ছোট্ট দুষ্টু-মিষ্টি একটা বিড়াল, খরগোশ কিংবা ইঁদুরকে আমরা সবাই ভালোবাসি। কিন্তু এরাই হয়ে যায় গবেষণার ‘গিনিপিগ’, যখন মানুষ গবেষণা করে, নতুন কিছু জানতে চায় আর নতুন কোনো পণ্য পরীক্ষা করে। বলছিলাম গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণীদের কথা। আপনি হয়তো আপনার বাসায় ইতিউতি দৌড়ে বেড়ানো বাচ্চা ইঁদুরটাকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু সেই একই সময়ে এমনই কোনো ইঁদুর হয়তো কোনো গবেষণাগারের খাঁচার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে। অপেক্ষা করছে কখন বিজ্ঞানের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করার জন্য তাকে কাটাকুটি করা হবে, ফেলে দেওয়া হবে বিপদের মুখে। কখনো প্রশ্ন আসেনি আপনার মনে, জানতে ইচ্ছে হয়নি যে, এই প্রাণীগুলো কোথা থেকে আসে? কী করা হয় এদেরকে নিয়ে ল্যাবরেটরির মধ্যে? চলুন আজ একটু জেনে নিই গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণী আর ওদের জীবন সম্পর্কে।
ইঁদুর কেন এগিয়ে থাকে?
তথ্যটি অনেকটা সবারই জানা যে, পরীক্ষাগারে পরীক্ষা চালানোর জন্য সবচাইতে বেশিবার ব্যবহার করা হয় ইঁদুরকে। গবেষণা করা হবে কোনো প্রাণীর উপরে, তা শুনলেও প্রথমে মনে হয় কোনো ইঁদুরের কথা। কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। ফাউন্ডেশন ফর বায়োমেডিক্যাল রিসার্চের দেওয়া এক তথ্য মতে, গবেষণাগারে ৯৫ শতাংশ সময়েই ইঁদুর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কেন ইঁদুর এগিয়ে থাকে ল্যাব অ্যানিমেল হওয়ার এই দৌড়ে সেটা কখনো জানতে ইচ্ছে করেছে?
মূলত, ইঁদুর একটি খুব ছোট্ট, কম খরচে পালন করা যায় এমন প্রাণী এবং এরা দুই থেকে তিন বছর বাঁচে। ফলে, খুব সহজে একটি ইঁদুরকে পালন করা যায়। যেকোনো পরিস্থিতিতে খুব অল্প সময়েই নিজেকে মানিয়ে নেয় ইঁদুর। কম সময় বাঁচে বিধায় ইঁদুরের কয়েকটি প্রজন্মের উপরে খুব কম সময়ের মধ্যেই একসাথে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। এটাও ইঁদুরকে গবেষণাগারে বেশি ব্যবহার করার অন্যতম একটি কারণ। তবে সবচাইতে বড় কারণ এক্ষেত্রে মানুষের সাথে ইঁদুরের শরীরের মিল। ইঁদুর এবং মানুষের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলো প্রায় একই রকমভাবে পরিচালিত হয়। যেটা দিনকে দিন আরো বেশি মিলে যাচ্ছে একে অন্যের সাথে। আর এই কারণেই মানুষের উপরে কোনো পরীক্ষা করার চাইতে সেই পরীক্ষা ইঁদুরের উপরে করাটাকেই বেশি ফলপ্রসূ ও সহজ বলে মনে করা হয়।
কোথায় পাওয়া যায় এদের?
এদের বিভিন্ন উপায়ে পাওয়া যায়। অন্তত মানুষ বেশ কয়েকটি উৎস বেছে নিয়েছে এদেরকে পাওয়ার জন্য। এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ল্যাবরেটরির মধ্যেই প্রাণীদের সন্তান উৎপাদন করা। তবে কিছু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আছে যাদের মূল কাজই হচ্ছে ল্যাবরেটরির জন্য প্রাণী জন্ম দেওয়া। এতে করে খুব কম খরচে ও কম সময়ে প্রচুর প্রাণী পেয়ে যায় বিজ্ঞানীরা। তবে এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি সমস্যা হয় ক্লাস বি ডিলারদের কারণে। এরা কোনো উৎপাদন কিংবা বৈধ উপায়ে যায় না। বরং বেছে নেয় অপহরণ এবং চুরির পথ। সেক্ষেত্রে অনেক সময় অনেক পোষা কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্য প্রাণীরাও হুমকির মুখে পড়ে যায়। মোট দুটো ক্লাস আছে ল্যাবরটরিতে প্রাণী সরবরাহকারীদের। সেগুলো হলো ক্লাস এ এবং ক্লাস বি। ক্লাস এ ডিলার বলা হয় তাদেরকে যারা বৈধ ছাড়পত্রপ্রাপ্ত।
