অ্যারাকনোফোবিয়া বা মাকড়শার ভয়। এই ভয়ে ভুগে থাকেন পৃথিবীর প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে একজন। কিন্তু কেন? আমাদের চারপাশের পরিচিত মাকড়শাগুলোর কোনোটাই কামড়ে দিচ্ছে না, বিষাক্তও না। তাহলে তাদের দেখলেই কেন শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায় আমাদের?
এমন ভয়ই বা কেন জন্ম নিচ্ছে আমাদের মধ্যে মাকড়শাকে দেখলেই?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভয়টা শুধু মাকড়শা নিয়েই নয়, পোকামাকড় ও এর কাছাকাছি প্রাণী, যেমন– সাপ, বাদুড় ইত্যাদি সবকিছু ঘিরেই এমন ভয় কাজ করে মানুষের মধ্যে। আর আমাদের মধ্যে যারা উপরের তালিকার যেকোনো একটি প্রাণীকে ভয় পান, তারা অন্যান্য পোকা, সরীসৃপ ইত্যাদি দেখেও ভয় পান। চলুন, আজ অ্যারাকনোফোবিয়া নিয়েই বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মাকড়শা থেকে শুরু করে মাকড়শাল জাল: ভয়টা কোথায়?
মাকড়শাকে ভয় পাওয়া আর মাকড়শার জালকে ভয় পাওয়া, দুটোই একই ফোবিয়ার মধ্যে পড়ে। ঠিক ধরেছেন। অ্যারাকনোফোবিয়ার কথাই বলছি। অন্যান্য অনেক ফোবিয়ার চেয়ে অনেক বেশি এককেন্দ্রীক ভীতি এটা, যা তৈরি হতে পারে যে কারো মধ্যেই। এখানে আসল মাকড়শাও যে থাকতে হবে তা না, অ্যারাকনোফোবিয়ার ভুক্তভোগী হিসেবে শুধু জাল দেখেই মাকড়শা আশেপাশে থাকতে পারে সেই ভীতিতে পড়তেই পারেন।
‘অ্যারাকনে’ আর ‘ফোবোস’ নামের দুটো গ্রিক শব্দকে জুড়ে এই ভয়ের জন্ম। কালের পরিক্রমায় নানারকম ক্ষতিকর প্রাণীর প্রতি সহজাতভাবেই ভয় তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। এই যেমন সাপ, যা আগেও বিষাক্ত ছিল, এখনও তা-ই। কিন্তু বিষ নেই এমন একটা সাপকেও আশেপাশে দেখলে আপনার শরীর ভয়ে কেঁপে উঠবে। এমন কেন? কারণ, আপনি জানেন, আপনার শরীরের ডিএনএ জানে যে সাপ বিষাক্ত। অনেকটা সহজাত প্রতিক্রিয়া চলে আসে তাই আপনার মধ্যে।
একই ঘটনা ঘটে মাকড়শার বেলায়ও। মাকড়শা থেকে বিষ, বিষ থেকে অসুস্থতা- এই চিন্তা থেকেই শুরু হয় অ্যারাকনোফোবিয়া। অনেকটা প্রাকৃতিকভাবেই। কাজেই, মাকড়শাকে ভয় পাওয়ার জন্য আপনাকে মাকড়শার কামড় খেতে হবে এমনটা কিন্তু না। মাকড়শা যে ভয়ের, সেটা আপনার মাথায় এমনিতেই গেঁথে রেখেছে প্রকৃতি। সেখান থেকেই আপনি হয়ে যাচ্ছে অ্যারাকনোফোবিয়ার ভুক্তভোগী।
এই থিওরিকে সামনে ধরেই জার্মানিতে একটি গবেষণা চালানো হয়। শিশুদের মাছ, ফুল, সাপ, মাকড়শা ইত্যাদি দেখানো হয়। আর তাতে দেখা যায় যে, মাকড়শা আর সাপের বেলাতেই বাচ্চাদের চোখের মণির আকৃতি বদলাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে তারা। এই ভয় কিন্তু মাকড়শাকে আগে থেকে না দেখেই ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
অবশ্য, ভয় ছাড়াও বিরক্তি আর অস্বস্তিও হতে পারে অ্যারাকনোফোবিয়ার কারণ। আপনি শুধু মাকড়শাকে ভয় পেয়ে ওই জায়গা থেকে সরে যান বা মাকড়শাটাকে তাড়িয়ে দেন? এই ভীতির কবলে পড়ে অনেকে নিজের বাসাও ছাড়তে বাধ্য হন কখনো কখনো। মজার ব্যাপার হলো, আজ এই সময়ে এসে ব্যাপারটাকে শুধু একটা ভীতি মনে হলেও এই ভয়ই কিন্তু একটা সময় মানবজাতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। বর্তমানে অনেক মাকড়শার মধ্যেই মানুষকে আক্রান্ত করার মতো বিষাক্ত তরল থাকলেও সেটা মানুষের শরীরে প্রবেশ করানোর মতো ধারালো আর লম্বা হুল থাকে না। পৃথিবীর ৬৩,০০০ প্রজাতির মাকড়শার মধ্যেও শুধু ২ শতাংশই মানুষের জন্য বিষাক্ত।
আর হ্যাঁ, এসব বাদেও আপনার পরিবেশটাও আপনার মধ্যে অ্যারাকনোফোবিয়া তৈরি করতে পারে। বাবা-মা, চারপাশের মানুষ যেটাকে ভয় পাচ্ছে, সেটাকে আপনি কেন ভয় পাবেন না? নিজে নিজেই তাই আগে থেকে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও মানুষ হয়ে পড়তে পারেন এই আদিম ফোবিয়ার ভুক্তভোগী!
