মনে করুন, আপনি একা বসে আছেন। আসলে বসে থাকা ঠিক বলা যাবে না, ভেসে আছেন বললেই ভালো হবে। কারণ, আপনার রকেটের ককপিটে কোনো মহাকর্ষ নেই। ভেসে আছেন স্বচ্ছ কাঁচের জানালার নিচের হাতল ধরে, আপনার হাত ছোঁয়া দূরত্বেই চাঁদ, এ চাঁদকে ঘিরেই ঘুরছে আপনার রকেট। তবে মনে রাখবেন, এ চাঁদ কিন্তু পৃথিবীর আকাশের ওই সুন্দরী ষোড়শী চাঁদ নয়। এ চাঁদ আশি বছরের বৃদ্ধা! ওর গায়ের ফাটলগুলো (নানা কারণে সৃষ্ট গর্ত) পুরোপুরি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ভালো লাগছে না? জানালার উপরের কোণায় তাকাতেই চোখে পড়ল শুভ্র নীলাভ পৃথিবী। চোখ জুড়িয়ে গেল, কিন্তু আপনার চোখ ভিজে উঠল, চেষ্টা করেও নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। কেননা কিছুক্ষণ আগেই কেটে গেছে পৃথিবী থেকে আসা শেষ রেডিও সিগন্যাল। ওই দূরের নীলাভ গ্রহটিতেই আছে আপনার পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, ভালবাসার মানুষটি। জানেন না ফিরে যেতে পারবেন কিনা। কথা বলার জন্যও কোনো মানুষ নেই। আপনি পুরোপুরি একা- দুনিয়ার সবচেয়ে একাকী মানুষ।
কেমন লাগবে আপনার তখন? এ যেন কল্পবিজ্ঞানের চেয়েও বেশি কিছু- বাস্তব ঘটনা! আর এই পরিস্থিতিতে যিনি ছিলেন তাকে বলা হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে একাকী মানুষ। তার নাম মাইকেল কলিন্স, অনেকে হয়তো শুনে থাকবেন তার নাম, তিনি পৃথিবীর বিখ্যাত আনসাং হিরোদের মধ্যে একজন।
১৬ জুলাই, ১৯৬৯; কেনেডি স্পেস সেন্টার, একজন রীতিমত ধাক্কা দিয়ে করিডোরের দরজা খুলে ছুটলেন লঞ্চ কন্ট্রোল সেন্টারের দিকে। অনেকক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করছেন শার্টের হাতার বোতাম লাগাতে, কিন্তু পারছেন না। এ কারণে কিছুটা বিরক্ত, মানসিক চাপ ঠিকই বুঝতে পারছেন। এক ফাঁকে ঘড়িটা দেখে নিলেন, ৮টা বেজে গেছে। হাতার বোতাম লাগাতে লাগাতে ঢুকলেন সেন্টারে, অনেক মানুষ, কথাবার্তাও হচ্ছে, কিন্তু পুরো পরিবেশ জুড়েই কেমন যেন একটা অস্থিরতা, কারণটা তার অজানা নয়।
ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেলেন তিনজন এক পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তাদের দেখেই এগিয়ে গেলেন। ওখানকার বাম পাশের হাফ হাতা শার্ট পরা মানুষটি হলেন চার্লস ডব্লিউ ম্যাথিউস, মনুষ্যবাহী স্পেস ফ্লাইট এর ডেপুটি এসোসিয়েট এডমিনিস্ট্রেটর উনি। আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সাদা চুলের, গলায় বাইনোকুলার ঝুলানো লোকটি জার্মান মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার ড. ভার্নার ভন ব্রাউন, মার্শাল স্পেস সেন্টারের ডিরেক্টর। তাদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন এপোলো প্রোগ্রামের ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যামুয়েল সি ফিলিপ্স।
তাকে দেখেই তিনজনের মুখে হাসি ফুটে উঠল, এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলেন, ততক্ষণে হাতার বোতাম লাগানো হয়ে গেছে। ওদের সাথে কথা বলছিলেন এমন সময় একজন এসে তাকে তার আইডি কার্ড দিয়ে গেল। একবার দেখে নিলেন, উপরে ছবি আর নিচে নাম, জর্জ মুলার, সাথে পদবিটাও দেয়া আছে, মনুষ্যবাহী স্পেস ফ্লাইটের এসোসিয়েট এডমিনিস্ট্রেটর। একটু হেসে নিলেন, নাহ! ছবিতে তাকে ভালই দেখাচ্ছে। কার্ডটা বুক পকেটে লাগিয়ে আবার কথায় মগ্ন হলেন। আসলে প্রথমবারের মতো মানুষকে চাঁদে পাঠনোর মিশন আর তার উপর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মহাকাশ প্রতিযোগিতা, সব মিলিয়েই সেদিন চাপে ছিলেন এপোলো ১১ এর সংশ্লিষ্ট সকলে।
