গত ২২শে ফেব্রুয়ারি হায়াবুসা -২ নামের একটি জাপানী মহাকাশযান ‘র্যুগু’ নামের একটি গ্রহাণুপৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণ করেছে। এই গ্রহাণুটি একটি সি-টাইপ (কার্বোন্যাসিয়াস) গ্রহাণু। সেজন্য বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই গ্রহাণু থেকে সংগৃহীত নমুনায় পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এই হিসেবে মানুষের মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে একে।
জাপানের স্থানীয় সময়ানুযায়ী মহাকাশযানটি সকাল ৭:৪৯ মিনিটে র্যুগুর মাটিতে পা রেখেছে। তার আগে গ্রহাণুটির পৃষ্ঠের ২০ কিলোমিটার উপরের একটি স্থায়ী কক্ষপথে অবস্থানরত থেকে গ্রহাণুপৃষ্ঠে নেমে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল হায়াবুসা-২। পৃথিবী থেকে ৩১০ কিলোমিটার দূরের যে জায়গায় এই ঘটনা ঘটেছে, আলোর বেগে সিগন্যাল আদান-প্রদান করলেও সেখানে রিয়েল-টাইম কন্ট্রোল করা সম্ভব না। অর্থাৎ কোনো নির্দেশ দিলে, সেই সিগন্যালটি আলোর বেগে ছুট দিলেও নির্দেশ পালন করতে কিছুটা দেরি হয়েই যাবে মহাকাশযানটির। সেজন্য পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল স্বয়ংক্রিয়। এবং এখন আমরা জানি, প্রক্রিয়াটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মাটি স্পর্শ করার সময় হায়াবুসা-২ এর বেগ ছিল প্রতি সেকেন্ডে মাত্র সাত সেন্টিমিটার। এবং পুরো কাজটি করতে সময় লেগেছে ২৩ ঘন্টা। বাকি কাজ, নমুনা সংগ্রহ। সবকিছু পরিকল্পনানুযায়ী হলে, হায়াবুসা-২ এর এক মিটার দীর্ঘ একটি বাহু বুলেটের মতো একটি জিনিস ছুঁড়ে দেবে গ্রহাণুটির পৃষ্ঠদেশে। এতে ০.১ গ্রামের মতো নমুনা সংগ্রহ করে রাখার জন্য একটি ক্যাপসুল আছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে সেই নমুনা বিশ্লেষণ করার সুযোগ হবে বিজ্ঞানীদের।
হায়াবুসা-২ নমুনা সংগ্রহ করতে পেরেছি কি না, সেটা এই মুহূর্তে সরাসরি জানার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। কিন্তু নমুনা সংগ্রহের আগে-পরের পুরো সময়টুকু তার ছবি তোলার কথা। যে ছবি দেখে পরবর্তীতে বোঝা যাবে, প্রক্রিয়াটি আসলেই সফল হয়েছে কি না। নমুনা সংগ্রহ শেষ হওয়ার পরে (হিসেব অনুযায়ী এর মধ্যেই হয়ে যাওয়ার কথা) মহাকাশযানটি অর্ধদিনের মধ্যে গ্রহাণুপৃষ্ঠের নির্ধারিত জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যেটাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন ‘হোম পজিশন’।
বিজ্ঞানীরা হায়াবুসা-২ এর সংগৃহীত নমুনা নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত। ফ্র্যান্সের কোঁত্যে দ্য’অ্যাজুর অবজারভেটরিতে কর্মরত মিশনের ইনভেস্টিগেটর প্যাট্রিক মাইকেল এ ব্যাপারে বলছিলেন,
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা (সম্ভবত) একটি কার্বোন্যাসিয়াস গ্রহাণুর নমুনা পেতে যাচ্ছি। এটা আমাদের জন্য দারুণ আনন্দের একটি ব্যাপার।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA) হায়াবুসা-২ লঞ্চ করেছিল, যেটা র্যুগুতে পৌঁছেছে ২০১৮ সালের জুনে। র্যগুর ব্যাস মাত্র ১,০০০ কিলোমিটারের মতো হলেও এতে দারুণ এক বৈজ্ঞানিক সম্পদ রয়েছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ কীভাবে হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু প্রাণের সূচনা কেমন করে হলো, এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর আমাদের এখনো জানা নেই। যদিও এ নিয়ে দারুণ কিছু হাইপোথিসিস বা প্রকল্প আছে, এবং এসবের কোনো কোনোটার সমর্থনে বেশ ভালো প্রমাণও আছে- তারপরও আমাদের সব ধরনের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, এমন কোনো শক্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে এটুকু জানা গেছে যে, পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা হয়েছে ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে। সে সময় পৃথিবী ছিল প্রচন্ড উত্তপ্ত। এর কিছুকাল আগে পৃথিবী বেশ ভালোরকম ঝক্কির মধ্যে দিয়ে গেছে। একের পর এক উল্কাপাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পৃথিবীর বুক। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা এখন পৃথিবীকে যেরকম গোলাকার (আসলে, কমলালেবুর মতো কিছুটা চ্যাপ্টা) দেখি, সেসময় পৃথিবী ঠিক এমন ছিল না। এর আকৃতি ছিল কিছুটা অনিয়ত। মহাকর্ষ, সৌরবায়ু এবং বিশেষ করে গ্রহদের মধ্যেকার সংঘর্ষের ফলে গোলাকার আকৃতির বাইরের বাকি সব কিছু পৃথিবী (এবং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ) থেকে ঝরে গেছে।
যে ধরনের আকৃতি হলে গ্রহদের উপর মহাকর্ষ সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করতে পারে, সেই আকৃতিতেই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে গ্রহগুলো। আর যে অংশগুলো গ্রহদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেছে, এরাই পরিণত হয়েছে উপগ্রহ এবং গ্রহাণুতে। চাঁদের জন্মও হয়েছে এভাবে। র্যুগুর জন্মও হয়তো এভাবেই হয়েছে। এ ধরনের গ্রহাণুদের আবার অনেক প্রকারভেদ আছে। যেমন- এস-টাইপ গ্রহাণুরা হলো পুরো পাথুরে। সি-টাইপ বা কার্বোন্যাসিয়াস গ্রহাণুগুলোতে হাইড্রোজেন, পানি ইত্যাদি থাকে। এবং এদের পৃষ্ঠদেশ পুরো পাথুরে নয়। সেজন্যেই ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর ঠিক কী অবস্থা ছিল, র্যুগু থেকে সংগৃহীত নমুনা থেকে সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। আরেকটি সম্ভাবনাও আছে। প্রাণের মূল উপাদান, কার্বন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন ইত্যাদি কোনো উল্কাপিণ্ড বা অন্য কোনো গ্রহের খন্ডাংশ থেকে তৈরি গ্রহাণু থেকেও এসে থাকতে পারে। হয়তো কোনো গ্রহাণু বা উল্কাপিণ্ড আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে এবং নিয়ে এসেছে হাইড্রোজেন বা এমন কোনো অণু।
এ কাজের জন্য হায়াবুসা-২ ২০১৮ সালের শেষের দিকে র্যুগুর চারপাশে ঘুরপাক খাওয়ার সময়ই গ্রহাণুটির একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করে নিয়েছে। সাথে তিনটি ছোট রোভারও পাঠিয়েছে গ্রহাণুটিতে। এই বছরের শেষের দিকে চতুর্থ আরেকটি রোভার পাঠাবে মহাকাশযানটি। তবে এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য একটিই, গ্রহাণুপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা। এ কাজের জন্য এর পূর্বসুরী হায়াবুসা-১ এর ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর মতো একই ধরনের যন্ত্রই ব্যবহার করছে মহাকাশযানটি। হায়াবুসা-১ ২০১০ সালে ইতোকাওয়া নামে একটি এস-টাইপ বা পাথুরে গ্রহাণু থেকে ধুলোবালির নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিল, এবং সেটিই ছিল গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফেরা প্রথম মহাকাশযান।
তবে হায়াবুসা-১ এর নমুনা সংগ্রহ করার যন্ত্রটি ঠিকঠাক কাজ করেনি সেবার। সেজন্য সামান্য ধুলোবালি সংগ্রহ করতে পারলেও আশানুরূপ তেমন কিছু সংগ্রহ করতে পারেনি মহাকাশযানটি। তবে হায়াবুসা-২ নিয়ে যেসব ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন, তারা সেই সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। এবং সবকিছু যদি ঠিকভাবে হয়ে থাকে, তাহলে দারুণ কিছু পেতে যাচ্ছি আমরা। এই মিশনের ম্যানেজার এবং জাক্সায় কর্মরত বিজ্ঞানী মাকোতো ইয়োশিকাওয়া জানান,
আশা করি, এবার আমরা যে নমুনা সংগ্রহ করবো, তাতে জৈব পদার্থ থাকবে। যেটা ইতোকাওয়ায় পাওয়া যায়নি। আমাদের মূল লক্ষ্যও সেটাই।
জৈব পদার্থ মানে, সূর্যালোক এবং পানি সমৃদ্ধ কার্বনের যৌগ। প্রাণের পেছনের মূল ভিত্তি বলতে এ ধরনের জৈব পদার্থকেই বোঝানো হয়।
মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রহাণুপৃষ্ঠের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় নেমে নমুনা সংগ্রহ করার কথা ছিল হায়াবুসা-২ এর। তবে, মহাকাশযানটি গ্রহাণুপৃষ্ঠে নামার আগেই গ্রহাণুপৃষ্ঠের যেসব ছবি পাঠিয়েছে, সেসব দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের আশানুরূপ সহজ হবে না কাজটা।
