রাতের খোলা আকাশে আমরা আমাদের মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথকে দেখে অভ্যস্ত। আমাদের পৃথিবী এই ছায়াপথেরই এক ক্ষুদ্র সদস্য। অনেক গ্রহ-উপগ্রহ সমন্বিত সৌরজগৎ, গ্রহাণুপূঞ্জ, অনন্ত উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির সমন্বয়ে গঠিত হয় এরকম একেকটি ছায়াপথ। তবে প্রতিটি ছায়াপথের সাথে যে বস্তুটির সম্পর্ক অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত সেটি হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার। বলা হয়ে থাকে যে, ডার্ক ম্যাটার এবং ছায়াপথের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা চিনাবাদামের মাখন এবং জেলির মত। সাধারণত একটি ছাড়া অন্যটিকে খুঁজে পাওয়াটা দুর্লভ। অর্থাৎ, যেখানে ছায়াপথ থাকবে, সেখানে এর সাথে ডার্ক ম্যাটারও থাকবে।
তো এমন যখন বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব, তখন যদি বিজ্ঞানীগণ এমন এক ছায়াপথের অস্তিত্ব খুঁজে পান যেখানে আসলে ডার্ক ম্যাটার নেই বললে চলে বা থাকলেও খুবই নগণ্য, তাহলে বিষয়টা হবে খানিকটা পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের মত। কারণ বিজ্ঞানীগণের মতে ডার্ক ম্যাটার হচ্ছে প্রতিটি ছায়াপথের ভিত্তিস্বরূপ, যার উপর প্রতিটি ছায়াপথ গঠিত হয় এবং অবস্থান করে। এটি কাজ করে অনেকটা আঠার মত, যার কারণে গ্রহ-নক্ষত্র এবং গ্যাসীয় মণ্ডলসমূহ ছায়াপথের মধ্যে একত্রে অবস্থান করতে পারে।
কিন্তু এসকল তত্ত্বকে উপেক্ষা করে প্রথমবারের মত নতুন এক ছায়াপথের সন্ধান পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ। এই ছায়াপথে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি নেই বললে চলে। কাজেই এই আবিষ্কার বিজ্ঞানী ও গবেষকগণকে সকল অনুসিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। কারণ এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রতিটি ছায়াপথের ক্ষেত্রে এই ডার্ক ম্যাটার তত্ত্ব অনুসরণ করা হয়েছে। কেবল এই নতুন আবিষ্কৃত ছায়াপথের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে।
প্রায় ২০০০ সালের দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ প্রথম আবিষ্কার করেন এই ছায়াপথকে। দেখতে অনেকটা ফটোগ্রাফিক প্লেটে ঘষা অস্পষ্ট ছোপের মত। এই ছায়াপথে আকার প্রায় মিল্কিওয়ে অর্থাৎ আমাদের ছায়াপথের সমান। কিন্তু এটি এতটাই অস্পষ্ট যে, একে টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। কোনো এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই ছায়াপথকে NGC1052-DF2 নামে ক্যাটালগভূক্ত করেছিলেন।
অতি-বিকীর্ণ (Ultra-diffuse) ছায়াপথগোত্রের সদস্য ধরা হয় এই ছায়াপথকে। আকারে আমাদের ছায়াপথের সমান হলেও এটি প্রায় শত-সহস্র গুণ কম পরিমাণ নক্ষত্র ধারণ করে। প্রায় একবছর যাবৎ এটি দুর্বোধ্য থেকে যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের কাছে। বছরখানেক পরে বিজ্ঞানীগণ ড্রাগনফ্লাই টেলিফটো অ্যারে নামক টেলিস্কোপের সাহায্যে একে ভালো করে দেখতে সক্ষম হন। এই ধরনের টেলিস্কোপে মূলত ৪৮টির মত টেলিফটো লেন্স থাকে যা মহাকাশের এসব অস্পষ্ট বস্তু দেখার কাজে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। অনেকটা ড্রাগনফ্লাই বা গঙ্গাফড়িং এর চোখের মত হওয়ায় এর এমন নামকরণ করা হয়েছে। তো যখন এই বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা হল, তখন দেখা গেলো যে এই ছায়াপথে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি খুবই নগণ্য।
