নেসা ক্যারি একজন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী। তার কাজের ক্ষেত্র আণবিক জীববিজ্ঞান এবং জীবপ্রযুক্তি। পাশাপাশি বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণেও তিনি কাজ করেন। “The Epigenetics Revolution”, “Junk DNA: A Journey Through the Dark Matter of the Genome” প্রভৃতি জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থের রচয়িতা নেসা ক্যারি বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে টেড এক্স লিভারপুলের মঞ্চে তিনি আধুনিক জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির নানামুখী সম্ভাবনা এবং প্রাসঙ্গিক আশঙ্কার ব্যাপারে একটি বক্তৃতা করেন। “Want to edit your DNA” শীর্ষক সেই টেড-টক রোর বাংলার পাঠকদের জন্য এখানে বাংলায় অনুবাদ করা হলো।
—
ক্রিসপার কিংবা জিন সম্পাদনা নিয়ে কিছু লিখতে বসা আমার জন্য বেশ আনন্দের। কারণ ‘টক অব দ্য টাউন’ হিসেবে আমাদের জীববিজ্ঞানী-পাড়ায় বহুদিন ধরে এর অবস্থান প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই প্রযুক্তি যে মানুষের জীবনকে বৈপ্লবিকভাবে প্রভাবিত করার দৃষ্টান্ত এর মধ্যেই স্থাপন করেছে, এবং আকস্মিক প্রাপ্তির আবেগে ভেসে না গিয়ে এর ভবিষ্যত-ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের বিদ্বৎসমাজে সুচিন্তিত আলাপ-আলোচনা চালু হওয়ার দরকার রয়েছে, পত্রপত্রিকার কল্যাণে আপনাদের অনেকেও হয়তো সেই ব্যাপারে অবগত আছেন।
২০১২ সালে যখন এই প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয় (পরবর্তীতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত দুই বিজ্ঞানী ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জেনিফার ডওডনা ও বার্লিনের ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ইন্সটিটিউটের ইম্যানুয়েল শারপ্যান্টিয়ে এ আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন), আমরা সবিস্ময়ে খেয়াল করি ভাইরাস-আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাকটেরিয়া-কোষে বহুযুগ ধরে বিবর্তিত এই পদ্ধতি গবেষণাগারে যেকোনো উৎস থেকে পাওয়া যেকোনো জীবের জিন সম্পাদনার কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই থেকে বিজ্ঞানীরা এর উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করে গেছেন; এবং আজ আমরা অন্তত তাত্ত্বিকভাবে বলতে পারি- ক্রিসপার প্রযুক্তি আসার পর ক্ষতিকর মিউটেশন, যা কি না মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ জেনেটিক অসুখের জন্য দায়ী, বিজ্ঞানের কাছে আর অজেয় নয়। এটা অবিশ্বাস্য!
ক্রিসপার (CRISPR) আসলে একটা অ্যাক্রোনিম বা শব্দসংক্ষেপ, এর গালভরা পূর্ণরূপ Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats। মূলত, এটি হচ্ছে সর্বাধুনিক ‘জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি’ (Gene Editing Technology)। ক্রিসপার আসার আগে বিজ্ঞানীরা জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়েজ, ট্যালেন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিন সম্পাদনার কাজ করতে পারতেন, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো এখনও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সমস্যা যেটা ছিল- এই প্রযুক্তিগুলোর নিপুণতার মাত্রা ছিল অপেক্ষাকৃত কম, অথবা এগুলো ব্যবহার করতে বেগ পেতে হতো বেশ খানিকটা। সেদিক দিয়ে ক্রিসপারের গঠন বা ব্যবহারশৈলী যেমন সহজ, এর তাৎপর্যও তেমন বৈপ্লবিক।