র্যুগুর পৃষ্ঠের অনেক জায়গাতেই রবারের মতো পাথর এবং বোল্ডার রয়েছে, যেগুলো নমুনা সংগ্রহের কাজে ভালোই বাধা দেবে। সেজন্যে নামার আগে, চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া অবস্থাতেই হায়াবুসা-২ গ্রহাণুটির পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করেছে এবং যেসব জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে, সেরকম কিছু জায়গা খুঁজে বের করেছে। তারপরেও প্রথম দফা নমুনা সংগ্রহের কাজ শেষ হওয়ার পরে এটি হয়তো সর্বোচ্চ আরেকটি জায়গায় নেমে নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করে দেখবে। তবে এটি একটু বেশিই আশা করার মতো। কারণ, দ্বিতীয় নমুনা সংগ্রহের পরিকল্পনাটি ঠিক গ্রহাণুপৃষ্ঠের না। গ্রহাণুর বুকের ভেতর থেকেও কিছু অংশ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। সেই হিসেবে এপ্রিলের দিকে হায়াবুসা-২ মাটির কিছুটা উপরে থেকে প্রতি সেকেন্ডে দুই কিলোমিটার বেগে এক কেজি ভরের একটি ইম্প্যাক্টর (বুলেটের মতো একটি জিনিস) ছুঁড়ে দেবে মাটির দিকে, যেটা গ্রহাণুর ভেতর থেকে ২-৩ মিটারের একটি ছোট্ট খন্ডাংশ ভেঙে বের করে আনবে। তারপর বিজ্ঞানীরা সব ঠিকঠাক থাকলে মহাকাশযানটিকে আবারো গ্রহাণুপৃষ্ঠে নামাবেন এবং খন্ডাংশটি সংগ্রহ করার চেষ্টা করবেন। তবে এটা আদৌ করা যাবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এবং এরকম কিছু আগে কখনোই করা হয়নি।
কাকতালীয়ভাবে নাসার বিজ্ঞানীরাও এখন ওসাইরিস-রেক্স নামের একইরকম একটি মিশন পরিচালনা করছেন। বেন্যু নামের আরেকটি সি-টাইপ গ্রহাণু থেকে সর্বোচ্চ দুই কিলোগ্রাম নমুনা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন তারা। সেটার মূল মিশন অবশ্য পরিচালিত হবে ২০২০ সালে। ফলে আমেরিকা জাপানের এই মিশনে যুগ্মভাবে কাজ করতে এবং যথাসম্ভব সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। হায়াবুসা-২ এর গ্রহাণুপৃষ্ঠে নেমে নমুনা সংগ্রহ করার বিভিন্ন ছবি ও তথ্য-উপাত্ত দেখে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু জানতে পারবেন বলে মনে করছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। সেরকম একজন বিজ্ঞানী হলেন দান্তে লরেত্তা, যিনি ওসিরিস-রেক্স মিশনের প্রধান ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করছেন। একইসাথে তিনি হায়াবুসা-২ মিশনের একজন ইনভেস্টিগেটর হিসেবেও কাজ করছেন। তার মতে,
তাদের এই মিশনে নমুনা সংগ্রহের সময় কী হয়, তা দেখার জন্য আমরা বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। জাক্সার সঙ্গে একটি মিটিং করে এই মিশন থেকে জানা গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয় সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো আমরা।
২০১৯ সালের শেষের দিকে হায়াবুসা-২ র্যুগু থেকে রওনা দেবে এবং ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে পৌঁছাবে পৃথিবীতে। আশা করা যায়, মহাকাশযানটি সাথে নিয়ে আসবে মূল্যবান নমুনা। এই মিশনটির মতোই ওসাইরিস-রেক্সও যদি সফল হয়, আমরা হয়তো জানতে পারবো, কেমন করে প্রাণের উপাদানগুলো পৃথিবীতে এসেছিল। কিংবা হয়তো এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না। হয়তো সে সময়ের পৃথিবীর অবস্থা কেমন ছিল, এ ব্যাপারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেলেও অধরাই থেকে যাবে আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তরটি। তবে, সেজন্য সবার আগে র্যুগু থেকে সংগৃহীত নমুনায় জৈব পদার্থের অস্তিত্ব থাকবে হবে। এবং নমুনায় আদৌ জৈব পদার্থের অস্তিত্ব আছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যও আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের শেষাবধি।
এখন কেবল অপেক্ষা…