দিকে টেনে ধরে রাখে। আলো আসতে পারে না বলে একে দেখা অনেকটা অসম্ভবই বলা চলে। এর অস্বিত্ব ও প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিন ধরে তাত্ত্বিক আলোচনা করে আসলেও এর সত্যিকারের অস্তিত্ব সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা ছিল না।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি। তার মানে বাস্তবে প্রমাণ হলো ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব আছে। এদের অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এমনটা হয়তো বিজ্ঞানীরাও ভাবেননি। খোদ আইন্সটাইন, যার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে ব্ল্যাক হোল ধারণার উৎপত্তি, তিনিই বলেছিলেন তিনি মনে করেন তাত্ত্বিকভাবে ব্ল্যাক হোলের অস্বিত্ব সম্ভব হলেও বাস্তবিক অর্থে এর কোনো অস্বিত্ব নেই। আইন্সটাইন প্রমাণিত না হলেও এক্ষেত্রে নিজের তত্ত্বকে অবিশ্বাস করেই তিনি ভুলই করেছেন বলা যায়। বিজ্ঞানীরা মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলে প্রমাণ করে দিয়েছেন আইন্সটাইনের ধারণা ভুল, কিন্তু তাঁর তত্ত্ব সঠিক!
মোটামুটি প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এক বা একাধিক ব্ল্যাক হোল আছে। আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও আছে একটি ব্ল্যাক হোল। এর নাম স্যাজিটেরিয়াস এ। পৃথিবী থেকে এ ব্ল্যাক হোলের দূরত্ব ২৬ হাজার আলোকবর্ষ। অথচ যে ব্ল্যাক হোলের ছবি বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি তুলেছে সেটির অবস্থান ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। তাহলে কাছের ব্ল্যাক হোল রেখে এত দূরের ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলার জন্য কেন এত বড় আয়োজন?
যে ব্ল্যাক হোলটির ছবি বিজ্ঞানীরা তুলেছেন, সেটির অবস্থান পৃথিবী থেকে অনেক দূরে হবার পাশাপাশি এর আকারও সুবিশাল। আকারে এটি প্রায় আমাদের সৌরজগতের সমান। সে তুলনায় আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাক হোলটির আকার নিতান্তই ছোট। প্রায় ২০০০ ভাগের এক ভাগ। দূরত্ব ও আকারের এই তারতম্যের কারণে আমাদের দৃষ্টিতে ব্ল্যাক হোল দুটো শেষমেষ আকারে প্রায় সমান হয়ে ধরা দেয় (দৃষ্টিকোণের কারণে)।
তার উপর আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাক হোলের তুলনায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের M87 ব্ল্যাক হোলটি অনেক বেশি সক্রিয়। আমাদের দৃষ্টিতে M87 ও স্যাজিটারিয়াস এ ব্ল্যাক হোল দুটি আকারে সমান হয়ে ধরা দিলেও প্রকৃতপক্ষে M87 ব্ল্যাক হোলটি আকারে অনেক অনেক বড় হওয়ায় ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিক থেকে M87 ব্ল্যাক হোলটির অবস্থান পৃথিবীতে অবস্থিত দূরবীনগুলোর জন্য সুবিধাজনক হওয়ায় ছবি তোলার জন্য বিজ্ঞানীরা সেটিকেই লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে।
কিন্তু ব্ল্যাকহোলের যে ছবি দেখে সারা বিশ্ব এভাবে উদ্বেলিত, আসলেই কি সেটি ব্ল্যাক হোলের ছবি? আমরা কি ব্ল্যাক হোলের উপর ক্যামেরা ফোকাস করে ক্লিকের মাধ্যমে ছবিটি তুলেছি? মূলত ছবি বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, ব্ল্যাক হোলের ছবিটি প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বরং অসংখ্য তথ্যের সমন্বয়ে গড়া রিকন্সট্রাকশান। মহাশূন্যের যেসব ছবি আমরা দেখি তাদের বেশিরভাগই সাধারণ ক্যামেরায় তোলা ছবি না। বরং রিকন্সট্রাকশান। ছবি হিসেবে আমরা যা দেখি এগুলো আসলে তথ্য। তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা ছবি তৈরি করে আমাদের দেখান।
মনে করুন, আপনি একটি ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। ভীড়ের কারণে আপনি আপনার সামনের সর্বোচ্চ কয়েকজন মানুষের চেহারা দেখতে পাবেন। আপনার সামনের কয়েকজনের পর বাকিদের চেহারা কিন্তু আপনি ভীড়ের কারণে দেখতে পাবেন না। কিন্তু আপনার কাছে যদি এমন কোনো প্রযুক্তি থাকে যার দ্বারা আপনি আপনার সামনের মানুষদের ভেদ করে তাদের পেছনে কি আছে সেগুলো দেখতে পাবেন, কেবল তখনই আপনার পক্ষে আপনার সামনে থাকা বাধার পেছনের জিনিসগুলো দেখা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই মহাবিশ্বের দূর-দূরান্তের ছবি সাধারণ মানুষের সামনে তাদের বোধগম্য উপায়ে উপস্থাপন করে থাকেন। তাই এই ছবিগুলোকে সে অর্থে ছবি বলা যায় না।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মনে করুন, আপনি মাটিতে একজন ব্যক্তির ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। সেই ছায়ার আকৃতি কাগজে এঁকে আপনি দাবি করলেন যে এটি সেই ব্যক্তির দেহাবয়ব। কিন্তু আপনি তো সেই বক্তিকে কখনো দেখেননি। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে সেই ব্যক্তিকে কেউ সরাসরি দেখতে পেলে তিনি আবিষ্কার করবেন, আপনি ছবিতে যেমন দেহাবয়ব দেখিয়েছেন সে ব্যক্তির দেয়াবয়ব আসলেই তেমন। ছায়া দেখে আঁকা আপনার ছবিটি তাই একধরনের রিকন্সট্রাকশান।