জিন সম্পাদনার এই আধুনিক কলাকৌশলের সাথে অতীতের পদ্ধতির তুলনা অনেকটা মোটরগাড়ির সাথে ঘোড়ার গাড়ির তুলনার মতো। কিংবা, আরো যথার্থভাবে বললে, প্রাচীন ছাপাখানার সাথে আধুনিক ওয়ার্ড-প্রসেসরের সাথে তুলনা করার মতো। এবার মানব জিনোমের পটভূমিতে ব্যাপারটা বোঝা যাক। আপনি আপনার বাবা এবং মায়ের কাছ থেকে বংশগতীয় প্রক্রিয়ায় জিনগত তথ্যের ধারক হিসেবে কম-বেশি ৩,০০০ মিলিয়ন ‘জেনেটিক অক্ষর’ পেয়ে থাকেন। ক্রিসপার প্রযুক্তি এই তিন হাজার মিলিয়ন অক্ষরের মধ্যে থেকে একটি ভুল অক্ষর, অর্থাৎ একটি মিউটেশনকে নিখুঁতভাবে খুঁজে বের করবে, এবং তাকে বদলে দেবে। ভেবে দেখুন, ৩ বিলিয়ন অক্ষরের মধ্যে থেকে বিশেষ জায়গার কেবল একটি বিশেষ অক্ষরকে সে পরিবর্তন করে দেবে- এটাই এর অসাধারণত্ব! এরকম শক্তিশালী, বহুমাত্রিক ব্যবহারসম্পন্ন প্রযুক্তি এর আগে কক্ষনো মানবজাতির হাতে আসেনি। এই লেখাটা গোটা মানবজাতির স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতকরণে ক্রিসপার প্রযুক্তির দেখানো সম্ভাবনাগুলোর আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
রোগ নিরাময় পদ্ধতি হিসেবে এই প্রযুক্তির ভবিষ্যত ভীষণ উৎসাহব্যঞ্জক। মানবকোষের ডিএনএ-তে যখন আমরা জিন সম্পাদনা করছি, জেনেটিক অক্ষরের পরিবর্তন করছি- এই পরিবর্তনটা হবে চিরস্থায়ী। ওই বিশেষ কোষ বিভাজিত হয়ে আরো যেসব কোষ তৈরি করবে, পরিবর্তনটি সঞ্চারিত হবে সেগুলোতেও। জেনেটিক অসুখ নিরাময়ের যে সম্ভাবনার কথা শুরুতে বলেছি, তার মূলতত্ত্ব এটিই। লক্ষ্যণীয় যে, বিভিন্ন প্রকার ওষুধ প্রয়োগে শুধু রোগের লক্ষণ ও বাহ্যিক সমস্যাগুলো কমে যায়, কিন্তু অসুখটি পুরাপুরি নিরাময় হয় না; ক্রিসপার দিয়ে আমরা এখন সেই কাজটিই করছি।
‘সোম্যাটিক ট্রিটমেন্ট’ বলে একটা ব্যাপার আছে, যেখানে আমরা ‘সোম্যাটিক সেল’ বা দেহকোষের (জননকোষ যথা শুক্রাণু, ডিম্বাণু ছাড়া বেশিরভাগ কোষই এই ধরনের) চিকিৎসা করে থাকি। ২০১৯-এ সিকল সেল রোগ এবং বিটা থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসায় আধুনিক জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আবিষ্কারের মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এহেন অগ্রগতি বিস্ময়কর। এখানে তারা যা করেছেন, সেটা মোটামুটি এরকম- প্রথমে রোগাক্রান্ত অস্থিমজ্জার স্টেমকোষকে দেহের বাইরে এনেছেন। এই কোষগুলোতে হিমোগ্লোবিন তৈরির জিনে ছিল বিশেষ মিউটেশন, যার জন্য কর্মক্ষম লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি হচ্ছিল না (এজন্য এসব রোগীর কিছু দিন পর পর বাইরে থেকে রক্ত দিতে হতো)।
হিমোগ্লোবিন হলো আমাদের লোহিত রক্ত কণিকার একধরনের বাহক প্রোটিন, যা প্রশ্বাসের সময় গৃহীত অক্সিজেনকে দেহের কোষে কোষে বহন করে নিয়ে যায়। এই স্টেমকোষকে গবেষণাগারে নিয়ে আধুনিক জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি প্রয়োগ করে মিউটেশন অপসারণ করা হয়েছে। এই পরিবর্তিত কোষকে তারা আবার রোগীর দেহে ফেরত পাঠিয়েছেন। কোষগুলো সুন্দরমতো ফিরে গিয়ে নতুন করে সুস্থ-সবল-কর্মক্ষম লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি করেছে।
আমাদের কাছে আগে যেসব অপর্যাপ্ত চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল, সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে আমরা এসব রোগীকে পুরোপুরি নিরাময় করার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছি। জিন সম্পাদনা করায় রোগটি আর পরবর্তী বংশধরেও প্রবাহিত হবে না। আবার, জিন সম্পাদনার আরেকটি ধারণা হচ্ছে ‘জার্মলাইন জিন সম্পাদনা”‘। এখানে জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ভ্রূণের ওপর। ভ্রূণের জিনোম পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায় সেখানে উপস্থিত কোন