আপনার অ্যারাকনোফোবিয়া আছে কি?
মাকড়শাকে টুকটাক ভয় পাওয়া কিন্তু যায়ই। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি সেটা। কিন্তু সেই ভয় যে প্রচন্ড ফোবিয়া হয়ে আপনাকে আক্রমণ করেছে, তার লক্ষণ স্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব।
শারীরিকভাবে অ্যারাকনোফোবিয়ার ক্ষেত্রে ভয় বৃদ্ধি পেলে আপনি:
- মাথা ঘোরা
- হজমে সমস্যা
- বমিভাব
- গা ঘেমে যাওয়া
- হাত-পা কাঁপুনি
- শ্বাসকষ্ট
- হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি
- কান্না
ইত্যাদি দেখতে পারেন নিজের মধ্যে। শুধু তা-ই না, অ্যারাকনোফোবিয়া তৈরি হলে একজন মানুষ এই ভয়কে মোকাবেলা করতে মাকড়শা আছে এমন জায়গা এড়িয়ে চলেন। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। সামাজিক নানা ব্যাপার থেকে অনেকটা দূরে চলে যেতে একপ্রকার বাধ্য হন।
ভয় কমাবেন কীভাবে?
মাকড়শার প্রতি এই প্রচন্ড ভীতি কমাতে কিছু ব্যাপার খুব ইতিবাচকভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। টুকটাক সমস্যার পাশাপাশি আপনি যদি দেখতে পান অ্যারাকনোফোবিয়ার কারণে আপনি বাইরে যেতেই ভয় পাচ্ছেন, কাজ করতে পারছেন না, রাতে জেগে থাকছেন বা কিছুক্ষণ পর পর চিন্তায় ডুবে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে আপনার উচিৎ হবে-
১) চিকিৎসকের সাথে কথা বলা। চিকিৎসকেরা এই ভীতির কারণে কোনো ওষুধ দিতে চান না। তবে কাউন্সেলিং করে ভয়কে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসেন।
২) অন্য অনেক ফোবিয়ার মতো থেরাপি নেওয়ার মাধ্যমেও ধীরে ধীরে ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন আপনি। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি থেরাপি এক্ষেত্রে বেশ ভালো কাজ করে। বার বার মাকড়শাকে সামনে থেকে দেখাও অ্যারাকনোফোবিয়া কমিয়ে আনে।
মজার ব্যাপার হলো, স্পাইডারম্যান মুভিও অনেক অ্যারাকনোফোবিয়ার ভুক্তভোগীকে মাকড়শার ভয় কাটাতে সাহায্য করেছে। তাই আপনার মধ্যে বাস করা মাকড়শাকে নিয়ে ভীতিটা ঠিক কোন উপায়ে চলে যাবে সেটা বলা কঠিন। তবে পুরো ব্যাপারটাই যেহেতু আপনি মাকড়শাকে কেমন চোখে দেখছেন তার উপরে নির্ভর করছে, কাউন্সেলিং বা থেরাপি বা অন্য যেকোনো উপায়ে, সেটাকেই যে আপনার বদলাতে হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই!