পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের সাথে চাঁদ জড়িয়ে আছে। ছোটবেলাতেই চাঁদের বুড়ির সাথে আমাদের পরিচয় হয়। রাতের বেলা চাঁদ উঠলে সেখানে তাকিয়ে আমরা প্রত্যেকে খুঁজি চাঁদের বুড়ি এখন কী করছে।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গী হয়ে আছে এই চাঁদ। আমরা দেখে অবাক হই। যেখানেই আমরা যাচ্ছি, চাঁদও আমাদের সাথে সাথে সেখানে যাচ্ছে। আমাদেরকে কখনও একা ফেলছে না। শিশু হৃদয়ে চাঁদের প্রতি ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রে বড়ও হয়ে থাকে। কেউ চাঁদনি রাতে বনে-জঙ্গলে চলে যায় জ্যোৎস্না উপভোগ করতে, কেউ কেউ চাঁদ নিয়ে চমৎকার সব কবিতা লেখে, অমাবস্যা এবং চাঁদ নিয়ে অনেকে ভূতুড়ে গল্পও ফেঁদে বসেন। আবার অনেকে চাঁদ জয় করার স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ এই চাঁদ।
কিন্তু চাঁদ কি পুরো পৃথিবীর, নাকি কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের? কোনোভাবেই চাঁদ কোনো একটি দেশের অংশ নয়। চাঁদ হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর; সব মানুষের। চাঁদের উপর কারো একার অধিকার নেই। তবে এখানেও একটি ‘কিন্তু’ চলে আসছে। চাঁদে যখন প্রথম মানুষ পাঠানো হয়, তখন চাঁদে অবতীর্ণ প্রথম মানুষ নিল আর্মস্ট্রং বলেন,
One small step for a man, but a giant leap for mankind
সারা পৃথিবীর মানুষ সাক্ষী হয়েছিল পৃথিবীর এই চন্দ্র বিজয়ের। চাঁদে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদে অবতীর্ণ দ্বিতীয় মানুষ বাজ অলড্রিনের যে ছবি আমরা দেখি, সেটা তো জগদ্বিখ্যাত। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম চাঁদে যেতে পেরেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র একাই এখন চাঁদের মালিক হবে এমনটা মনে করা ঠিক নয়। তবুও কিছু কথা থেকে যায়। সেগুলো নিয়েই আজকের আলোচনা।
চাঁদ প্রথম জয় করে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চাঁদে যাওয়া নিয়ে অলিখিত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় তারা। এখন কথা ওঠে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মেধা এবং পয়সা খরচ করে চাঁদে গিয়েছে এবং প্রথম সেখানে তাদের দেশের পতাকা লাগিয়েছে, তাই চাঁদ তাদের হয়ে গিয়েছে! এরপর যদি চাঁদে কেউ যেতে চায়, বা চাঁদ নিয়ে কোনো প্রকার গবেষণা করতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া করা যাবে না।
এমনটা কিন্তু হয়নি এখনও পর্যন্ত। কিন্তু চাঁদে মানুষ যাওয়া যখন সহজলভ্য হয়ে পড়বে বা এমনও যদি হয় যে কখনও চাঁদে মানুষ বসবাসের জন্য যাচ্ছে, তখন কি এই মালিকানার কথা আসবে না?
এখানে একটু ভেবে দেখার বিষয় আছে। মজার কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে কিন্তু এখন Space Lawyer বা মহাশূন্য বিষয়ক ওকালতি করে এমন উকিলও আছে। মহাশূন্যের কর্তৃত্বের জন্যও এখন আইনকানুন, রীতিনীতি তৈরি এবং প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে ‘ইতিহাস’ এবং সেই ইতিহাসের অংশ ‘মানুষ’।
পৃথিবীতে কলোনাইজেশন বা উপনিবেশ তৈরি করে বিভিন্ন অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রথম জাহির করে ইউরোপীয়রা। ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড ইত্যাদি অনেকগুলো রাষ্ট্র এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ তৈরি করে। এই উপনিবেশ তৈরি হওয়ার ফল কিন্তু কখনোই ভালো হয়নি। যুদ্ধ, অশান্তি, দেশগুলোর মধ্যে রেষারেষি, মানুষের মধ্যকার শত্রুতা বৃদ্ধি- শুধু এসবই হয়েছে উপনিবেশের ফলে।
কিন্তু মহাশূন্যে এরকম করা কি আদৌ ঠিক হবে? রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মহকাশ জয় নিয়ে যখন স্নায়ু যুদ্ধ চলছিলো, তখন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপারটি বুঝতে পারে। সেজন্য ১৯৬৯ সালের অ্যাপোলো-১১ এর মাধ্যমে চন্দ্রবিজয় করার দুই বছর আগে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং আরও কিছু দেশ, যারা মহাকাশ অভিযান নিয়ে ভাবছে, তাদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকটি ছিল একটি চুক্তি, যার নাম Outer Space Treaty।
এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াসহ অন্য সকল দেশ স্বীকার করে নেয় যে, পৃথিবীতে ক্ষমতা এবং অর্থের লোভে যে উপনিবেশ করা হয়েছিল এবং কলোনাইজেশনের যে ধারণা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা ছিল মানব সম্প্রদায়ের জন্য একটি অভিশাপ। অবশ্যই অন্য দেশে উপনিবেশ তৈরি করা কারোর জন্য ভালো ফল আনতে পারেনি, বরং বহু বছর ধরে দেশগুলোর মাঝে একটি রেষারেষি চলেছিল।
চন্দ্রাভিযানে যে রাষ্ট্রই বিজয়ী হোক না কেন, অবশ্যই সেটা হবে অনেক বড় অর্জন, কিন্তু কোনোভাবেই চাঁদকে নিজের বলে দাবি করা যাবে না। কারণ এই অভিযানের সফলতার পর রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক দিয়ে এই সফলতাকে রাজনৈতিক আঙ্গিকে প্রকাশ করার চেষ্টা চলবে এবং এমন সব উক্তি রাজনীতিবিদের কাছ থেকে আসবে যেটা মানব সম্প্রদায়ের জন্য ভালো না-ও হতে পারে।
তাছাড়া সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে এই অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কোনোরকম নেতিবাচক প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে সেটা হবে চরম অপমানের সামিল এবং লজ্জার একটি বিষয়। তাই এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই চুক্তিতে প্রত্যেকে মেনে নেয় যে, কোনোভাবেই চাঁদ বা অন্যান্য গ্রহ বা গ্রহসম্বন্ধীয় বস্তু কখনোই কোনো একটি দেশের নিজস্ব সম্পদ হবে না। এটা পুরো পৃথিবীর সব মানুষের জন্য, সব দেশের জন্য একই থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন চাঁদের মাটিতে তাদের দেশের পতাকা লাগিয়েছিল, সেটার মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নিজেদের একার অধিকার দাবি করছে। তাদের পতাকা স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের যেসব মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় এই মিশন সম্পন্ন হয়েছিল এবং যেসব প্রকৌশলীর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে এরকম জটিল একটি মিশন সার্থক করা সম্ভব হয়েছিল, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। চাঁদ থেকে যা কিছুই পৃথিবীতে আনা হয়েছিল তার সবই যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় নিয়ে ভ্রমণ করিয়েছে, সবাইকে গবেষণা করার সুযোগ দিয়েছে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, যখন বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময়ে মহকাশের বিভিন্ন জায়গা বিজয় করবে, বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের জয় চিহ্ন আঁকবে এবং যখন মহাকাশে যাওয়া অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে, তখন এই চুক্তি কতটুকু কার্যকর থাকবে এবং তা কতটুকু সবাই মানবে? মহাকাশে উপনিবেশের জন্য কি তারা একে অন্যের সাথে লড়াই করবে না? প্রযুক্তি যখন অনেক বেশি সহজলভ্য হয়ে যায়, প্রযুক্তি যখন মানুষকে যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা তৈরি করে দেয়, তখন মানুষ লোভী হয়ে পড়ে না? ইতিহাস কিন্তু এর পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়!
ফিচার ইমেজ – LikeTheDew.com