বাঁহাতিরা কেন হারিয়ে যায়নি?

পরিসংখ্যান বলছে, যেকোনো পপুলেশনের মধ্যে বাঁহাতি মানুষ থাকতে পারে মোটামুটি ১০-১২ শতাংশের মতো। অর্থাৎ আপনার আশেপাশে যারা আছেন, তাদের মধ্যেও আপনি প্রতি ১০০ জনে এই ১০-১২ জনের চেয়ে খুব বেশি বা খুব কমসংখ্যক বাঁহাতি দেখবেন না। কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতার সাথে এই জিনিসটা মিলবে না, যখনই আপনি দেখবেন, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে বাঁহাতিদের ছড়াছড়ি। যেমন ধরেন, বিসিবির বর্তমান চুক্তিতে থাকা ২১ জন ক্রিকেটারের মধ্যে আমি ১৫ জনকে ধরলাম যারা ব্যাটিং করতে পারেন। এর মধ্যে ৭ জনই বামহাতে ব্যাট করেন। ১৫ জন ব্যাটারের মধ্যে এই সংখ্যাটা হচ্ছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। ব্যতিক্রমটি কেবল এই একটা পর্যবেক্ষণে সীমিত না। ২০১৮ সালে প্রকাশিত মার্কিন গবেষক ফ্রান্সোয়া ফ্যাগান এবং তার সহযোগীদের এই বিষয়ক একটি গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায়, ক্রিকেটের স্পেশালিস্ট ব্যাটার, বক্সিং, টেবিল টেনিস, বেসবলসহ বিভিন্ন খেলাতে খেলোয়াড়দের প্রায় ৩০ শতাংশ হচ্ছেন বাঁহাতি। প্রশ্ন দাঁড়াল, দুনিয়াতে এত কমসংখ্যক বাঁহাতিদের থেকে এত বেশিসংখ্যক বাঁহাতি খেলোয়াড়ের প্রাচুর্য কীভাবে?

Lefty batter Shakib Al Hasan
বাঁহাতে ব্যাট করছেন সাকিব আল হাসান; ছবিসূত্রঃ Teahub

 

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত গবেষক রেমন্ড এবং তার সহযোগীদের একটি লেখায় এর একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া যায়। তারা মূলত গবেষণা করেছিলেন বাঁহাতিদের অস্তিত্ব নিয়েই। দেখা গেছে, সেই পুরাতন প্রস্তরযুগে বাঁহাতিরা প্রথমবারের মতো দুনিয়াতে আগমন ঘটায়। তারপর থেকে হিসাব ধরলে মোটামুটি ১০ হাজার বছর ধরেই পৃথিবীতে বাঁহাতির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই ১০ শতাংশের আশেপাশে আছে। দুনিয়াতে যেহেতু ডানহাতিরাই সংখ্যায় অধিক, দুনিয়ার সকল কিছু যদি ডানহাতিদের সুবিধামতোই হয়, তাহলে বাঁহাতিরা বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এতদিনে বিলুপ্ত হবারই তো কথা। যেই জিনটির কারনে মানুষ বাঁহাতি হয়, সেই জিনটি কোন সুবিধার কারনে মানুষের মধ্যে এখনো রয়ে গেল, এই নিয়েই ছিল তাদের গবেষণা।

ছবিসূত্র: unsplash.com

 

তারা একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করালেন এই বলে যে, “বাঁহাতিরা মুখোমুখি লড়াইতে ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাডভান্টেজ পেয়ে থাকে।” ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাডভান্টেজটা সহজে বললে এরকম যে, পৃথিবীতে বাঁহাতিরা যেহেতু সংখ্যায় কম আর ডানহাতিরা বেশি, সেহেতু ওয়ান-অন-ওয়ান মোকাবিলার ক্ষেত্রে ডানহাতিরা ডানহাতিদেরকে এবং বাঁহাতিরাও ডানহাতিদেরকেই বেশি বেশি মোকাবেলা করে অভ্যস্ত। যখনই বাঁহাতি বনাম ডানহাতি মোকাবিলা করতে হয়, তখন ডানহাতি ব্যক্তিটি কিছুটা বেকায়দায় পড়ে অনভ্যস্ততার কারণে; অপরদিকে, বাঁহাতি ব্যক্তিটির কোনো সমস্যাই হয় না। এই হাইপোথিসিসটার আরেকটা নাম হল ‘ফাইটিং হাইপোথিসিস’।

হাইপোথিসিসটা পরীক্ষা করার জন্য তারা বেশ কিছু জরিপ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্পোর্টসে পারফরম্যান্সকে সম্মুখযুদ্ধে পারফরম্যান্সের একটি নির্দেশক হিসেবে ধরে নিয়ে তারা গবেষণার সাবজেক্ট হিসেবে নিলেন বিভিন্ন ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পোর্টস, যেগুলোতে একজন খেলোয়াড় বিপক্ষ খেলোয়াড়কে মোকাবিলা করে — যেমন ক্রিকেট, টেনিস, বেসবল ইত্যাদি। অন্যদিকে থাকলেন বিভিন্ন নন-ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পোর্টসের খেলোয়াড় — যেমন জিমন্যাস্টিক্স। গবেষণায় অংশ নেয়াদের মধ্যে তারা কোন হাত দিয়ে খেলার সরঞ্জামাদি চালনা করেন, কোন হাত দিয়ে লিখেন, প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে তাদেরকে বাঁহাতি অথবা ডানহাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পোর্টসে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা বাঁহাতির সংখ্যা নন-ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পোর্টসে অংশগ্রহণকারী কিংবা সাধারণ জনগণের মধ্যে শতকরা বাঁহাতির সংখ্যার তুলনায় বেশি। ১১ শতাংশের বিপরীতে ৩২ শতাংশ।