নিয়ম মেনে বাচ্চা উৎপাদন করিয়ে সেগুলোকে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় এক্ষেত্রে। অন্যদিকে, ক্লাস বি ডিলারেরা যেকোনো উৎস থেকেই প্রাণীর সরবরাহ পেয়ে থাকে। সেটা হতে পারে পত্রিকার মাধ্যমে, চুরি কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া প্রাণী, কখনো আবার রাস্তায় ঘুরতে থাকা অসহায় কোনো প্রাণীকে তুলে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয় এই ক্ষেত্রে। তৃতীয় আরেকটি উপায়ে পাওয়া যেতে পারে ল্যাবরেটরির প্রাণীদেরকে। আর সেটি হল পশু আশ্রয় থেকে। পশু পাখীদের অসহায় অবস্থায় কিংবা কোনো সমস্যার কারণে তুলে লালন করার পর সেখান থেকে পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য সরবরাহ করা হয়। তবে বৈধ এই উপায়গুলোর বাইরে পুরোপুরি অবৈধ উপায়ে চুরি করে প্রাণীদের সরবরাহ করে অনেকে। এসব ক্ষেত্রে প্রাণীটিকে চুরি করা হয়েছে কিংবা অপহরণ করা হয়েছে- এর কোনোটাই আমলে নেওয়া হয় না। ক্রেতা এবং বিক্রেতা দুজনেই গোপনে সেরে ফেলেন কাজটি। সাধারণত, কোনো গোপন পরীক্ষা করতে হলে কিংবা কম টাকায় প্রাণী পাওয়ার জন্য এমনটা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে খুব আদরের কোনো পোষা প্রাণীকেও জীবনের অনেকটা সময় কাটাতে হয় খাঁচার মধ্যে কিংবা মৃত্যুবরণ করতে হয় খুব জলদি।
ইঁদুর ছাড়া আর কে কে আছে এই ল্যাব অ্যানিম্যালের তালিকায়?
হয়তো গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণী হিসেবে বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করা হয় ইঁদুরকে। তবে কেবল ইঁদুর নয়, আরো অনেক প্রাণীকেই ব্যবহার করা হয় গবেষণাগারের গিনিপিগ হিসেবে। এদের মধ্যে এগিয়ে আছে ব্যাঙ, কুকুর, বিড়াল, শূকর, বানর, মাছ এবং পাখিসহ আরো অনেক প্রাণী। পিপল ফর দ্য এথিকাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিম্যালসের মতে, প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন প্রাণী ঔষধ, চিকিৎসা, জীববিজ্ঞান পড়াশোনার জন্য, রাসায়নিক, খাবার ইত্যাদির পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে মারা যায়। পরীক্ষার সময় তাদের ত্বক কখনো পুড়িয়ে ফেলা হয়, কখনো তাদের খুলির মধ্যে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে ফেলা হয়, কখনো তাদের জোর করে বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়, কখনো পুরোপুরি অজ্ঞান না করেই চালানো হয় অমানুষিক কার্যক্রম। হ্যাঁ, আর দশটা ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতির মতোই ব্যবহার করা হয় প্রাণীদেরকে পরীক্ষাগারে।
কিন্তু তাতে আমাদের আমাদের কিছুই আসে যায় না! মানুষের ভালোর জন্য কিছু কিংবা বেশ কিছু প্রাণী মারা যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেটাতো হতেই হবে, তা-ই না? নাহলে মানুষ জানবে কী করে যে কোনো পণ্য ঠিক করে কাজ করছে কিনা! এখানে আবার কিছু হাস্যকর ব্যাপার আছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে- হাসিখুশি প্রাণী নিশ্চিতকরণ।
ব্যাপারটা খুব হাস্যকর নয় কি? আপনি যেকোনো সময়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন, আপনার চারপাশের পরিস্থিতি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে- তারপরেও আপনি হাসিখুশি থাকবেন, সেটা নিশ্চয় একেবারেই সম্ভব নয়? বিশেষ করে যখন ইঁদুরকে কিংবা কোনো প্রাণীকে কোনো খাঁচার মধ্যে আটকে রাখা হয়, তখন তার খুশি হওয়াটা একেবারেই সম্ভব হয় না। সেটা কিনা আবার ভালো ফলাফলের জন্য খুব বেশি দরকারি। প্রশ্ন হল, এই পরীক্ষা কি বন্ধ করা যায় না? প্রাণীদের ব্যবহার করা ছাড়াও কি কোনোরকম গবেষণা করা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। অন্তত একপক্ষ তেমনটাই দাবি করছেন। তাদের মতে, মানুষের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এত বেশি বেড়ে গিয়েছে যে, কোনো প্রাণীকে ব্যবহার করা ছাড়াই পরীক্ষা সম্পন্ন করা এখন সম্ভব। কিন্তু সবাই কিন্তু তা ভাবছেন না। অন্যদের মতে, এমন করলে হয়তো সঠিক ফলাফল পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়বে। প্রশ্নটা এখনো মাঝামাঝি ঝুলে আছে। সত্যিই কি প্রাণী মৃত্যু ছাড়াই পরীক্ষা করা সম্ভব? সম্ভব হলেও সেটা কবে করা শুরু হবে? প্রশ্নটা এখন সবার মধ্যেই। হয়তো কখনো এই কথাগুলো বাস্তব হবে, প্রাণীদেরকে আর মরতে হবে না- এটুক্যুই আশা।
ফিচার ইমেজ: Science