পৃথিবীতে আমরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। সারা দুনিয়ার সমস্ত জিনিস নিয়েই চিন্তা আমাদের। এত কিছু ভাবা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ে আমরা কতটা ভাবি? একবার ভেবে দেখুন তো আপনার আক্কেল দাঁত ঠিক কোন কাজে লাগে? কিংবা আপনার এপেনডিক্স নামের অঙ্গটি? ভেবে পাচ্ছেন না? না জানার কারণ হলো, এগুলোর আদৌ কোনো ব্যবহারই নেই!
হয়তো দূর অতীতে কখনো এদের ব্যবহার ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেসব প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে গিয়েছে। ফলে এদেরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণ কাজ এরা এখনও করে থাকে অবশ্য। কিন্তু সেগুলো আসলে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। এদেরকে বলা হল ভেস্টিজিয়াল অঙ্গ (Vestigial Organ) বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ। মানব দেহে একটি-দুটি নয়, কমপক্ষে ১০০টির বেশি নিষ্ক্রিয় অঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি নিয়ে কথা বলবো আজ।
এপেনডিক্স
নিষ্ক্রিয় অঙ্গের কথা বললে প্রথমেই যার কথা মনে পড়ে তার নাম এপেনডিক্স। এপেনডিক্সের নাম শোনেনি এমন মানুষ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না, যদিও তারা আসলে ভুলভাবে শুনে থাকে। এপেনডিসাইটিস শব্দকেই আমরা মেরে কেটে এপেনডিক্স বলে চালিয়ে দেই। প্রকৃতপক্ষে এপেনডিক্স হচ্ছে একটি ছোট্ট আঙ্গুলের মতো অঙ্গ। আমাদের পরিপাকতন্ত্রে যেখানে ক্ষুদ্রান্ত্র গিয়ে বৃহদন্ত্রের সাথে মিলেছে সেই জায়গাটির নাম হলো সিকাম। বেশ একটা থলির মত জায়গা। সেখানেই থাকে এপেনডিক্স।
আপনার শরীরে ডানপাশে কোমরে হাত দিলে একটি হাড়ের অংশ হাতে বাঁধে (হাত না দিতে ইচ্ছা হলে বডিবিল্ডারদের দেখুন। তাদের শরীরে এক পলক তাকালেই দেখা যায় হাড়টি)। এই হাড় আর নাভি বরাবর দাগ দিলে যে রেখাটি পাওয়া যায় সেই রেখার নিচেই এর অবস্থান। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, পুরো রেখাটিকে দুইটি বিন্দু নিয়ে সমান তিন ভাগে ভাগ করুন। তারপর নাভী থেকে দূরের বিন্দুর উপর আঙ্গুল রাখুন। এবার আপনার আংগুলের ঠিক নিচে বসে রয়েছে এপেনডিক্স।
এপেনডিসাইটিসের প্রচন্ড যন্ত্রণা দেওয়া ছাড়া এপেনডিক্স আমাদের দেহে ঠিক কী কাজ করে, তার ঠিকঠাক হদিশ পাওয়া যায় নি। তবে হ্যাঁ, সে কাজ করতো! দূর অতীতে যখন মানুষ সভ্য হয়ে ওঠেনি, তখন মানুষের খাবারের বড় অংশ ছিলো বৃক্ষজাত খাদ্য এবং রান্না না করা মাংস। আর বৃক্ষজাত খাবারে সেলুলোজের পরিমাণ বেশি থাকে, যাকে আমরা আঁশ হিসেবে চিনি। এই আঁশকে ভাঙার জন্য প্রয়োজন পড়ে একধরনের ব্যাক্টেরিয়ার। এদের যোগান দিতো এই এপেনডিক্স।পরবর্তীতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ায় এদের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পেয়েছে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এপেনডিক্স এতটাও ফেলনা নয়। ভ্রুণাবস্থায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে এখনও। তাই এখন অপ্রয়োজনে এপেন্ডিসেকটোমি করা নিষিদ্ধ।
আক্কেল দাঁত
“এই থাম তো! তোর আক্কেল দাঁত ওঠেনি এখনও!”- বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধি আর জ্ঞানের অপরিপক্বতা বোঝাতে এই শব্দযুগল শোনার ভাগ্য অনেকেরই হয়েছে। কিন্তু সেই দিন এবার ফুরোলো! কেন?