সকাল ৯.৩০ মিনিটে গর্জে উঠল স্যাটার্ন-ফাইভ রকেটের ইঞ্জিন। কমান্ড মডিউল কলাম্বিয়া আর লুনার মডিউল ঈগলকে সাথে নিয়ে ছুটে চলল চাঁদের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী শুধু তিনজন মহাকাশচারী- কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং, কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স আর লুনার মডিউল পাইলট এডউইন বাজ অলড্রিন; স্বপ্ন তাদের চাঁদ জয় করার।
যাত্রা শুরুর ৭৫ ঘন্টা ৫০ মিনিট পর ১৯ জুলাইয়ে যখন তারা চাঁদের অপর পাশে পৌঁছুলেন, তখনই মুখোমুখি হলেন এক কঠিন বাস্তবতার। প্রথমবারের মতো তাদের সাথে পৃথিবীর রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো, যদিও তারা জানতেন চাঁদের চারদিকে প্রতিবার ঘূর্ণনের মধ্যে কিছু সময়ের (প্রায় ৪৮ মিনিট) জন্য তাদের সাথে পৃথিবীর কোনো যোগাযোগ থাকবে না।
২০ জুলাই, মিশন শুরুর ১০০ ঘন্টা ১২ মিনিট পর বাজ অলড্রিন আর নীল আর্মস্ট্রং কলাম্বিয়া ছেড়ে ঈগলে করে ছুটলেন ইতিহাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, আর ওদিকে একা রয়ে গেলেন মাইকেল কলিন্স। তিনি জানেন, আর কিছুক্ষণ পরেই তিনি হয়ে যাবেন পুরোপুরি একা, পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন।
পরে তিনি তার আত্মজীবনী ক্যারিয়িং দ্য ফায়ার বইয়ে লিখেছিলেন সেই সময়ের অনুভূতির কথা। যদিও তিনি ইতিহাসে মোটামুটি ভুলে যাওয়া এক নাম এবং একইসাথে তার কাজ বাকি দুইজনের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তারপরও তিনি ঐ মিশনে তার ভূমিকাকে কম গুরুত্ববহ মনে করেননি। হ্যাঁ, তিনি ঐ সময় একাকিত্ব অনুভব করতেন। সেটা আরো জোরদার হতো যখন প্রতিবার চাঁদের ওপাশে গেলে পৃথিবী থেকে আসা রেডিও সংযোগ কেটে যেত তখন। সে সময়টায় তার না ছিল পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ, না ছিল চাঁদের ঐ দুজনের সাথে, তখনকার অনুভূতি তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে,
“আমি এখন একা, আসলেই একাকী, আর জানা যেকোনো রকম প্রাণের উৎস থেকে আমি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। যদি হিসাব করা যেত, তবে দেখা যেত ফলাফলটা হত- চাঁদের ওপাশের স্কোর তিন বিলিয়ন (তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যা) যোগ দুই আর এপাশে এক যোগ আর কী আছে তা স্রষ্টাই জানেন।”