Image credit: Photo by Ian Flores on Unsplash

 

বাঁহাতিদের এই বেশি বেশি উপস্থিতিকে ব্যখ্যা করার জন্য ‘innate superiority hypothesis’ নামে আরেকটি হাইপোথিসিস ছিল, যেটা বাঁহাতিদের মস্তিস্কের বিশেষ গঠনের উপর জোর দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাঁহাতিরা তাদের মস্তিস্কের গঠনের জন্যই চোখে দেখা কোনো কিছুর প্রতি তুলনামূলক দ্রুত রেসপন্স করতে পারে এবং এই সুবধার জন্যই স্পোর্টসে তাদের অধিক সংখ্যায় দেখা যায়। এটি ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পোর্টসে বাম হাতিদের অধিক সংখ্যাকে ব্যখ্যা করতে পারলেও নন-ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পোর্টসে অধিক সংখ্যা না হওয়াকে ব্যখ্যা করতে পারে না। ফাইটিং হাইপোথিসিসের এই ধরনের কোনো সমস্যা নাই।

২০০৪ সালে রেমন্ড ও তার সহযোগীরা তাদের এই হাইপোথিসিসটি সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকর তা যাচাই করেন। এর জন্য তারা ক্যামেরুন, বুরকিনা ফাসো, পাপুয়া নিউগিনি, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশের মোট ৮ টি জনগোষ্টির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করলেন। দেখা গেল, মারামারি বেশি হয়, হোমিসাইড রেট বেশি, এমন জনগোষ্টিগুলোতে বাঁহাতির সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বেশি। গবেষণার আওতাভুক্ত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হোমিসাইড সংঘটিত হয় ভেনেজুয়েলার ইয়ানোমামোদের মধ্যে যেখানে বাঁহাতির সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ২২.৬ শতাংশ। অপরদিকে সবচেয়ে কম সংখ্যক হোমিসাইড সংঘটিত হয় বুরকিনা ফাসোর ডিওলাদের মধ্যে, যেখানে বাঁহাতির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। তাদের গবেষণা এমন কোনো দাবি করেনি যে বাঁহাতিদের আধিক্য কোথাও বেশি হোমিসাইডের কারণ। বরং তাদের দাবি ছিল, যেখানে হোমিসাইড রেট বেশি, সেখানে মারামারি বেশি; আর বেশি মারামারির ক্ষেত্রেই বাঁহাতিরা একটা অতিরিক্ত সুবিধা পায় যা তাদেরকে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি টিকে থাকতে সাহায্য করে। এই হাইপোথিসিসের ফলাফল অনুযায়ী দেখা গেল, নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে নারীদের থেকে পুরুষেরা বাঁহাতি বেশি, ৮ শতাংশ বনাম ১০ শতাংশ। কারন পৃথিবীতে পুরুষ-পুরুষ যুদ্ধই বেশি হয়েছে, আর বাঁহাতি পুরুষেরা এই সুবিধা ভোগ করেছে।

ছবি সূত্র: The times

 

তারা উপসংহার টানলেন যে বাঁহাতিরা সম্মুখযুদ্ধে যে বাড়তি সুবিধাটি পায়, সেটিই বাঁহাতি হবার জন্য দায়ী জিনটিকে টিকিয়ে রাখে। আর বাঁহাতিদের সংখ্যা ১০ শতাংশের আশে পাশে স্থির থাকার ব্যাপারটা চেক এন্ড ব্যালেন্স দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। বাঁহাতিদের এই সংখ্যাটি খুব বেশি বেড়ে গেলে বাঁহাতি হওয়ার সুবিধাও কমে আসবে। বাঁহাতিদের জন্য পৃথিবীতে বাঁহাতি যত কম, ততই ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাডভান্টেজ ভোগ করার সুযোগ ছিল।

বর্তমান আধুনিক সমাজে অন্যান্য নানান ফ্যাক্টরের ভীড়ে এই বাঁহাতি-ডানহাতি ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল সুবিধা-অসুবিধার প্রভাব আর আগের মতো খুব বেশি নেই। এখন যে ওয়ান-অন-ওয়ান খেলাতে এটির দেখা পাওয়া যায়, তা-ও কমে আসতে পারে, বর্তমান সময়ে উন্নত প্র্যাক্টিস সুবিধা, প্রতিপক্ষকে আরও ভালোভাবে আগে থেকে অ্যানালাইসিস করতে পারার সুবিধা প্রভৃতির কারণে। আর যুদ্ধের ক্ষেত্রে বর্তমানের অস্ত্রগুলোর মুখে বাঁহাতি সুবিধা ব্যবহারের কথা তো এখন আর দুঃস্বপ্নই।

This article is in Bangla language. It is about the fighting hypothesis and polymorphism in human handedness. 

Featured Image: Photo by Luis Quintero on Unsplash 

References:

https://www.scq.ubc.ca/the-fighting-hypothesis-stability-of-polymorphism-in-human-handedness/

https://doi.org/10.1515/jqas-2017-0076

https://www.aljazeera.com/news/2004/12/9/why-lefties-have-not-been-left-behind

Related Articles

Exit mobile version