নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার: কোন পথে ইউরোপ?

সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম প্রধান একটি নিয়ামক হলো ‘শক্তি’; আরও নির্দিষ্ট করে বললে ‘বিদ্যুৎশক্তি’। আর এই শক্তির উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে এবং সে শক্তিকে সভ্যতার অগ্রগতিতে কাজে লাগাতে গিয়ে মানুষ তার আবাসস্থল পৃথিবীকে করে তুলছে বসবাসের অনুপযোগী। তবে সমস্যা শুধু এখানেই নয়, পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা যদি বাদও দেওয়া হয়, তবুও আরেকটি আশংকা থেকে যায়। আর তা হলো, শক্তির উৎস হিসেবে আমরা বর্তমানে যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করে যাচ্ছি, তাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সভ্যতার অগ্রযাত্রা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত শক্তির সরবরাহ পাবে তো?

হয়তো নিউক্লিয়ার শক্তি এ ঘাটতি পূরণের জন্য একটি উপায় হতে পারে। কিন্তু, পরিবেশের কথা বিবেচনা করলে, এটা সবচেয়ে ভালো উপায় নয়।

একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র © Michael Utech / Getty Images

এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার উপরোক্ত দুটি সমস্যার সমাধানই দিতে পারে। অর্থাৎ শক্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবেশও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রটিতে ইউরোপীয় দেশগুলো সামনের কাতারে রয়েছে। সম্ভবত তারাই ভবিষ্যতের পৃথিবীকে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের লক্ষ্য

যারা ইউরোপ সম্পর্কে কমবেশি খোঁজ-খবর রাখেন, তারা হয়তো একটি বিষয় জানেন যে, পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পরিবেশ বিষয়ক আইন-কানুন অত্যন্ত কঠোর এবং সেগুলো বেশ কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হয়। এর অর্থ হলো, পরিবেশ রক্ষার্থে বা পরিবেশ দূষণরোধে যেসব আইন-কানুন সেসব দেশে রয়েছে, তা সামান্য মাত্রায় ভঙ্গ করলেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছাড় পাবে না।

প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়টি পরিবেশের প্রতি ইউরোপের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই চিত্রায়িত করে। পৃথিবীর অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্র, যেমন- চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের তীব্র প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে, সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা কে কতটা পূরণ করতে পারলো সেই সম্পর্কিত তথ্য © Eurostat

ইউরোপীয় কমিশন, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ আইন-কানুন সংক্রান্ত বিষয়গুলোর তত্ত্বাবধান করে থাকে, ২০০৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জন্য কিছু নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রণয়ন করে। এ নির্দেশনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর তা হলো, ২০২০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্যবহৃত মোট শক্তির ২০% আসবে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে। এ উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা গেছে, ২০২০ সালের অনেক আগেই বেশ কয়েকটি দেশ তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে ফেলেছে এবং বাকি দেশগুলোও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই ২০১৮ সালে এই লক্ষ্যমাত্রাকে পুনঃনির্ধারণ করা হয়। এবার ঠিক করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির পরিমাণ হতে হবে মোট ব্যবহৃত শক্তির ৩২%। কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার মোট ব্যবহৃত শক্তির ২০% এ তুলে আনা যতটা সহজসাধ্য, সেটাকে ৩২% এ উত্তোলন করাটা আপাতদৃষ্টিতে তারচেয়ে সহজ মনে হলেও বাস্তবে এটি অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো।

নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ও এর সীমাবদ্ধতা

তেল ও গ্যাস হলো জীবাশ্ম জ্বালানী। এগুলো আমরা ভূ-গর্ভ হতে উত্তোলন করে ব্যবহার করে থাকি। অল্প পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে অধিক পরিমাণ শক্তি পাওয়া গেলেও এই জ্বালানীর ব্যবহার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া, এর পরিমাণও সীমিত। বর্তমানে আমাদের জানামতে পৃথিবীর মাটির নিচে যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানীর মজুত রয়েছে, তা দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ ৬০ বছরের কাছাকাছি চলতে পারবো, যদি জ্বালানীর চাহিদা অপরবর্তিত থাকে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এ চাহিদা বেড়েই চলবে, ফলে সময়কালটা ৫০ বছর বা তার নিচে নেমে আসাটা খুব স্বাভাবিক। এমনকি ততদিনে নতুন কিছু জীবাশ্ম জ্বলানীর উৎসের সন্ধান পেলেও সেটা বড়জোর আরও এক দশকের জন্য শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করবে। কিন্তু এরপর কী হবে? পরিবেশ ও অন্যান্য সকল বিষয়ের কথা বিবেচনা করে নবায়নযোগ্য শক্তির উপরই নির্ভর করতে হবে তখন।