মহাবিশ্বের গ্যাস, ধূলাবালি ইত্যাদির কারণে বহু দূরের নক্ষত্র আমাদের ক্যামেরা ভালোভাবে দেখতে পায় না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে ছবি তুলে থাকে। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এ অংশগুলো রেডিও ওয়েভ বা ইনফ্রারেড হয়ে থাকে। যেসব ক্যামেরা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইনফ্রারেড অংশকে ব্যবহার করে ছবি তোলে তাদের বলা হয় ইনফ্রারেড ক্যামেরা। মহাবিশ্বের যে ছবিগুলো আমরা দেখি তার অনেকগুলোই এ ধরনের ক্যামেরায় তোলা। সম্প্রতি যে ব্ল্যাক হোলটির ছবি প্রকাশ করা হয়েছে এটির নাম M87। যে ক্যামেরার ব্যবহার করে এই ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা হয়েছে এটির নাম ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ, যা রেডিও ওয়েভ ও ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যবহারে ছবি তুলেছে।
পৃথিবী থেকে ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের এই ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা পৃথিবী থেকে চাঁদের উপর রাখা কমলার ছবি তোলার মতো। কিন্তু এত দূর থেকে ছবি তুলতে যে আকারের দূরবীণ দরকার সে আকারের দূরবীন বানানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সে রকম একটি দূরবীণের আকার হবে পৃথিবীর সমান!
এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত ৮টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দূরবীণ ব্যবহার করেছেন। দূরবীণগুলো স্থাপন করা হয়েছে এমন জায়গায় যেখানে রাতের আঁধারে লোকালয়ের আলো পৌঁছে না। ফলশ্রুতিতে, মনুষ্যসৃষ্ট শহরের কৃত্রিম আলো বিজ্ঞানীদের ছবি তোলার পথে অন্তরায় হতে পারেনি। দূরবীণগুলো স্থাপন করা হয়েছে এমন সব জায়গায়, যেমন পাহাড়ের অনেক উঁচুতে, যেখানে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতি খুব কম। ফলশ্রুতিতে, বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প বহুদূরের দৃশ্য দেখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হতে পারেনি।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা এই ৮টি টেলিস্কোপ থেকে রেডিও ওয়েভ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে নিখুঁতভাবে একই সময়ে তোলা ছবিগুলো একসাথে করে ব্ল্যাকহোলের চূড়ান্ত একটি ছবি দাঁড় করানো হয়। এক্ষেত্রে পৃথিবীর ঘূর্ণন ছবির উচ্চ রেজলুশান পেতে সহায়তা করেছে। কারণ দূরবীণগুলো নিজেদের অবস্থানে স্থির থাকলেও পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে, মহাবিশ্বের সাপেক্ষে, ১২ ঘণ্টায় পৃথিবীর ব্যাসের সমান দূরত্ব ভ্রমণ করেছে।
পৃথিবীর সাথে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা যে দূরত্ব অতিক্রম করেছে সেই পুরো পথে ছবি তুলতে থাকার ফলে শেষ পর্যন্ত এই ৮ টি দূরবীণ মিলে পৃথিবীর সমান একটি ভার্চুয়াল দূরবীণের সৃষ্টি করেছে, ফলশ্রুতিতে ছবিগুলোর রেজলুশান বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ছবিগুলো যেহেতু কনভেনশানাল ক্যামেরায় এক ক্লিকে তোলা কোনো ছবি নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রহ করা অসংখ্য তথ্যের সমন্বয়ে গড়া রিকন্সট্রাক্ট, তাই ব্ল্যাক হোলের যে ছবিটি আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটি আসলে আমরা ছবি বলতে যা বুঝি ঠিক তা নয়। অসংখ্য তথ্যের সমন্বয়ে গড়া ব্ল্যাক হোলটির রিকন্সট্রাকশান। তবে ব্ল্যাক হোলটির সত্যিকারের চিত্র বোঝার জন্য এটি পর্যাপ্ত ও যথেষ্ট।
মহাবিশ্বের ধুলো, গ্যাসের বাধা পেরিয়ে বহুদূরের ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলার জন্য বিজ্ঞানীরা পরোক্ষ পদ্ধতির সহায়তা নিলেও যে ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটি ব্ল্যাক হোলটির নির্ভরযোগ্য ছবি। ক্যামেরা দিয়ে এক ক্লিকে তোলা ছবি বলতে আমরা যা বুঝি এটি হয়তো তেমন কোনো ছবি নয়, কিন্তু মানবজাতির সীমাহীন আগ্রহের খোরাক মেটানোর পথে এই ছবি বিশাল এক অগ্রগতি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, কে জানে, একদিন হয়তো আমরা ক্যামেরায় একটি ক্লিক করেই বহুদূরের কোনো ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলতে সমর্থ হবো। সে রকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও স্বপ্ন দেখতে তো আর দোষ নেই।