তবে তাকে এ চিন্তা বেশিক্ষণ কাবু করে রাখতে পারেনি, কারণ তিনি তার বাকি দুই বন্ধুকে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন। তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন তার সহ-অভিযাত্রীরা যদি ফিরে না আসতে পারে; তার উপর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, যদি লুনার মডিউল ঈগলের লঞ্চিং সিস্টেম কাজ না করে বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন কমান্ড মডিউল কলাম্বিয়ায় ফিরে না আসতে পারে, তবে তাকে মিশন স্থগিত ঘোষণা করে পৃথিবীতে একাই ফিরে আসতে হবে। এমনকি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জন্য ঐ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একটি বক্তব্যও তৈরি করে রাখা হয়েছিল। তাই সহযোগী দুই অভিযাত্রীর চাঁদে কাটানো প্রায় ২২ ঘণ্টা সময় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন নিজের কাজে আর তাদের চিন্তায়, যাতে একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরতে না পারে।
এমনও সময় গেছে যখন মনে হয়েছে যদি তিনি একা ফিরে যান, তবে পৃথিবী তাকে আজীবন এ ব্যর্থতার জন্য মনে রাখবে। তা হয়ত তার জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলবে। প্রথমবারের মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন যখন জানতে পারলেন ঈগল দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে কলাম্বিয়ায় ফিরে আসছে, হয়তবা সেসময় তার চোখের কোণে কিছুটা পানি জমেছিল, হয়তবা নিজেও সেটা খেয়াল করেননি। ঈগল দৃষ্টিগোচর হবার কিছুক্ষণ পরেই তুললেন এপোলো মিশনের একটি বিখ্যাত ছবি, যেখানে তিনি নিজে ব্যতীত পৃথিবীর সকল মানুষই (জীবিত অথবা মৃত) ছিলেন। এভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে একাকী মানুষ তাঁর সবচেয়ে একাকী মুহূর্তগুলো কাটিয়েছিলেন।
২৪ জুলাই, ১৯৬৯; মিশন শুরুর ১৯৫ ঘন্টা ১৮ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড পর তিন অভিযাত্রীই সুস্থভাবে ফিরে এলেন পৃথিবীতে। চাঁদকে জয় করে সৃষ্টি করলেন ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের। এদের মধ্যে নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন হয়ে উঠলেন পরিচিত নাম। আর মাইকেল কলিন্স অনেকটা অচেনা হয়েই হারিয়ে গেলেন ইতিহাসের অতলে।
মাইকেল কলিন্স জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ৩১ অক্টোবর ইতালির রোমে। তাঁর বাবা ছিলেন ইউ এস আর্মির মেজর জেনারেল জেমস লটন কলিন্স। জীবনের প্রথম ১৭ বছর কেটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবারসহ চলে আসেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। তিনি ১৯৫২ সালে ইউ এস মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। সেখান থেকে নাসা কর্তৃক ১৯৬৩ সালে মহাকাশচারী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই মানুষটি নিজেকে নায়ক স্বীকার করতে নারাজ। তিনি মনে করেন, তারা শুধু নিজেদের কাজটুকু করেছেন, এর বাইরে কিছু করেননি। মাইকেল কলিন্স এপোলো ১১ মিশনের আগে ১৯৬৬ সালে জেমিনি ১০ মিশনে পাইলট হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেটি ছিল তিনদিনের একটি স্পেস ফ্লাইট মিশন। এছাড়াও তার আরেকটি বড় অর্জন ছিল ইতিহাসের প্রথম মানুষ হিসেবে একাধিকবার এক্সট্রা ভেহিকুলার এক্টিভিটি (স্পেসওয়াক) সম্পন্ন করা। এই কর্মঠ লোকটি নিজের কাজ নিয়ে অহংকার করেননি, আসতে চাননি প্রচারের আলোয়। কাজ যত ছোট হোক আর বড়ই হোক, নিজের কাজটুকু নিজের মতো করে যাচ্ছেন, আর দৃষ্টান্ত রেখেছেন সবার কাছে। নীরবে দুনিয়া বদলের একজন হয়ে।
Featured Image: Famous Birthdays