আবিষ্কারের পর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানুষ একে গ্রহ হিসেবেই চিনেছে। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৪ শে আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ঘোষণা দেয় যে, গ্রহ হবার জন্য যে যে যোগ্যতা থাকা দরকার প্লুটোর মাঝে তা নেই। সেজন্য প্লুটোকে গ্রহদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
এরপর লাগলো ঝামেলা সারা দেশে। কেন বাপু? নিজেরা নিজেরা যোগ্যতার মাপকাঠি বানিয়ে নিজেরা নিজেরাই প্লুটোকে গ্রহের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেবার উদ্দেশ্য কী? শুরু হলো আন্দোলন। রীতিমতো ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে মানুষ। আন্দোলনকারীদের দাবী- প্লুটোকে আবারো সুযোগ দেয়া হোক। গ্রহের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে প্লুটোকে আবারো গ্রহভুক্ত করা হোক।
আবিষ্কারের আগে থেকেই প্লুটোর জীবন বেশ ঘটনাবহুল। সৌরজগতের অন্যান্য যেকোনো গ্রহের তুলনায় এটি অনন্য। প্লুটোর ঘটনাবহুল জীবন এখানে তুলে ধরছি।
আবিষ্কারের ইতিহাস
বিজ্ঞানী ও গণিতবিদরা একটি দিক থেকে অনন্য। কোনো বস্তুকে সরাসরি না দেখেও গাণিতিক হিসাব নিকাশের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারেন তারা। সাধারণত গ্রহদের গতিপথ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে তার আশেপাশে কোনো উপগ্রহ বা অন্য কোনো গ্রহ আছে কিনা তা বলতে পারেন। যেমন- বিজ্ঞানীরা একবার হিসাব করে দেখলেন মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে একটি গ্রহ থাকার কথা। কিন্তু কোনো কারণে গ্রহটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হলো এখানে ঠিকই একটি গ্রহ তৈরি হবার কথা ছিল, কিন্তু কিছু কারণে সেটা সম্পন্ন হতে পারেনি। যে যে বস্তুর সমন্বয়ে গ্রহটি গঠিত হবার সম্ভাবনা ছিল, সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুই গ্রহের কক্ষপথের মাঝের অঞ্চল জুড়ে। এই অঞ্চলের বস্তুগুলোকেই আমরা ‘গ্রহাণুপুঞ্জ’ বলে জানি।
১৮৪৬ সালের দিকে নেপচুন গ্রহ আবিষ্কৃত হয়। নেপচুনের আগের গ্রহ ইউরেনাস। ইউরেনাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সেখানে কিছু অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করেন। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের মাধ্যমে সেগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেন এর বাইরে আরেকটি গ্রহ থাকতে পারে। সেই গ্রহটি হচ্ছে নেপচুন। পরবর্তীতে নেপচুনের গতিপথেও কিছু অসামঞ্জস্য খুঁজে পায় বিজ্ঞানীরা। ধরে নেয় এর বাইরে কোনো একটি গ্রহ আছে যেটি তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যমে নেপচুনের গতিপথকে প্রভাবিত করছে।
কিন্তু কোথায় সেই গ্রহ? দিনের পর দিন খোঁজা হয়, কিন্তু ধরা দেয় না। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিলেন ‘প্লানেট এক্স’ বা ‘অজানা গ্রহ’। এক্স বলতে চলক বা অজানা জিনিসকে বোঝানো হয়। এই গ্রহ খোঁজার জন্য যিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নামেন তার নাম হচ্ছে পার্সিভাল লোভেল। খুব সম্পদশালী ছিলেন। অনেক অর্থ ব্যয় করে আরিজোনায় ‘লোভেল অবজারভেটরি’ নামে একটি মানমন্দির তৈরি করেন। ১৮৯৪ সালে সম্ভাব্য গ্রহটিকে খুঁজে পাবার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেন সেখানে।