এখন ডার্ক ম্যাটার কি এবং কেন সেটি একটু জানা যাক।
প্রকৃতপক্ষে ডার্ক ম্যাটার আসলে কী তা আমরা জানি না। আবার ডার্ক অর্থাৎ অন্ধকার বা কালো শব্দ দ্বারাও একে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করাও সম্ভব না। অনুকল্পিত এবং রহস্যময় এই বস্তু সম্পর্কে বিজ্ঞানীগণও সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হননি। তবে একে গবেষকগণ স্বচ্ছ বস্তু হিসেবেও বলে থাকেন এবং এটিকে অপরিচিত বস্তুকণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। গবেষকগণের মতে এই বিশেষ বস্তুকণা মূলত কোনো কিছুর জন্য স্থান ধারণ করে থাকে, যে বস্তু অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু বলা যায় যে এর মধ্যে নিশ্চই কিছু না কিছু আছে।
বস্তুত, এটি যে আদৌ কোনো বস্তুকণা কিনা সে বিষয়েও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না কারণ এই বস্তুকণা এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ায় বাইরে। আমরা কেবল অন্য বস্তুর উপর এর প্রভাব দেখেই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। বিভিন্ন বস্তুর উপর এর প্রভাবের মধ্যে আছে গ্রহ ও নক্ষত্রের গতিময়তা এবং এদের গতিপথ কিংবা ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে আলোর বেঁকে যাওয়ার প্রবণতা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিটার ভ্যান ডকিউম এর মতে, “ বেশ কয়েকটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া, যেমন ছায়াপথের উত্থান এবং মহাকাশে এদের বণ্টনের বিশদ ও সুসঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য ডার্ক ম্যাটার মডেল খুবই উপযোগী। কিন্তু এটি আসলে কী সেটি আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। তবে যদি আমরা পুরো মহাবিশ্বকে ডার্ক ম্যাটারের দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিশ্লেষণ করি তবে এসব গ্রহ ও নক্ষত্রকে মনে হবে ডার্ক ম্যাটার সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদবুদের মত। সত্যিকার অর্থেই ডার্ক ম্যাটার হচ্ছে এই মহাবিশ্বের কংকাল যার উপর সবকিছু নির্মিত। এই প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায় যে, ডার্ক ম্যাটারবিহীন ছায়াপথ পাওয়া আসলে যুক্তি বহির্ভূত।”
তো এই ছায়াপথকে যখন ড্রাগনফ্লাই টেলিফটো অ্যারে দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ এর অভ্যন্তরে প্রায় ১০টির মত খুবই উজ্জ্বল বিন্দু প্রত্যক্ষ করেন। মূলত এগুলো ছিলো অত্যধিক উজ্জ্বল নক্ষত্রদের স্বতস্ফূর্ত বিচ্ছুরণ। এদের একত্রে বলা হয় গ্লোবিউলার ক্লাস্টার। এখন এই পরিব্যপ্ত আলো ও গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলো ছায়াপথের ভর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এদের গতির পরিমাপ করে ছায়াপথের ভর নির্ণয় করা সম্ভব। যেমন আমাদের সূর্য যদি এর বর্তমান ভরের থেকে চার গুণ বেশি ভরের হতো, তাহলে পৃথিবী ঘুরতো দ্বিগুণ গতিতে। কারণ সেটা না করলে পৃথিবী সোজা গিয়ে পড়তো সূর্যের মধ্যে।
কাজেই যখন এই পদ্ধতি ছায়াপথের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে অর্থাৎ এর অভ্যন্তরের নক্ষত্রদের গতি পরিমাপ করা হবে, তখন এর ভরও আমরা নির্ণয় করতে পারি। যদি এর অভ্যন্তরে নক্ষত্রদের গতিবিধি হয় অত্যধিক, তাহলে ছায়াপথের ভরও হবে অত্যধিক। তার মানে দাঁড়ায় যে, ভর অধিক হলে এর মধ্যে অবস্থিত বস্তুকণার পরিমাণও হবে অত্যধিক। অন্যদিকে এর উল্টো হলে অর্থাৎ নক্ষত্রদের গতি ধীর হলে ছায়াপথের ভর হবে অনেক কম। এখন আমাদের নতুন আবিষ্কৃত ছায়াপথের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে নক্ষত্রদের গতিবিধি এতটাই ধীর যে তাদের দেখে মনে হয় তারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই গবেষকগণের দেয়া তত্ত্ব অনুযায়ী এটুকু বলা যাবে যে, সেখানে খুবই কম পরিমাণ বস্তুকণার অর্থাৎ ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি আছে কিংবা নেই।
তবে এটাই কিন্তু একমাত্র রহস্যজনক ব্যাপার নয়। যে গবেষক দলটি এই ডার্ক ম্যাটারবিহীন ছায়াপথটি খুঁজে পেয়েছে তারাই আবার আরেকটি ছায়াপথ খুঁজে পেয়েছে যে ছায়াপথ পুরোটাই গঠিত হয়েছে ডার্ক ম্যাটার দিয়ে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পূর্বের ছায়াপথটি পরের ছায়াপথটির সাথে যথেষ্ট মিলে যায়। বিষয়টা সত্যি এক পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পরবর্তীতে এই রহস্যময় ছায়াপথটিকে আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য নাসার হাবল টেলিস্কোপ এর সাহায্যে এবং জেমিনি অবজারভেটরি থেকেও গবেষণা করা হয়। জেমিনি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে দেখা যায় যে অন্য কোনো ছায়াপথের সাথে এই নতুন ছায়াপথের কোনো প্রকার মিথস্ক্রিয়া নেই যা অতি বিকীর্ণ ছায়াপথ গোত্রের মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয়।
হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে এর ভেতরে অবস্থানকারী গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলো সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায় এবং সেইসাথে এর দূরত্বও নির্ণয় করা হয়। হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে আরো যে জিনিসটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে এই ছায়াপথের স্বচ্ছতা। গবেষকদলটি বলেন যে, টেলিস্কোপে ধারণকৃত ছবি দেখে অবাক হতে হবে কারণ এই ছায়াপথটি খুবই স্বচ্ছ অর্থাৎ যদি এর অপর পাশে অন্য কোনো ছায়াপথ থাকতো, তাহলে এটি ভেদ করে সেই ছায়াপথটিও দেখা সম্ভব হতো। ভৌতিক এই ছায়াপথের নেই কোনো কেন্দ্রীয় অঞ্চল, না আছে সর্পিলাকার বাহু কিংবা চাকতি। আবার এটি যে কৃষ্ণ গহ্বর সেটিও নয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এটি প্রায় ১০ মিলিয়ন বছর অতিক্রম করে ফেলেছে এরই মধ্যে।
এমনকি এদের ভেতরকার গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলোরও কোনো সঠিক কেন্দ্রবিন্দু নেই এবং এরা সাধারণ মহাজাগতিক বস্তুপূঞ্জ থেকে আকারে প্রায় ২-৩ গুণ বৃহৎ। গবেষকদলের প্রধান ভ্যান ডকিউম এর মতে, এই ধরনের ছায়াপথের ব্যাখ্যা প্রদান করার মত কোনো তত্ত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কাজেই এটি একপ্রকার রহস্যই থেকে যাবে। যতদিন না সঠিক তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন একে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে বলে তাদের ধারণা। আর যদি এর ব্যাপারে সঠিক কোনো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে ছায়াপথ ও ডার্ক ম্যাটার গবেষণায়ও যুক্ত হবে নতুন মাত্রা।
ফিচার ইমেজ: unsplash.com