পৃথিবীতে তেল ও গ্যাসের পরিমাণ সীমিত; Image source: Bureau of Land Management

তেল ও গ্যাসের মতো যেসব শক্তির উৎস সীমিত নয়, অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যত বা সুদূর ভবিষ্যতে যেসব শক্তির উৎস ফুরিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেগুলোই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। যেমন- সোলার পাওয়ার বা সৌরশক্তি, বায়ুবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস প্লান্ট ইত্যাদি। এগুলো বারবার ব্যবহার করা যায়। আবার শক্তির এ উৎসগুলোর প্রাপ্যতাও অনেক বেশি; এ উৎসগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের তুলনায় আরও অনেক বেশি শক্তি পাওয়া যাবে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির এই উৎসগুলো ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করছি না? কেন সেই তেল-গ্যাস নিয়েই পড়ে আছি? এর উত্তর অনেকগুলো। তবে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে প্রধান কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বলছি।

তেল-গ্যাস থেকে আমরা কয়েক শতাব্দী ধরে শক্তি উৎপাদন করে আসছি। ফলে পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রায় সকল ব্যবস্থাই শক্তির জন্য তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। এ ব্যবস্থাগুলো শ’খানেক বছর ধরে গড়ে উঠেছে এবং এর পেছনের প্রযুক্তিগুলো ইতোমধ্যে চরম উৎকর্ষ সাধন করেছে। তাই এখন হঠাৎ করেই সকল ব্যবস্থা বা সিস্টেমকে তেল-গ্যাস বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের উপযোগী করে তোলাটা খুব বেশি বাস্তবসম্মত হবে না। আবার খরচের দিকটাও দেখতে হবে। কোনো একটা সিস্টেমকে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে মোটামুটি ভালো পরিমাণ অর্থই খরচ করতে হবে। আবার নবায়নযোগ্য শক্তির মূল্য তেল-গ্যাসের তুলনায় আদৌ সাশ্রয়ী হবে কি না, সেটাও চিন্তার বিষয়। কেননা, ব্যাপক পরিসরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো নবায়নযোগ্য শক্তির খরচকে তেল ও গ্যাসভিত্তিক শক্তির খরচের চেয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

পৃথিবীর মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের বড় একটি অংশ আসে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে; Image source: scottpeters.house.gov

আরও বড় একটি সমস্যা হলো, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রাপ্যতা ও পরিমাণ অনেক বেশি হলেও এটি নির্ভরযোগ্য নয়। তেল ও গ্যাসকে উত্তোলন করে কোথাও জমা রাখা যায়, এবং যখন ইচ্ছা ও যতটুকু ইচ্ছা ব্যবহার করে সেটি অন্যান্য শক্তিতে (মূলত বিদ্যুৎশক্তিতে) পরিণত করা যায়। কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বিষয়টা সেরকম নয়, এটি জমা রাখা যায় না। যখন এটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তখন এর পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়। যেমন- প্রখর সূর্যালোকের সময়টাতে সোলার পাওয়ার, কিংবা বছরের যে সময়টাতে বায়ু প্রবাহ বেশি থাকে সে সময়টাতে বায়ু-বিদ্যুৎ এবং বর্ষার সময়ে জলবিদ্যুৎ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন করা সম্ভব। এমনকি উৎপাদনের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশিও হতে পারে।

কিন্তু বিপরীত দৃশ্যটাও বিবেচনায় নিতে হবে। শীতকালে, মেঘাচ্ছন্ন দিনে, রাতের বেলায় অথবা শুষ্ক ঋতুতে এসব উৎস থেকে প্রয়োজনীয় শক্তিটুকুও হয়তো পাওয়া যাবে না। এ কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস নির্ভরযোগ্য নয়। নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এখান থেকে অনবরত এবং সমান হারে শক্তির সরবরাহ পেতে হবে।

তবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে নির্ভরযোগ্য করার একটি উপায় আছে। সেটি হলো, যে সময়টাতে এই শক্তির উৎপাদন বেশি হয়, তখন তা কোনোভাবে জমিয়ে রেখে, পরবর্তীতে যখন ঘাটতি দেখা দেবে তখন তা ব্যবহার করা।

ভবিষ্যতের জন্য প্রযুক্তি

ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করতে হলে নবায়নযোগ্য শক্তির পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে এবং এই ক্ষেত্রটিতে খুব দ্রুত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করতে হবে।

পূর্বেই বলা হয়েছে, আমাদের প্রচলিত প্রায় সকল সিস্টেম শক্তি উৎপাদনের জন্য তেল-গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। এ ব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি, শিল্পযুগের শুরু থেকেই এর পেছনে বিনিয়োগ হয়ে আসছে এবং অসংখ্য প্রযুক্তিবিদের বহু বছরের গবেষণার ফলাফল এটি।

একইভাবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে বাস্তবসম্মতভাবে ও নির্ভরযোগ্যভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য আরও অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে। তবে বিনিয়োগকারী ও প্রযুক্তিবিদেরা বসে নেই, প্রচেষ্টা চলছে।

সৌরশক্তি এখন এতই সহজলভ্য হয়ে গেছে যে, নামমাত্র মূল্যে সোলার-প্যানেল বসিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করে অনায়াসে গৃহস্থালীর চাহিদা মেটানো সম্ভব; Image source: villageenergy.com

নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। বর্তমানে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু এসব উৎসকে নির্ভরযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদিত শক্তিকে জমা করে রাখা, যাতে ঘাটতির সময় তা ব্যবহার করা যায়। এজন্য ব্যবহার করা যেতে পারে অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অসংখ্য ব্যাটারি। তবে এই ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়। কেননা, এমনিতেই এত সংখ্যক ব্যাটারি স্থাপন করাটা হবে খুবই ব্যয়বহুল। তাছাড়া, নিয়মিত সময় ব্যবধানে ব্যাটারিগুলো পরিবর্তন করতে হবে, যা প্রকল্পের খরচকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাবে। ফলে ক্রেতারা এদিকে আকৃষ্ট হবে না। অথচ, মূল লক্ষ্য হতে হবে যেন, যে করেই হোক নবায়নযোগ্য শক্তির খরচ তেল-গ্যাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কম হয়। শুধুমাত্র তাহলেই ক্রেতারা নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে। তবে, ব্যাটারির মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করা হলে আরেকটি সমস্যা রয়েছে। তা হলো, গোটা পৃথিবীর সকল কল-কারখানা, যানবাহন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি, যেগুলো এতদিন তেল-গ্যাস ব্যবহার করে এসেছে, সেগুলোর আমূল পরিবর্তন করে সেগুলোকে সরাসরি বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ গোটা পৃথিবীর যান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই রাতারাতি পাল্টে ফেলতে হবে! যা প্রায় দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার।

নবায়নযোগ্য শক্তিকে কীভাবে গ্যাসীয় জ্বালানীতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে, তার ডায়াগ্রাম © Amit Kumar Rohhit / ResearchGate

তবে ইউরোপীয় গবেষকেরা এখন যুগান্তকারী এক আইডিয়া নিয়ে কাজ করছেন; আর তা হলো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া অতিরিক্ত শক্তিকে জ্বালানী, বিশেষ করে হাইড্রোজেনে রূপান্তরিত করে রাখা। এর উদ্দেশ্য এক ঢিলে দুই পাখি মারা। অর্থাৎ, এতে করে নবায়নযোগ্য শক্তি জমা করে রাখা যাবে, ফলে তা নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে। এবং অপরদিকে, বিদ্যমান সকল যান্ত্রিক ব্যবস্থা বা প্রযুক্তির আমূল পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে না। ফলে বেঁচে যাবে কয়েকশো বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অর্থ।

এ কাজটি মূলত করা হবে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পানির ইলেকট্রোলাইসিস বা তড়িৎবিশ্লেষণের মাধ্যমে। আমরা জানি, পানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের রাসায়নিক সমন্বয়ে গঠিত। পানিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুতের সাহায্যে বিশ্লেষণ করলে তা ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এই হাইড্রোজেন জ্বালানী হিসেবে বেশ কার্যকর এবং একইসাথে পরিবেশবান্ধব। তবে এ কাজটি ব্যাপক পরিসরে করতে গেলে, অর্থাৎ, ক্রমবর্ধমান জ্বালানীর চাহিদা পূরণ করতে এবং অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তিকে হাইড্রোজেন জ্বালানীতে রূপান্তরিত করতে গেলে খুবই উন্নত প্রযুক্তির একটি যন্ত্রের প্রয়োজন, যেটির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আহামরি বেশি হবে না, এবং যেটি খুব কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করে অধিক পরিমাণ হাইড্রোজেন উৎপন্ন করতে পারে। বিশেষ এ যান্ত্রিক ব্যবস্থাটির নাম ‘প্রোটন এক্সচেঞ্জ মেমব্রেন’ (Proton Exchange Membrane) বা সংক্ষেপে ‘পিইএম’(PEM)।

‘প্রোটন এক্সচেঞ্জ মেমব্রেন’ যেভাবে কাজ করে © Davidlfritz/Wikimedia Commons, CC BY-SA 3.0

ইতোমধ্যে এরকম প্রায় অর্ধশত প্রকল্প ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে চলমান রয়েছে, যার মধ্যে ডেনমার্কের ‘ওরস্টেড’, জার্মানির ‘সিমেন্স’ ও ‘ই.অন’ এর মতো কোম্পানিগুলোও জড়িত আছে। এ প্রকল্পগুলোর মূল লক্ষ্য যথাসম্ভব কম খরচে অধিক কার্যকরী ‘পিইএম’ যন্ত্র উৎপাদন করা, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎশক্তিকে জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত করা এবং একই সাথে ‘পিইএম’ থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেনকে কোনো দেশের গ্যাস নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করা। এতে করে জীবাশ্ম জ্বলানীর উপর চাপ ও নির্ভরশীলতা কমবে। এ ধরনের প্রচেষ্টা যে বৃথা নয়, তার প্রমাণ হলো, বিগত এক দশকে ‘পিইএম’ যন্ত্রগুলোর মূল্য প্রায় ৪০% কমে এসেছে এবং কার্যক্ষমতাও বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণের মতো! আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনে বিদ্যুৎ থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনাও বিবেচনা কর হচ্ছে।

একটি পিইএম ইলেকট্রোলাইজার © DLR /forschung-energiespeicher.info

কোন পথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জাতীয় গ্যাস নেটওয়ার্কের নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা রয়েছে, যার ফলে শক্তির মজুত হিসেবে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাসকে জমা রাখা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির জাতীয় গ্যাস নেটওয়ার্কে মোট যে পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস জ্বালানী হিসেবে মজুত রাখা যাবে, তা ২৪০ টেরাওয়াট-ঘন্টার সমতুল্য। আরও সহজ এককে বললে, আমরা বৈদ্যুতিক মিটার থেকে যে ‘ইউনিট’ (প্রকৃতপক্ষে ‘বোর্ড অব ট্রেড ইউনিট’) এককে বিদ্যুৎ পরিমাপ করি, তার হিসেবে এ শক্তির পরিমাণ প্রায় চব্বিশ হাজার কোটি ইউনিট!

এখন প্রশ্ন হতে পারে এই হাইড্রোজেন কে বা কারা ব্যবহার করবে? কীভাবে ব্যবহার করবে? ইতোমধ্যে এই হাইড্রোজেনকে অন্যান্য জ্বালানী, যেমন- প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা শুরু হয়ে গেছে। জার্মানি বর্তমানে তার জাতীয় গ্যাস সরবরাহের লাইনে প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে আয়তন হিসেবে সর্বোচ্চ ১০% হাইড্রোজেন গ্যাস মেশানোর বিষয়টি অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক গ্যাসের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবহারকারীরা প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে হাইড্রোজেনও ব্যবহার করবেন। তবে এটি করার জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থাকে একেবারে পুরোপুরি পরিবর্তন করতে হবে না, কিছু যন্ত্রাংশ নতুন করে সংযোজন বা বিয়োজন অথবা আপগ্রেড করলেই হবে। এছাড়া, ইউরোপসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী বেশ কিছু কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, সামনের বছরগুলোতে তাদের যন্ত্রাংশগুলোতে এমন সুবিধা থাকবে, যাতে করে এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে হাইড্রোজেন জ্বালানীও ব্যবহার করা যায়। ফলে, নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ভবিষ্যত নেই- এমন আশংকা আর থাকছে না।

বিভিন্ন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে হাইড্রোজেন ফুয়েলে চালিত গাড়ি বাজারে ছেড়েছে © Jeff Zurschmeide/Digital Trends

নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের এই ইউরোপীয় উদ্যোগ শুধু পরিবেশের বিপর্যয়ই কমাবে না, বরং জ্বালানী ফুরিয়ে আসা পৃথিবীতে ভবিষ্যতের ইউরোপকে জ্বালানীতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবে; জ্বালানী বা শক্তির ক্ষেত্রে আমদানী নির্ভরতা কমাবে। যদিও এ বিষয়ে চলমান প্রকল্পগুলোতে চাহিদা অনুসারে বিনিয়োগ এখনো অপ্রতুল, তবুও তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ দূরদর্শী উদ্যোগ সফল হলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোও যে ইউরোপের দেখানো পথেই হাঁটবে, তা বলাই বাহুল্য।

This article is in bengali language. It focuses on the feasibility of using renewable energy efficiently and Europe's current projects on it. Necessary sources of information have been hyperlinked inside the article.

More references:

1. Renewable power could make hydrogen cheaper than gas, study finds - Euractiv

2. HARNESSING THE FULL POWER OF RENEWABLE ENERGY WITH HYDROGEN - Hydrogen Europe

3. Hydrogen mobility from renewable energy – it is possible! - The Conversation

4. Renewable energy - European Commission

5. When will fossil fuels run out? - Ecotricity

6. Europe Stores Electricity in Gas Pipes - SCIENTIFIC AMERICAN

7. These 11 EU states already meet their 2020 renewable energy targets - World Economic Forum

8. Commentary: How Northwest Europe can shape a clean hydrogen market - International Energy Agency

9. Competition is driving down the cost of renewables. That's good news for the planet - World Economic Forum

Featured Image: Construction Review Online

Related Articles

Exit mobile version