কিন্তু বিধি বাম। অনেকদিন খোঁজাখুঁজি করেও সেই গ্রহটি পাওয়া যায়নি। ১৯১৬ সালে পার্সিভালের মৃত্যু পর্যন্ত বিশেষ এই গ্রহ অনুসন্ধানের কাজ অব্যাহত চলছিল। তার মৃত্যুর পর এই কাজে ভাটা পড়ে যায়।
অনেকদিন পর একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা এই কাজকে বেগবান করে। লোভেল অবজারভেটরির পরিচালকের কাছে একদিন আকাশপটের চিত্র সম্বলিত একটি চিঠি আসে। চিঠিটি পাঠিয়েছে একজন তরুণ, যার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো লেখাপড়া নেই। বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি এমন তরুণের আকাশ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাকে ডেকে এনে একটি চাকুরী দিয়ে দেন। চাকুরীতে কাজ হলো আকাশের ছবি তুলে তুলে প্লুটো গ্রহকে অনুসন্ধান করা।
তরুণের নাম ক্লাইড টমবো (Clyde Tombaugh)। কেন এবং কীভাবে এখানে চিঠি পাঠালো সেই গল্পও বেশ ঘটনাবহুল। ছোটবেলা থেকেই টমবোর জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল। এর জন্য পরিবেশও পেয়েছিলেন ইতিবাচক। চাচার একটি টেলিস্কোপ ছিল। সেটি দিয়ে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। একসময় নিজেই টেলিস্কোপ তৈরি করার কৌশল রপ্ত করে নিলেন। ১৯২৮ সালে একটি ৯ ইঞ্চি রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ তৈরি করেন। এর আগে বানানো টেলিস্কোপগুলো এতটা নিখুঁত ছিল না। সেই তুলনায় এটি বেশ নিখুঁত হয়েছে। আকাশপট দেখাও যায় পরিষ্কার।
সে বছর তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার কথা ছিল। সাবজেক্টও ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। কিন্তু ভাগ্য ইতিবাচক ছিল না তার। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিলাবৃষ্টিতে পরিবারের সকল ফসল ধ্বংস হয়ে গেল। এখনকার আমেরিকা আর তখনকার আমেরিকার মাঝে বিস্তর পার্থক্য। সে সময় সকল ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে না অনাহারে মরে যাওয়া। এমন অবস্থায় তার পরিবারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগানো সম্ভব ছিল না। মন খারাপ করে তিনি থেকে রইলেন সেখানে এবং কৃষিকাজে মন দিয়ে পরিবারের উন্নয়ন করার কাজে মনঃস্থ হলেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারেননি তো কী হয়েছে, আকাশপ্রেমী মনটা তখনো রয়ে গিয়েছিল। কাজ শেষ করে রাতের বেলায় টেলিস্কোপ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আকাশে। শখের বশেই পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহ। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গ্রহ দুটির নিখুঁত চিত্র একে সেগুলো পাঠিয়ে দিলেন লোভেল অবজারভেটরিতে। অবজারভেটরির পরিচালক তার প্রতিভা ধরতে পারেন এবং ডেকে এনে আকাশ আকাশ পর্যবেক্ষণ করার চাকুরীতে বসিয়ে দেন।
কোনো মানুষ যখন তার শখের ও পছন্দের কাজটিকে চাকুরী হিসেবে পায় তখন কাজটি দেখতে যত কঠিনই মনে হোক না কেন তার কাছে সেটি আনন্দদায়ক। টমবোর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। কারণ সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে এমন কোনো গ্রহকে খুঁজে বের করা সহজ কথা নয়। আকাশের সম্ভাব্য যে যে অবস্থানে গ্রহটি থাকার কথা সে অংশগুলোর ছবি তুলে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে তা বের করা।