মানব সমাজ তখনও সভ্য হয়নি। শিকার করা পশুর মাংসই ছিল তার প্রধান খাবার। প্রথমে কাঁচাই খেতো সেগুলো। পরে আগুন আবিষ্কৃত হলো। তখন পুড়িয়ে খাওয়ার প্রচলন হলো। আর ছিল উদ্ভিজ্জাত আঁশ। আজকের খাবারের সাথে তার ঢের তফাত ছিল। অপেক্ষাকৃত অপাচ্য সেই খাবারগুলো হজম করা বেশ কষ্টকর ছিল। এর থেকে বাঁচার উপায় ছিলো আগে থেকে ভালো করে চিবিয়ে তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাতে পরিণত করা, যাতে ডাইজেস্টিভ জ্যুস সেগুলোর উপর আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারে। বেশি পরিমাণ চর্বনের জন্য প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী দাঁতের। তাই মানুষের দেহে আরো চারটি অতিরিক্ত পেষণ দাঁতের অস্তিত্ব ছিল।
বিজ্ঞানের ভাষায় এগুলো হলো তিন নম্বর মোলার দাঁত। শুধু দাঁত নয়, চোয়ালও বেশ ভারী ছিলো তাদের। কিন্তু পরবর্তীতে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ফলে অতিরিক্ত ভারী চোয়ালের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। তাই চোয়ালের আকার ছোট হয়ে গিয়েছে। এত ছোটই হয়েছে যে, এখন অনেকের তো আক্কেল দাঁত ওঠার জায়গাটুকুও নেই। ফলে সার্জনের কাছে দৌড়াতে হয়। কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষের আক্কেল দাঁত পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। তাসমানিয়ার অধিবাসীরা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কানের মাংসপেশী
আমাদের কানের ছিদ্রের চারপাশে ছাতার মতো পিনা থাকে যাতে মানুষ শব্দতরঙ্গ আরো নিখুঁতভাবে সংগ্রহ করতে পারে। যে সকল প্রাণীরা বুনো পরিবেশে থাকে তাদের সবসময় অতি সতর্ক থাকতে হয়। হয়তো কোন ফাঁকে হিংস্র শিকারী ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়বে, তার জন্য সতর্ক থাকতে হয় সর্বদা।তাই তাদের কানের কিছু মাংসপেশী রয়েছে, যেমন- উপর, নিচের এবং পেছনের অরিকুলারিস মাসল। এগুলোর সাহায্যে তারা তাদের পিনার অবস্থান পরিবর্তন করে চারপাশ থেকে ভেসে আসা শব্দ বুঝতে পারে।
তাই মাথা নিচু করে ঘাস খেতে থাকা হরিণ মাথা উঁচু না করেই শত্রুর উপস্থিতি টের পায়। মুহুর্তেই বুঝে নেয় তার কী করা উচিত। বেঁচে যায় তাদের প্রাণ।সংগত কারণেই মানুষের এতটা নিখুঁত শব্দ বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। মানুষ যতটা না কানের উপর নির্ভরশীল তার চেয়ে অনেক বেশী নির্ভরশীল দৃষ্টিশক্তির উপর। তাই অরিকুলারিস মাসলগুলো মানুষের ততটা প্রয়োজন নেই। আস্তে আস্তে বিবর্তনের ধারায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। এখনও কিছু কিছু মানুষের কানের এই মাংসপেশীগুলো কানকে নিয়ন্ত্রণ করার মত যথেষ্ঠ শক্তিশালী।
মানুষের লেজ
কেউ একটু বেশী দুষ্টু হলে মা-চাচীরা তাকে আদর করে জিজ্ঞেস করে থাকে, “তোর কি বান্দরের মতো লেজ আছে নাকি?” আসলে ব্যাপারটি কিন্তু সত্যি! আমাদের দেহে একটি লেজ সত্যিই রয়েছে। আসলে ওটা একটি ভেস্টিজিয়াল অঙ্গ বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ। আমাদের মেরুদন্ডের সাথে লেগে থাকা স্যাক্রাম নামক হাড়টিই সেই অবশেষ!
কিডনী
আমাদের দেহে কিডনী একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দেহ থেকে রেচন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন বিষাক্ত পদার্থ দেহ থেকে বের করে দেওয়ার প্রধান চ্যানেল হলো কিডনী। অতিরিক্ত পানি পান করলে তা বের করে দেওয়া কিংবা যখন পানি শূন্যতায় দেহ জর্জরিত, তখন পানি দেহে ধরে রেখে শরীরকে সুস্থ রাখে কিডনী। তাছাড়া ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্সিংয়ের কাজ সহ হাজারও কাজ করে সে। সুতরাং কিডনী ছাড়া আমরা কোনোভাবেই বেঁচে থাকতে পারব না!
তবে মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেহের সমস্ত কাজ করার জন্য একটি কিডনীই যথেষ্ঠ। বাকি কিডনী না থাকলেও আপনি দিব্যি চলতে পারবেন। এমনকি অনেক মানুষের দেহে একটির বেশি কিডনী থাকেই না। তারা সেটা না জেনেই নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করেন!
ফিচার ইমেজ- ppcorn.com