প্রাণীদের উপর লাভ হরমোনের চমকপ্রদ প্রভাব

তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা
সখী ভালবাসা কারে কয়?

ভালোবাসা যে আসলে কী, তা নিয়ে স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও দ্বিধান্বিত! আবার কোনো বিজ্ঞানীর কাছে যদি জিজ্ঞাসা করেন, ভালবাসা কী? তাহলে তিনি নাকের ডগায় আটকে থাকা মোটা চশমাটা একটু ঠেলে, গম্ভীর গলায় বলতে পারেন, ভালবাসা আসলে মন-টনের কিছু না, সবই হরমোনের প্রভাব। আর যে হরমোনে কারণে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ভালোবাসার ভাবাবেগ উৎপন্ন হয় সে হরমোনের নাম অক্সিটোসিন। অক্সিটোসিন হরমোনের কারণে শুধু যে দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসার উদয় বা সম্পর্ক তৈরি হয় তা কিন্তু নয়। সামাজিক মূল্যবোধ, স্বীকৃতি এবং বন্ধনের পেছনেও লাভ হরমোনের যোগসাজশ রয়েছে।

এই হরমোন মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বস্ততার ভিত্তি গড়ে দেয় বলেও বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস। একজন মায়ের সাথে নবজাতকের মধ্যকার যে মমতার বন্ধন আমরা দেখতে পাই, তার পেছনেও রয়েছে অক্সিটোসিনের হাত। তাই অক্সিটোসিন হরমোনকে অনেকেই ভালোবাসার রসায়নে প্রভাবক বা ‘লাভ ড্রাগ’ বলে থাকেন। অনেকে একে ‘লাভ হরমোনও’ বলে থাকেন।

মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে, তাদের উপর লাভ হরমোন বা অক্সিটোসিন ঘটিত কিছু ব্যাপার বেশ চমকপ্রদ!

১. কুকুর লাভ হরমোনে ভরপুর!

কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী এই কথা কে না জানে! কিন্তু কেন তারা এতটা প্রভুভক্ত আচরণ করে থাকে সেটা কি জানেন? তাদের এই প্রভুভক্তির পেছনে লাভ হরমোনের প্রভাব রয়েছে। কুকুর যখন তার চেনাজানা মানুষের আশেপাশে থাকে, তখন তাদের মধ্যে অক্সিটোসিন হরমোনের উৎপাদন এবং প্রবাহ বেড়ে যায়। আর যখন মনিবের সাথে তাদের চোখাচোখি ঘটে, তখন কুকুরের মধ্যে অক্সিটোসিনের বিস্ফোরণ ঘটে।

গবেষণা থেকে জানা গেছে, একটি কুকুরের মস্তিষ্কে যখন অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে, তখন সে তার মনিবের সামাজিক আচরণের সাথে ভালোভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আর একটি কুকুর যত বেশি সময় তার মনিবের দৃষ্টিসীমার মধ্যে অবস্থান করে, তার মধ্যে লাভ হরমোন প্রবাহের হার তত বেশি বেড়ে যায়।

কুকুরের প্রভুভক্তির কারণ লাভ হরমোন; Image source: Time Magazine

একটি কুকুরের মধ্যে একটি বিড়ালের স্বাভাবিক অক্সিটোসিনের চাইতেও পাঁচ গুণ বেশি অক্সিটোসিন নিঃসরণ হয়ে থাকে।

২. পুরুষ বানরের পিতৃকালীন ওজন বৃদ্ধি

মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকায় মারমোসেট এবং তামারিন প্রজাতির বানর পরিবারভিত্তিক জীবনযাপন করে। তাদের মধ্যে কোন স্ত্রী বানর যখন গর্ভবতী হয়, তখন তার সঙ্গী পুরুষ বানরটির সামাজিক আচার আচরণে এক প্রকার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এর পাশাপাশি পুরুষ বানরটি পিতৃকালীন ওজন বাড়ে। মা বানরের গর্ভাবস্থায় যত দিন যেতে থাকে ততই তার পেটের আকাড় বাড়ে। তার দেখাদেখি পুরুষ বানরটিও নিজের ওজন বৃদ্ধি করতে তৎপর হয়ে ওঠে।

এক্ষেত্রে বাবা বানরটির মধ্যে বেশ কিছু হরমোন প্রভাব ফেলে। যেমন অক্সিটোসিন, ওয়েস্ট্রজেন এবং প্রোল্যাক্টিন। সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই হরমোনগুলো স্ত্রীলিঙ্গের স্তন্যদানের সাথে সম্পর্কিত। এই হরমোনের ফলে, মায়ের মতো বাবা বানরের মধ্যেও মাতৃসুলভ আচরণ পলক্ষিত হয়। মারমোসেট প্রজাতির বানরের শারীরিক গড়ন একটু ভিন্ন। এই বানরের স্তনবৃন্ত তাদের বাহুর ঠিক নিচেই অবস্থিত। নবজাতকের জন্মের পর বাবা মারমোসেট বানরের মধ্যে লাভ হরমোনের প্রভাবে তাদের স্তনের আকারও কিছুটা বৃদ্ধি পায়!

পুরুষ মারমোসেট বানরের পিতৃকালীন সময়ে ওজন বৃদ্ধি পায়; Image Source: Balfest Zoo

৩. নেউলের মিশুক ও শুভার্থী ভাবের উদয়

ছোটবেলায় সামাজিক বিজ্ঞান বইতে উদাহরণ হিসেবে হয়ত পড়ে থাকবেন, বেজি/নেউল পারস্পরিক সমাজবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কমবেশি ৫০টি বেজি একই গোষ্ঠী বা পরিবারভুক্ত হয়ে বসবাস করে। গর্ত খুঁড়তে, শিকার ধরার পাশাপাশি গর্তের ভেতর তাদের বাসস্থান পাহারা দিতেও তারা একে অন্যের পাশে থাকে। এক বেজি আরেক বেজির ছানাকে দেখাশোনা করে এবং খাদ্য দিয়ে পাশে থাকে! এত সামাজিকতা যাদের মধ্যে, তারা কিনা আরো বেশি সামাজিক এবং সাহায্যকারী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে! কীভাবে?

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক দক্ষিণ আফ্রিকার কুরুমান রিভার রিজার্ভের ভিন্ন চারটি বেজি গোষ্ঠীর উপর অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাব কীরকম তা নিয়ে কাজ করেছেন। যেসব বেজির মধ্যে লাভ ড্রাগ, মানে অক্সিটোসিন হরমোন প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেসব বেজি সামাজিকভাবে আরো বেশি কর্মচঞ্চল এবং বিনয়ী আচরণ প্রদর্শন করেছিল। অক্সিটোসিনের প্রভাবে তারা বাসা বানানোর জন্য গর্ত খুঁড়তে এবং গর্ত পাহারা দিতে অন্যদের চাইতে বেশি কাজ করে। তারা পরিবারের সাথে বেশি সময় কাটায় এবং খাবারের বড় ভাগটি সন্তানের জন্য রেখে দেয়। তাদের মধ্যে হিংস্রতার মাত্রাও কমে যায়।    

অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে নেউল সমাজ এবং পরিবারের প্রতি অধিক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠে; Image Source: Jamie Lomb/GettyImage

৪. সন্তানের প্রতি গুবরে পোকার ভালবাসা

আপনি জানেন কি? কোন কোন গুবরে পোকাকে গোরখোদক পোকা বলা হয়ে! এরা তাদের আশেপাশের কোন কীটপতঙ্গের মৃতদেহ দেখতে পেলে, কবর খুঁড়ে সেটিকে সমাধিস্ত করে ফেলে। সন্তান এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য, ঐসব কীটপতঙ্গের মৃতদেহ খাদ্য হিসেবে মজুদ করার জন্যই তারা এই পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। পোকার মধ্যেও যে মাতৃ বা পিতৃসুলভ আচরণ আছে গুবরে পোকা তারই উদাহরণ।

যুক্তরাজ্যে প্রাপ্ত গুবরে পোকার আচরণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, যখন স্ত্রীলিঙ্গের গুবরে পোকা গর্ভধারণ করে তখন পুরুষ পোকাটি বাসস্থানের একটি বড় জায়গা লার্ভা এবং কবর দেয়া খাদ্য মজুদের জন্য ছেড়ে দেয়। স্ত্রী পোকাটি যেন ডিম পাড়ার সময় যথেষ্ট জায়গা পায় এবং হাটাচলা করতে পারে, সেজন্যই পুরুষ গুবরে পোকার এই আত্মত্যাগ।

আবার যখন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়,  নবজাতক বাচ্চাও তার বাবামার সাথে সামাজিক ও সন্তানসুলভ আচরণ করে। বাচ্চাগুলোর ক্ষুধা পেলে, তারা তাদের ছোট্ট পা দিয়ে বাবা-মার পায়ে সুড়সুড়ি দেয়। এই সুড়সুড়ির সঙ্কেত পেয়ে সন্তানের মুখে তৈরি করা খাবার তুলে দেয় বাবা অথবা মা পোকাটি। এইযে সন্তানের প্রতি সামান্য গুবরে পোকার ভালবাসা, তার পেছনেও কাজ করছে অক্সিটোসিন!

গুবরে পোকা; Image Source: youngInverse.org

৫. চামচিকার চরিত্রবান হয়ে ওঠা

চারিত্রিক দিক দিয়ে প্রাইরি প্রজাতির চামচিকা একগামী প্রাণী। এই প্রজাতির পুরুষ চামচিকাই পরিবারের সার্বিক দেখাশোনা এবং তার স্ত্রী সঙ্গীর একমাত্র রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। অন্যদিকে মিডৌ প্রজাতির আরেক ধরণের চামচিকা আছে যারা বহুগামি। তারা প্রাইরি প্রজাতির একদমই উল্টো। একটি মিডৌ প্রজাতির পুরুষ চামচিকা একইসাথে একাধিক স্ত্রী চামচিকার সাথে মিলিত হয় এবং পরিবারের প্রতিও তারা নুন্যতম দায়িত্বশীল না।

এই দুই প্রজাতির চামচিকার মধ্যে এতটা চারিত্রিক ভিন্নতা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, এর সাথেও লাভ হরমোনের যোগসাজশ রয়েছে। প্রেইরি প্রজাতির চামচিকার মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল পেলাড্রাম নামক অংশে, মিডৌ প্রজাতির চামচিকার মস্তিষ্ক থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ভেসোপ্রেসিন হরমোন রিসেপ্টর বিদ্যমান। আর ভেসোপ্রেসিন হরমোন সরাসরিভাবে ভালবাসার হরমোন অক্সিটোসিনের সাথে জড়িত। কেন সঙ্গী আর পরিবারের প্রতি প্রেইরি চামচিকার ভালবাসা এত প্রবল, এবার নিশ্চই ব্যাপারটা পরিষ্কার!

প্রেইরি চামচিকার তার সঙ্গী আর পরিবারের প্রতি ভালবাসা প্রবল অক্সিটোসিনের জন্য; Image source: The Atlantic

৬. ইঁদুরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে লাভ হরমোন

ফেসবুকে বা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়শই একটা নিউজ শেয়ার হতে দেখা যায়- ‘আলিঙ্গন মানুষের রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে’। এই নিউজে শুধু মানুষের রক্তচাপ নিয়ে গবেষণা আর ফলাফল তুলে ধরলেও, জীবজন্তুর ক্ষেত্রে কী ঘটে তা কিন্তু অনেকেই জানে না।

দুগ্ধপোষ্য- অর্থাৎ এখনও মাতৃদুগ্ধ পান করে, এমন কিছু ইঁদুরের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, যখন তারা মায়ের দুধ পান করে এবং মায়ের কোলে উষ্ণতা আর স্পর্শের মধ্যে থাকে তখন তাদের রক্তচাপও অন্যান্য ইঁদুরের (যেসব ইঁদুর মায়ের উষ্ণতর সংস্পর্শে নেই) চাইতে কম থাকে। গবেষণালব্ধ এই ফলাফলটি পাওয়া গেছে ইঁদুরর ভেগাল নার্ভ টোনের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে। মাতৃসুলভ ভালোবাসাকে উদ্দীপক বা প্রভাবক হিসেবে ব্যবহার করে দেখা গেছে, এই প্রভাবকের উপস্থিতিতে ইঁদুরের মধ্যে সহানুভূতিসম্পন্ন স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়া, অসহিষ্ণু স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়ার চাইতে বেশি। আর বেশি সহানুভিতিসম্পন্ন স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়ার মানেই হচ্ছে তার মধ্যে অক্সিটোসিনের প্রভাব, যার ফলে কমে যায় মানসিক চাপ। আর মানসিক চাপ কম মানে রক্তচাপও কম।

আলিঙ্গনের ফলে চাপমুক্ত থাকে ইঁদুরও; Image Source: YouTube

ভালবাসা নিয়ে গীতিকার যতই গান লিখুক, গায়ক যতই সুরেলা গান গাক; আদর-স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, সহিষ্ণুতা, সহানুভিতি- যা’ই বলেন না কেন, সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে অক্সিটোসিন হরমোন। হোক সেটা মানুষে-মানুষে ভালবাসা কিংবা জীবজন্তুর!

This is the Bangla article about 6 interesting facts and effects of love hormone on animals.

All the sources are Hyperlinked in the article.

Feature Image: Pinterest.

Related Articles

Exit mobile version