মনে হতে পারে এ আর এমন কঠিন কী? ছবি তোলাই তো। কিন্তু যখন দেখা যাবে আকাশের ঐ অঞ্চলের প্রত্যেকটা বিন্দু ধরে ধরে ছবি তুলতে হবে তখন অবশ্যই সেটি কঠিন কাজের মাঝে পড়ে। পরিশ্রমসাধ্য কাজ হলেও টমবো আনন্দের সাথেই তা করতে থাকে।
১৯৩০ সালের দিকে তিনি তার পরিশ্রমের ফল পেলেন। আকাশের একটা অংশে এমন একটা বিন্দুর দেখা পেলেন যেটি তার অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে। এটিই নতুন গ্রহ প্লুটো। গ্রহ আবিষ্কারের খবর যখন প্রকাশ করা হলো তখন সারা দেশে মোটামুটি একটা আলোড়ন পড়ে গেল। ২৩ বা ২৪ বছরের এক তরুণ আস্ত একটি গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলেছে এই খবরে সারাদেশে তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্কলারশিপ প্রদানের মাধ্যমে লেখাপড়ারও সুযোগ করে দিলো।
নামকরণ
পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গেছে প্লুটো গ্রহের আবিষ্কার। শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে গেছে এর আমেজ। নতুন গ্রহটির তো একটা নাম দেয়া দরকার। সে উদ্দেশ্যে নাম আহ্বান করা হলে প্রায় এক হাজারের চেয়েও বেশি নাম জমা হয়। A থেকে শুরু করে Z পর্যন্ত অনেক নাম আসে তাদের হাতে। সবগুলো নাম যাচাই বাছাই করে এগারো বছর বয়সী এক স্কুল বালিকার দেয়া নাম গ্রহণ করা হয়। তার প্রস্তাবিত নাম ছিল প্লুটো। কারণ চিরায়ত পুরাণে প্লুটো হচ্ছে Underworld বা অন্ধকার রাজ্যের দেবতা। অন্যদিকে প্লুটোও সবসময় অন্ধকারেই থাকে। সূর্য থেকে এত দূরে এর অবস্থান যে সেখানে পর্যাপ্ত আলো পৌঁছায় না বললেই চলে। সে হিসেবে নামকরণ সার্থক।
ভেনেটিয়া নামের স্কুল বালিকাটির ছোটবেলা থেকেই পৌরাণিক গল্পের প্রতি আগ্রহ ছিল। তার দাদা ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান। দাদার সাথে কথা বলেই তিনি নামটি প্রস্তাব করেছিলেন।
কেন প্লুটো গ্রহের তালিকার বাইরে?
গ্রহটি আবিষ্কারের পর ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথ সংক্রান্ত সমস্যার হয়তো সমাধান হয়েছে, কিন্তু সাথে সাথে আরো অনেকগুলো নতুন সমস্যার জন্মও হয়েছে। যেমন এটি আকারে খুব ছোট। এর ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৫ ভাগের এক ভাগ। ভরও অনেক কম, পৃথিবীর ভরের ৫০০ ভাগের এক ভাগ। এর কক্ষপথ স্বাভাবিক নয়, সূর্যের চারপাশে আবর্তনের এক পর্যায়ে নেপচুনের কক্ষপথ ভেদ করে ভেতরে চলে আসে। সৌরজগতের বাইরের দিকের গ্রহগুলো গ্যাসীয়, কিন্তু এটি পাথুরে। অন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ মোটামুটি একটি সমতলে অবস্থান করছে কিন্তু এর কক্ষপথ কিছুটা হেলে আছে।
এর মাঝে প্লুটোর একটি উপগ্রহও আবিষ্কৃত হয়। সাধারণত কোনো গ্রহের উপগ্রহগুলো অনেক ছোট হয় এবং গ্রহের শক্তিশালী আকর্ষণের প্রভাবে এরা গ্রহের চারপাশে ঘুরে। কিন্তু প্লুটোর বেলায় হয়েছে অন্যটা। প্লুটোর উপগ্রহটি প্লুটোর আকারের প্রায় অর্ধেক, যা উপগ্রহ হিসেবে তুলনামূলকভাবে অনেক বড়। উপগ্রহ যদি আকারের দিক থেকে গ্রহের আকারের অর্ধেক হয়ে যায় তাহলে তো সেটি গ্রহের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাবে। আকারে বড় হবার কারণে বা ভর বেশি হবার কারণে অবাধ্য আচরণ করবে, মূল গ্রহের প্রভাব না মেনে নিজেই একটা প্রভাব তৈরি করতে চাইবে। এমন হয়ে থাকলে সেটা গ্রহের মান সম্মানকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে।
প্লুটোর গ্রহত্ব নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি দেখা দেয় ২০০৫ সালে। বিজ্ঞানীরা প্লুটোর সীমানার বাইরে একটি বস্তুর দেখা পান, যার ভর প্লুটোর ভরের চেয়েও বেশি। এর নাম রাখা হয় এরিস। আবিষ্কারের পরপর নাসা কর্তৃপক্ষ একে দশম গ্রহ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে ঐ এলাকায় এরকম আরো কিছু বস্তু খুঁজে পাওয়াতে গ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। বস্তুদেরকে এভাবে গণহারে গ্রহ হিসেবে ধরে নিলে ঐ কক্ষপথের আশেপাশে অনেকগুলো গ্রহ হয়ে যাবে, যা শুধু ঝামেলাই বাড়াবে।
এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়ে যান এবং সম্মেলনের মাধ্যমে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন। ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (IAU)-এর এই সম্মেলনে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। এখানে প্রথমে বিজ্ঞানীদের নিয়ে ভোটাভুটি করা হয়। একটি অপশন হচ্ছে এরিস ও সেরেস (সবচেয়ে বড় গ্রহাণু) সহ গ্রহ হবে মোট বারোটি। প্লুটোও থাকবে গ্রহের তালিকায়। যেহেতু তাদের ভর প্লুটোর চেয়ে বেশি বা প্লুটোর কাছাকাছি তাই প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে ধরে নিলে তাদেরকে কেন নেয়া হবে না?
আরেকটি অপশন হচ্ছে সৌরজগতের যে যে বস্তুগুলো বেশি পরিচিত সেগুলো গ্রহের পরিচয় পাবে। তাহলে প্লুটো সহ মোট গ্রহ হবে ৯টি। প্লুটোর চেয়েও ভারী অন্যান্য বস্তু দুটি তালিকা থেকে বাদ যাবে। এই সংজ্ঞা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত নয়।
তৃতীয় অপশন হচ্ছে যৌক্তিক সংজ্ঞার ভেতরে পড়লে কোনো বস্তু গ্রহ বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরে হলে নয়। এই হিসেবে মোট গ্রহ হবে ৮টি। প্লুটো যাবে বাদ। সাধারণ গ্রহাণু থেকে বড় কিন্তু স্বাভাবিক গ্রহ থেকে ছোট, এ ধরনের বস্তুর জন্য ‘বামন গ্রহ’ নামে আলাদা একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসেবে প্লুটো, সেরেস ও এরিস বামন গ্রহ হিসেবে বিবেচ্য হবে।
ভোটাভুটিতে বিজ্ঞানীরা শেষোক্তটিকেই বেছে নিলেন। গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটো বাদ। এই সম্মেলনটি যদি সাধারণ মানুষদেরকে নিয়ে করা হতো তাহলে তারা আবেগকেই প্রাধান্য দিতো বেশি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের নিয়ে করাতে সেখানে যৌক্তিক অবস্থানটিই জয়ী হয়েছে।
গ্রহ হবার শর্ত
ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত গ্রহ হবার শর্তগুলো হচ্ছে-
১. সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে। (প্লুটো এই শর্তে উত্তীর্ণ।)
২. যথেষ্ট ভর থাকতে হবে যেন তার অভিকর্ষীয় শক্তির মাধ্যমে নিজেকে মোটামুটি গোলাকার আকৃতি ধারণ করাতে পারে। (প্লুটো এই শর্তে অনুত্তীর্ণ।)
৩. কক্ষপথে ঘোরার সময় তার আশেপাশে শক্তিশালী প্রভাব রাখতে হবে যেন আশেপাশের জঞ্জাল বস্তুগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। (এখানেও প্লুটো অনুত্তীর্ণ।)
শেষ দুই শর্ত পূরণ করতে পারেনি বলে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সকল গ্রহই গোল হয়। কোনো গ্রহই পিরামিড, সিলিন্ডার কিংবা ঘনকের মতো হয় না। বস্তু যখন খুব বেশি ভারী হয়ে যায়, তখন তার আকর্ষণের শক্তির তুলনায় গ্রহের উপাদানগুলো প্রবাহী বা ফ্লুইডের মতো হয়ে যায়। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর গাঠনিক উপাদানকে কঠিন পদার্থ বলে মনে হলেও পৃথিবীর শক্তিশালী আকর্ষণ সেগুলোকে অবস্থানচ্যুত করতে পারে। প্রকৃতির সকল বস্তুর ধর্মই হচ্ছে গোলাকৃতি ধারণ করা। মগ দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিলে দেখা যাবে সেই পানি অনেকগুলো গোলাকার ফোটা তৈরি করেছে। গ্রহগুলোও এই ধর্মের জন্য গোলাকৃতি ধারণ করে। কিন্তু প্লুটোর মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ ভর নেই যা দিয়ে নিজের গাঠনিক উপাদানকে নেড়েচেড়ে অন্য যেকোনো আকৃতি থেকে পালটে গোলাকৃতি ধারণ করতে পারবে।
