আপাত দৃষ্টিতে কোনো প্রাণী দেখতে কেমন, তার শারীরিক গঠন কেমন, এসব তুলনা করে বলা যায় বাকি কোন কোন প্রাণীর সাথে এর মিল আছে। কুকুরের সাথে শেয়ালের মিল আছে, ইঁদুরের সাথে চিকার মিল আছে, বিড়ালের সাথে বাঘের মিল আছে (বাঘ একপ্রকার বিড়াল জাতীয় প্রাণী)। এক প্রাণীর সাথে আরেক প্রাণীর মিল থাকাকে বলা যায় প্রাণিজগতের আত্মীয়তা। তবে এরকম প্রকট মিল ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীরা পরস্পর আত্মীয়। আসলে এই পৃথিবীর সকল প্রাণীই একে অপরের আত্মীয়। কেউ কেউ কাছের আত্মীয় আর কেউ কেউ দূরের আত্মীয়।
কিন্তু শুধু দেহের আকৃতি বিশ্লেষণ করে কোনো প্রাণীর মাঝে মিল-অমিল, আত্মীয়তা নির্ণয় করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একটি প্রাণীর বাহ্যিক গঠন, অভ্যন্তরীণ গঠন, কোষীয় গঠন, এমনকি কোষের ভেতরের বস্তুর সাথে অন্য প্রাণীর তুলনা করলে যদি মিল পাওয়া যায়, তাহলে বলা যাবে তারা পরস্পর আত্মীয়। এখনকার দিনে তুলনা করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারটি হচ্ছে DNA।
DNA হচ্ছে একধরনের অণু। প্রায় সকল প্রাণীর কোষেই ডিএনএ থাকে। ডিএনএ অণুই একটি প্রাণীর সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং বহন করে। যেমন- কেউ দেখতে কালো হবে না ফর্সা হবে, কার রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বেশি হবে না অল্পতেই রোগ বাধিয়ে ফেলবে, কে লম্বা হবে না বেঁটে হবে ইত্যাদির সব কিছুই লেখা থাকে ডিএনএ-তে। ডিএনএর মাধ্যমেই পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের মাঝে সঞ্চারিত হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কোনো পরিবারে বাবা-মা দুজনেই যদি কালো হয়, তাহলে তাদের সন্তানেরাও কালো হয়ে থাকে। বাবা-মা দুজনেই লম্বা হলে তাদের সন্তানও লম্বা হয়ে থাকে। সন্তান তার মায়ের পেটে অবস্থান করার প্রথম দিন থেকেই মা ও বাবার বৈশিষ্ট্যগুলো বহন করা শুরু করে। এটা হয় ডিএনএ’র মাধ্যমে।
এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া সকল প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ও ছত্রাকের জীবন বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, কোন আকৃতি নিয়ে বেড়ে উঠবে- তা কয়েকটি নির্দিষ্ট ‘অক্ষরের’ মাধ্যমে লেখা থাকে। অক্ষরগুলো সাজানো থাকে ডিএনএ’র ভেতর। তাদের অক্ষরমালাতে মোট চারটি বর্ণ আছে। হ্যাঁ, ঠিকই দেখতে পাচ্ছি, মাত্র চারটি জিনিসের মাধ্যমেই এই প্রাণিজগতের সব কিছু লেখা আছে। যেমন করে ইংরেজি ২৬টি বর্ণ দিয়ে সমস্ত বিশ্বের বিবরণ লিখে ফেলা সম্ভব, তেমনই প্রাণিজগতের বেলাতেও চারটি মাত্র অক্ষর বা কোড দিয়ে প্রাণীদের সাতকাহন লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। এই অক্ষরগুলো হচ্ছে এডেনিন, থাইমিন, সাইটোসিন ও গুয়ানিন। সংক্ষেপে এদেরকে A, T, G ও C বলে ডাকা হয়।
বংশগতির একককে বলা হয় জিন। একই জিন বিভিন্ন প্রাণীর মাঝে থাকতে পারে এবং সেসব প্রাণীর মাঝে একই বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে FoxP2 জিনের কথা বলা যায়। এটি সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী সহ আরো অনেক প্রজাতির প্রাণীর মাঝে পাওয়া যায়। এই জিনটি ২ হাজারটিরও বেশি অক্ষর বা কোডের লম্বা একটি তন্তু।