মিউটেশনটি পরবর্তীতে মারাত্মক রোগ তৈরি করবে। মিউটেশনকে পরিবর্তন করে ভ্রূণকে আবার মায়ের জরায়ুতে সংস্থাপন করা হবে (টেস্টটিউব বেবি প্রযুক্তির মতো)। এভাবে আমরা কেবল ওই বিশেষ ভ্রূণের জিনোমই পরিবর্তন করলাম না, ওই ভ্রূণ যখন পরিণত মানুষে রূপান্তরিত হবে, সেই মানুষের ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্ভাব্য জিনোমকেও চিরস্থায়ীভাবে বদলে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত এটাই ধারণা করা হচ্ছে যে, ‘হিউম্যান ডিজেনারেটিভ ডিজিজ’ বলে পরিচিত প্রাণঘাতী রোগগুলোর (যেমন- হান্টিংটন’স ডিজিজ) চিকিৎসায় ‘জার্মলাইন জিন সম্পাদনা’ ব্যবহৃত হবে।
আবার এটা যে শুধু জেনেটিক রোগ নিরাময়েই আটকে থাকবে তা নয়। একটা অদ্ভুত উদাহরণ দিই। প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের অভাবে ‘এন্ড-স্টেজ’ কিডনি ফেইলিউর, ‘এন্ড-স্টেজ’ হার্ট ফেইলিউর প্রভৃতি ‘টার্মিনাল’ (যেসব সমস্যায় রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ) রোগে প্রতিদিন সারাবিশ্বে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ঘটছে। অঙ্গ-দান করার মতো দাতার সংখ্যা অপ্রতুল। আমাদের কল্যাণমূলক নিয়মনীতির জন্যই হয়েছে এটা। সরকার সিটবেল্ট বাঁধাসহ যাবতীয় নিরাপত্তা গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, ফলে গাড়ি দুর্ঘটনায় আর বেশি মানুষের মৃত্যু হয় না। এটা নিঃসন্দেহে ভালো ব্যাপার, কিন্তু উল্টো দিক থেকে দেখলে এরাই প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের একটি বড় উৎস ছিলেন। মোদ্দা কথা, মানবদেহ থেকে অঙ্গ নেওয়ার মতো যথেষ্ঠ দেহ আমাদের কাছে নেই।
শুনতে যতই অদ্ভুত লাগুক, অঙ্গ নেওয়ার মতো যথেষ্ঠ শূকর আমাদের কাছে আছে। বিশেষত, টার্মিনাল হার্ট ফেইলিউরের চিকিৎসায় শূকরের হৃৎপিণ্ড ব্যবহার নিয়ে বহুদিন ধরেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। কারণ আকার-আকৃতিতে, যান্ত্রিক-বৈদ্যুতিক কার্যপ্রণালীতে আমাদের আর ওদের হৃৎপিণ্ডে আশ্চর্যরকম মিল। কিন্তু, বললেই তো আর হলো না, শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে সমস্যাও আছে। আমাদের অনাক্রম্যতন্ত্র (Immune System) যেকোনো বহিরাগত জিনিসের মতো এর প্রতিও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, এবং এর কার্যকারিতাকে নাকচও করে দিতে পারে। আবার খাল কেটে কুমির আনার মতো শূকরের হৃৎপিণ্ড কিছু অনাহুত শত্রুকেও বয়ে আনতে পারে। এদের ডিএনএ-র ভেতরে আছে ভাইরাস, পুরনো ভাইরাস, যারা কোনো একসময়ে এর কোনো পূর্বপুরুষকে সংক্রমিত করেছিল, এবং তারপর এদের জিনোমে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। এরা কিন্তু মৃত নয়, ঘুমন্ত মাত্র।
জটিলতা এড়াতে যার দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে, চিকিৎসকেরা প্রায়ই ‘ইমিউনোসাপ্রেসিভ’ ওষুধ ব্যবহার করে তার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাময়িক নিস্তেজ করে রাখেন। সেক্ষেত্রে গ্রহীতার দেহে ওই ভাইরাসগুলো সক্রিয় হয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, আবার তার চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়েও পড়তে পারে। হয়তো সকলকে সেগুলো মারাত্মকভাবে আক্রমণ করবে না, কিন্তু ঝুঁকিতে থাকবেন বৃদ্ধ, শিশু এবং রোগগ্রস্ত- এই তিন শ্রেণির মানুষ। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হবে হাসপাতালে, আর সহজেই অনুমেয় যে হাসপাতালে ওই তিন শ্রেণির মানুষেরই আনাগোনা বেশি। সুতরাং, বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে এই কাজে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আশার কথা হলো আধুনিক জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী শূকরের জিনোমে থাকা মোট ৬৫ রকম ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছেন; পুরোনো প্রযুক্তিতে যা করার কথা আমরা ভাবতেও পারি না। বিপুল আশাব্যঞ্জক এই সফলতার পর দলটি বেশ মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ লাভ করেছে এ বিষয়ক (মানবদেহে প্রতিস্থাপনের জন্য শূকরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ‘মডিফিকেশন’ বা বিশেষায়িতকরণ) গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
এতক্ষণ এই প্রযুক্তির অসাধারণত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এরপরও কিন্তু স্বস্তি নেই! যে নৈতিক প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে সেটি হলো, “আমাদের কি এই সুযোগ নেওয়া উচিত?” এই বোঝাপড়া আমাদের সচেতনভাবে করতে হবে। ‘জার্মলাইন জিন সম্পাদনা’র ব্যাপারটা চিন্তা করা যাক। যেকোনো ডাক্তারি প্রক্রিয়ায় ‘কনসেন্ট’ বা ‘সম্মতি’ জরুরি। কেউ বলতে পারেন, কেন ভ্রুণের বাবা-মা সম্মতি দেবেন? কিন্তু তাদের ওপর তো আর কাজ করা হচ্ছে না, কাজ করা হচ্ছে ভ্রূণের ওপর! আবার, ভ্রূণকেও তো জিজ্ঞাসা করা যায় না, যেহেতু সে মাত্র কয়েকটি কোষের সমষ্টি। তাহলে কি আমরা ওই ভ্রূণ যখন পরিণত মানুষ হবে, তার বয়স যখন আঠারো হবে, তখন তাকে বলবো, “খোকা, আমরা তোমার জন্মের সময় তোমার জিনোম সম্পাদনা করেছিলাম, এতে কি তুমি রাগ করবে? আমরা যদি সম্পাদনা না করতাম, তাহলে কি ভালো হতো?“
জার্মলাইন সম্পাদনা যদি করতেই হয়, তাহলে আমরা আসলে এমন একজন কাল্পনিক ব্যক্তির কাছ থেকে একরকম ‘জোর করেই’ কনসেন্ট আদায় করছি, যে আর কখনোই তার স্বরূপে পৃথিবীতে আসতে পারবে না (কেননা তার আদি জেনেটিক বিন্যাস পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে)। আমাদের আইনের ভিত্তি যে ‘ইনফর্মড কনসেন্ট’ বা ‘সজ্ঞান সম্মতি’, সেই নিয়ম এখানে কড়াভাবে ভঙ্গ করা হচ্ছে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, কী আর হবে তাতে? সব মানুষ তো আর ওসব রোগে ভুগছে না যেখানে এই প্রযুক্তি দরকার হবে। তাহলে অল্প ক’জনের জন্য এত তর্কের কী আছে? উঁহু, তর্কের দরকার আছে। নৈতিকতার ভার সংখ্যার পাল্লায় মাপা হয় না। প্রশ্নটা একজনের জন্যই হোক, আর একশোজনের জন্য- প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ শুরু থেকেই। এ আলাপগুলোতে তাই বিজ্ঞানীদের থেকে শুরু করে নীতিশাস্ত্রবিদ, আইনপ্রণেতা, সমাজবিজ্ঞানী এবং অবশ্যই চিকিৎসাপ্রার্থী রোগী ও তাদের পরিবার-পরিজনকে সম্পৃক্ত করা জরুরি।
জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি বিষয়ে আলাপ-আলোচনা সারা বিশ্বে কাঙ্ক্ষিত স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। এর মধ্যেই চীনের এক বিজ্ঞানী জনকুই হি জানালেন, আক্রান্ত বাবা-মা থেকে এইচআইভি-মুক্ত সন্তানের জন্ম দিতে তিনি জার্মলাইন জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন, এবং এভাবে তার তত্ত্বাবধানে সফলভাবে লুলু আর নানা নামে দুটি মেয়েশিশুর জন্ম হয়েছে। মানব জিনোম সম্পাদনা সম্মেলনে জনকুই হি তার এই পরীক্ষণের কথা প্রকাশ করলে বিজ্ঞানীমহলে ব্যাপক আলোড়ন পড়ে যায়, কেননা মানুষের ওপর সরাসরি এ ধরনের পরীক্ষা চালানোয় বড় ধরনের নৈতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। রাজনৈতিক-নৈতিক-বৈজ্ঞানিক এই সবরকম ভজঘট লাগানোর পর তাকেও মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে সেটা হলো- এই ঘটনা জিন সম্পাদনা প্রযুক্তিকে নিয়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক-চিন্তাবৃত্তিক আলাপটা চলছিল, তার স্বচ্ছন্দ গতি বাধাগ্রস্ত করল, এবং একে অযাচিত চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল। এর ফলে অনেক দেশের সরকার হয়তো এই প্রযুক্তির ওপর আইনত স্থগিতাদেশ জারি করবে, যা আমার মতে হবে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ।
কোথায় আর কোন পরিস্থিতিতে ‘জার্মলাইন জিন সম্পাদনা’র ব্যবহার করা যাবে, সেই আলাপও থাকা জরুরি। আমার মনে হয় না এই প্রযুক্তি যদি নিশ্চিত-মারণাত্মক, প্রাণহরণকারী রোগ নির্মূলে ব্যবহৃত হয়, তাহলে কারো এ ব্যাপারে কোনো বড় আপত্তি থাকবে। কিন্তু আমরা যদি একে কানে না শোনার সমস্যা বা ‘বধিরতা’ দূরীকরণে ব্যবহার করি? এতে কিন্তু আমাদের কোনো প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু বধিরতা এক স্বতন্ত্র ভাষাগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। তাদের ‘সাঙ্কেতিক ভাষা’ বিশ্বজুড়েই স্বীকৃত। জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি কোনো পরিবার বা জনপদে বধিরতা দূর করার চেষ্টা করতে শুরু করি, তাহলে তা প্রকারান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভাষিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নির্মূলকরণেরই সমার্থক হয়ে উঠবে, যা কিনা ভয়ানকভাবে জাতিসংঘ-স্বীকৃত ‘গণহত্যা’র সংজ্ঞার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সুতরাং জীবনরক্ষাকারী অবস্থা বনাম জীবনপরিবর্তনকারী অবস্থা- কখন এই প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করা উচিত হবে সেই ব্যাপারে আমাদের স্বচ্ছ অবস্থান থাকা দরকার।
আরেকটি জনপ্রিয় আশঙ্কা আছে জিন সম্পাদনা নিয়ে, যাকে আমি তুচ্ছ এবং ‘সিনেম্যাটিক’ বলেই মনে করি। সেটা এরকম- সাই-ফাই চলচ্চিত্রে যাদের ডিজাইনার বেবি বলা হয়, জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষেরা বুঝি সেরকম নীল চোখ-সোনালি চুলওয়ালা-ফর্সা-বুদ্ধিমান সন্তান জন্ম দিতে শুরু করবে! না, এত সহজ নয়। মানুষ হয়তো করতে চাইবে, কিন্তু কাজটা দুরূহ। এসব বৈশিষ্ট্য জিনোমের বিভিন্ন জায়গার অনেকগুলো জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; সেই সবগুলো জিনকে একসাথে বদলে ফেলা সহজসাধ্য নয়। আবার, এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সঠিক বিকাশ পরিবেশের ওপরেও বৃহৎভাবে নির্ভরশীল।
আধুনিক জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির অন্যতম অভিনবত্ব ছিল এর ব্যবহারের সহজসাধ্যতা। এটা আবার এক আশঙ্কার দিকও। সহজসাধ্য জিনিসের নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা আরোপ করা সহজ নয়। নীতিবিবর্জিত কোনো মানুষ যেন ব্যক্তিগত বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীগত স্বার্থে এর অপব্যবহার না করে সেই ব্যাপারে সচেতন থাকার জরুরত আছে বৈ কি! সামনে হয়তো জিন সম্পাদনার নামে প্রতারণাও শুরু হতে পারে নজরদারির বাইরে থাকা অখ্যাত কোনো ক্লিনিকে, যেখানে মানুষকে আধুনিক চিকিৎসার নামে প্রতারিত করা হবে, অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হবে। এসব নতুন সমস্যাকে ছোট করে দেখলে চলবে না।
সব মিলিয়ে, আধুনিক জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির যে বিপুল সম্ভাবনা, তাকে উপেক্ষা করে এর ব্যবহারে গড়িমসি করলে যেমন চলবে না, তেমনি সঠিক সীমারেখা তৈরি না করে হুট করে একে ছেড়ে দিলেও চলবে না। এর প্রয়োগ ভালো না খারাপ হবে- তা নির্ভর করবে আমরা আগামী দিনে কত সচেতন ও মানবিক উপায়ে এর ব্যবহার করব। সেই কাজ ঠিকঠাক করতে পারলে মানবজাতি যে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।