অন্যান্য গ্রহ যখন তাদের কক্ষপথে ঘোরে তখন মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যমে আশেপাশের ক্ষুদ্র বস্তুগুলোকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ফলে কক্ষপথ হয়ে যায় জঞ্জাল মুক্ত। প্লুটো এই কাজটা করতে পারেনি। যথেষ্ট শক্তিশালী প্রভাব নেই বলে তার কক্ষপথের আশেপাশে জঞ্জাল রয়েই গেছে।
এতসব দিক বিবেচনা করে প্লুটোকে সতর্কতার সাথেই গ্রহের তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। ছোটবেলায় আমরা বই পুস্তকে প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে পড়েছিলাম। এখন পড়তে হবে ‘প্লুটো একটি বামন গ্রহ’।
মন খারাপের গল্প
এতদিনের প্রতিষ্ঠিত এবং এত চমৎকার নামধারী একটি গ্রহের গ্রহত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে- এটা মানতে পারেনি আমেরিকার মানুষজন। এদের দাবী হচ্ছে- আকৃতি কোনো ব্যাপার না, সারা জীবন একে আমরা গ্রহ হিসেবে জেনে এসেছি তাই একে গ্রহের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া হোক। কেউ কেউ বলছে- সকল আকৃতি, সকল আকার এবং সকল ধরনের কক্ষপথকেই আমরা সাপোর্ট করি। তাই প্লুটো যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তাকে গ্রহের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হোক। আবার কেউ কেউ পোস্টারে লিখেছে- এখন প্লুটোকে সরানো হয়েছে, আপনাদের পরবর্তী টার্গেট কি নেপচুন আর ইউরেনাসকে সরানো?
সাধারণত বিজ্ঞান সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোর দাবিদাওয়া আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করা যায় না। আমেরিকানরা এটাই করেছে। বাংলাদেশেও এমন হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকে ‘বাকের ভাইয়ে’র যেন ফাঁসি না হয় সেজন্য মিছিলে নেমেছিল মানুষ। এ ধরনের ব্যাপারগুলো আবেগের নাড়ি ধরে টান দেয়, তাই হয়তোবা মানুষজন আবেগের বশবর্তী হয়ে নেমে যায় রাস্তায়।
বিজ্ঞানের ধর্মই হচ্ছে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলা। যৌক্তিক পরিবর্তনকে মেনে নেয়াই হচ্ছে সত্যিকার বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচায়ক। দীর্ঘদিন ধরে কোনোকিছুকে বিশেষ পরিচয়ে চিনলে তার প্রতি মায়া তৈরি হবেই। এই পরিচয়ে পরিবর্তন আসলে মায়া এবং আবেগে টান দেবেই। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে আবেগ ও মায়াকে বাক্সবন্দী করে পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে।
তথ্যসূত্র
১. আরো একটুখানি বিজ্ঞান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কাকলী প্রকাশনী, ২০১১ ২. মহাকাশের কথা, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, অনুপম প্রকাশনী, ২০১১ ৩. universetoday.com/13573/why-pluto-is-no-longer-a-planet/ ৪. vintagespace.wordpress.com/2011/10/31/the-life-and-times-of-pluto/ ৫. IAU 2006 General Assembly: Result of the IAU Resolution Votes ৬. 8co.uk/facts-about-pluto