নিচে কতগুলো অক্ষরের লম্বা লাইন আছে। এই লাইনগুলো FoxP2 জিনের একটি অংশ। এখানে মোট ৮০টি করে বর্ণ আছে। FoxP2 জিনের সম্পূর্ণ গঠনের মাঝে ৮৩১ থেকে ৯১০ তম ঘর পর্যন্ত মোট ৮০টি বর্ণ। উপরের সারিটি মানুষের জিনের গঠন, মাঝেরটি শিম্পাঞ্জীর ও নিচেরটি ইঁদুরের। লাইনের শেষের দিকে নিচের দুই লাইনের পাশে যে নাম্বার দেয়া আছে, সেগুলো দিয়ে বোঝাচ্ছে প্রথম লাইনের জিনের সাথে তাদের কত পরিমাণ অক্ষরের ভিন্নতা আছে সেটি। অর্থাৎ মানুষের FoxP2 জিনের সাথে শিম্পাঞ্জী ও ইঁদুরের FoxP2 জিনের কী পরিমাণ কোডগত পার্থক্য আছে তা বোঝাচ্ছে।
লাইনে থাকা এই সজ্জাটি দেখে বলে দেয়া যায়, সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর FoxP2 জিন প্রায় একইরকম। কারণ তাদের কোড সদৃশ্যপূর্ণ। এটা শুধু এখানে দেওয়া জিনের অংশের বেলায় নয়, সমস্ত জিনের গঠনের বেলাতেও প্রযোজ্য। কাছাকাছি একই রকম হলেও তারা শতভাগ সদৃশ নয়, পার্থক্য আছে। কোনো প্রাণীর বেলায় পার্থক্য বেশি আর কোনো প্রাণীর বেলায় পার্থক্য কম।
FoxP2 জিনের সম্পূর্ণ ২ হাজার ৭৬ পরিমাণ কোডের মাঝে মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জীর পার্থক্য আছে ৯টি কোডে। অন্যদিকে ইঁদুরের জিনের সাথে পার্থক্য আছে ১৩৯টি কোডে। FoxP2 জিন ছাড়া অন্যান্য জিনের বেলাতেও গড়পড়তা এমন মিল বা পার্থক্য বজায় থাকে। এই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে, শিম্পাঞ্জীরা কেন আমাদের খুব কাছের আত্মীয় আর ইঁদুররা কেন দূরের; শিম্পাঞ্জীরা কেন দেখতে অনেকটা মানুষের মতো আর ইঁদুররা কেন একদমই ভিন্ন রকম।
একই প্রজাতির প্রাণীর মাঝে জিনগত মিল থাকে সবচেয়ে বেশি। এক মানুষের জিনের সাথে আরেক মানুষের জিনের মিল থাকে সর্বাধিক। তবে অবশ্যই একজন মানুষ ‘ঠিক ঠিক’ অন্য একজন মানুষের মতো নয়। কোনো শিম্পাঞ্জীই ঠিক ঠিক অন্য শিম্পাঞ্জীর মতো নয়। ইঁদুর, তেলাপোকা, মশা, মাছি ইত্যাদি সকল প্রাণীর বেলাতেই এই কথাটি সত্য। পরীক্ষা হিসেবে আমরা আমাদের জিনকে একে অপরের সাথে তুলনা করে দেখতে পারি। আমার জিনের সাথে তুলনা করে দেখতে পারি ‘কদম আলী’ নামে কোনো একজন ব্যক্তির জিন; প্রতি অক্ষরে অক্ষরে, প্রতি কোডে কোডে। ফলাফল কী দেখা যাবে? দেখা যাবে, আমাদের জিনের মাঝে অনেক অনেক মিল পাওয়া যাচ্ছে। এত পরিমাণ মিল অন্য কোনো প্রাণীর সাথেই আমাদের কারোর নেই। কিন্তু তারপরেও আমাদের দুজনের জিনের মাঝে কিছু কিছু পার্থক্য থাকবেই। হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু থাকবে।
কদম আলীর জিন আমার জিনের সাথে তুলনা করলে দুজনের মাঝে যে পরিমাণ মিল পাওয়া যাবে, তার চেয়েও বেশি মিল পাওয়া যাবে তার কোনো আত্মীয়ের জিনের সাথে তুলনা করলে। তার কোনো মামাতো-খালাতো ভাই বা বোনের সাথে তুলনা করলে আমার চেয়ে বেশি মিল পাওয়া যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তার জিনের সাথে যাদের জিনের মিল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে তারা হচ্ছে তার বাবা-মা। যদি কোনো ভাই বা বোন থেকে থাকে, তাহলে তাদের সাথেও অনেক বেশি মিল পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকেই বলে ‘রক্তের সম্পর্ক’। রক্তের সম্পর্কগত দিক থেকে যারা বেশি আপন, তারা জেনেটিক দিক থেকেও বেশি আপন।
দুজন লোকের মাঝে কে কার কতটুকু কাছের, চাইলে তা পরিমাপ করে দেখা সম্ভব। তাদের পরস্পরের ডিএনএ তুলনা করলেই এই তথ্য বের হয়ে যাবে। তাদের ডিএনএ’র মাঝে থাকা কোডগুলোতে কতটুকু মিল আছে, তা দেখলেই বলে দেয়া যাবে।
এটা নিশ্চিত যে ডিএনএ’র কোডকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতে অনেক বৈপ্লবিক কিছু হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ লাগবে কেন? বর্তমানেই তো কত কিছু হয়ে যাচ্ছে একে পুঁজি করে! কোনো অপরাধীকে যদি পুলিশ ধরতে চায়, তাহলে ঐ আসামীর ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহ করে সহজেই ধরার কাজ এগিয়ে নিতে পারবে। ধরা যাক, বাংলাদেশে একটা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো, এতে দুজন মায়ের দুই সন্তান হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজার পর একটি মাত্র শিশুকে পাওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা বাধলো, দুই মা-ই দাবি করছেন, এই সন্তান তার নিজের। অন্যরাও চেহারা দেখে ঠাহর করতে পারছে না আসলেই এটা ঠিক কার। এই অবস্থায় কী করার আছে? এই পরিস্থিতিতে শিশু ও দুজন মায়ের ডিএনএ কোড বিশ্লেষণ করেই অকাট্যভাবেই বলে দেয়া সম্ভব, শিশুটির সত্যিকার মা আসলে কে। জিনগত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে তো ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে বিজ্ঞানের আলাদা একটি শাখাই গড়ে উঠেছে। এই শাখাটি যথেষ্ট সমৃদ্ধও।
আরো একটি ব্যাপার খেয়াল করি। যদি কেউ ইংল্যান্ডের বাসিন্দা হয় এবং সে কানাডার কোনো মানুষের সাথে নিজের তুলনা করে তাহলে দেখতে পাবে, কানাডীয় ও ইংরেজ ছেলে/মেয়ে দুটোর বংশগত পূর্বপুরুষের ধারা একত্রে মিলিত হয়েছে মাত্র কয়েক শত বছর আগে। অর্থাৎ অনেক অনেক আগে ইংরেজদের এমন একজন পূর্বপুরুষ ছিল যিনি আদতে কানাডীয়দেরও পূর্বপুরুষ। ঐ পুরুষের পর থেকে প্রজন্মের ধারা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যদি কেউ প্রাচীন (Native) তাসমানীয় কিংবা প্রাচীন আমেরিকানদের বংশধর হয় এবং নিজেদেরকে কানাডার কোনো ছেলে বা মেয়ের সাথে তুলনা করে তাহলে দেখা যাবে, তাদের পূর্বপুরুষের ধারা প্রায় দশ হাজার বছর আগে মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ কানাডীয় ও স্থানীয় আমেরিকান বা স্থানীয় তাসমানীয় জাতির দশ হাজার বছর আগেকার পূর্বপুরুষ একই ছিল (সংখ্যাটা একটু কম-বেশ হতে পারে)। একই পূর্বপুরুষ থেকে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা আলাদা জাতিতে পরিণত হয়েছে।
কিছু কিছু জিন আছে, এরা সকল জীবিত প্রাণী, উদ্ভিদ ও ব্যাকটেরিয়ার মাঝে একই রকম। এদেরকে বলা যায় সাধারণ জিন বা Common Gene। সকল প্রাণী, উদ্ভিদ ও ব্যাকটেরিয়ার মাঝে কিছু জিন এক রকম রয়ে যাওয়া কোনো সাধারণ বা দৈব ঘটনা নয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, সকল প্রাণী আসলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সকল প্রাণী কোনো না কোনো দিক থেকে আত্মীয়তার সম্পর্কে বাধা। এদের শিকড় অনুসন্ধান করলে এরা সকলে একটি অবস্থানে গিয়ে মিলিত হবে।
ফিচার ইমেজ- Bossy