বিশাল দালানের বিশাল করিডর ধরে প্রায়ই হাঁটতে দেখি এক যুবক সৈন্যকে। চলাফেরায় কেমন যেন অনিশ্চিত ভঙ্গিমা। মাঝে-মাঝে থেমে তাকায় জানাল দিয়ে বাইরে। ১৯৩০ সনের দিকে সাদা-কালো যুগে, ভূতের চলচ্চিত্রে যেমন জীবন্মৃতদের দেখাতো, ঠিক তেমনটা লাগত ওকে। আমাকে দেখে কখনো কিছু বলেনি, এমনকি কোনদিন আমাকে লক্ষ্য করেছে বলেও মনে হয়নি। বুঝে-শুনে পা ফেলছে বা বুঝে শুনে হাঁটছে, এমনটা কেউ ওকে দেখে বলবে না!
রেড ম্যাকগ্রেগর ছিল আমার ওয়ার্ড সার্জেন্ট, ওকেই জিজ্ঞেস করলাম। হাসপাতালের সবকিছু ওর নখদর্পণে, জানে ইউ.এস. সেনাবাহিনীর ব্যাপারেও। কোরিয়ার যুদ্ধে স্বাস্থ্যসেবী হিসেবেও ছিল সে। কদিন আগেই বলেছিল মাঝে মাঝে অজ্ঞান কিছু সৈন্য আসত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। তাপমাত্রা মাপতে গিয়ে কারো কারো ক্ষেত্রে একশো ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যেত!
পশ্চিম টেক্সাসে গ্রীষ্মকাল আসে দেরি করে, আবার বিদেয় নিতেও করে গড়িমসি। সূর্য একেবারে নিষ্ঠুরের মতো তার রাগ ঢেলে দেয়।
আমি যে সৈন্যটির কথা জানতে চেয়েছিলাম, সে বেচারা হিট স্ট্রোকে ভুগছিল। আফসোসের কথা হলো, মাঠ-পর্যায়ে ওর চিকিৎসা শুরু করতে বিলম্ব হয়ে যায়। হাসপাতালে আসার পরেও সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করা যায়নি।
এই রোগের মাঠ-পর্যায়ের চিকিৎসা হলো প্রথমেই রোগীর পোশাক ছাড়িয়ে গা খালি করে ফেলা। তারপর গায়ে পানি ঢালা, সম্ভব হলে বরফও। হাসপাতালে আনার পর, বরফের সংস্পর্শে রাখা হয় রোগীকে; দেহের তাপমাত্রা কমাতে হয় যতটা সম্ভব কম সময়ে। হিট স্ট্রোককে মেডিক্যাল ইমার্জেন্সিই বলতে হবে। এর চিকিৎসায় একটুও দেরি করা যায় না। যদি করা হয় তাহলে মস্তিষ্ক চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।
রেড জানাল, ঐ যুবকের ক্ষেত্রে দেরি হয়েছে দুই প্রান্তেই। ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেচারার মস্তিষ্ক। সেটারই প্রতিফলন দেখেছি আমি। তবে আগের চাইতে নাকি উন্নতি দেখা যাচ্ছে কিছু, যদিও পুরোপুরি ঠিক হবে না কখনোই। স্মৃতি বলতে কিছুই নেই বেচারার, অংক কষতে পারে না। এমনকি সাধারণ সব নির্দেশ পালনেও ভুল হয়। মাঝে মাঝে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে পড়ে, ঘুরতে থাকে হাসপাতালের হলে। বেশ কিছুদিন পর ছুটি দিয়ে দেয়া হয় হতভাগা সৈন্যকে, আর কোনদিন ঠিক হবে না বেচারা!
যে সেনাপ্রধান দায়িত্বে ছিলেন, তিনি খেপে যান। ঘোষণা করেন- ভবিষ্যতে যদি কোনো ফিল্ড কমাণ্ডারের অধীনস্থ সৈন্যদের একজনও হিট ইনজুরির শিকার হয়, তাহলে তাকে কোর্ট মার্শালে দাঁড়াতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ‘কর্তব্যে অবহেলা’র দায়ে সাজা পেতে হবে। অবহেলা বলতে সেনাপ্রধান বোঝান- মাত্র একটা এমন ঘটনা ঘটাই যথেষ্ট। কেননা তীব্র গরমের কারণে হিট স্ট্রোক হওয়া অস্বাভাবিক না হলেও, সেটার কারণে এমন বড় কোনো ধরনের সমস্যা হওয়া খুবই অস্বাভাবিক! চাইলেই শতভাগ প্রতিরোধ সম্ভব। যদি ফিল্ড কমাণ্ডার একটু সাবধান হন, তাহলেই হিট ইনজুরি হবার কোনো চান্স নেই!
হিট ইনজুরি বলতে আমরা কী বোঝাই, সেটা বলি। দুই ধরনের হিট ইনজুরি আছে। একটা হলো হিট এক্সহশন বা গরম-জনিত ক্লান্তি (Heat exhaustion), আরেকটা হচ্ছে হিট স্ট্রোক বা তীব্র গরমের কারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। প্রথমটার কারণ মাত্রাতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীর থেকে লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) বেরিয়ে যাওয়া। সাধারণত আমরা তীব্র গরমে প্রচুর পানি খাই, তাতে লবণ থাকে না। একদিকে লবণ বেরিয়ে যাচ্ছে, আরেকদিকে আমরা তরলের অভাব পূরণ করছি লবণহীন পানি খেয়ে- দুইয়ে মিলে হিট এক্সহশন।
যদি এই অবস্থার প্রতিকার না হয়, তাহলে খিঁচুনি শুরু হওয়াও বিচিত্র না। রোগী প্রথমে তীব্র ক্লান্তি বোধ করে, সঙ্গে থাকে হাত-পায়ের মাংসপেশিতে টান। এর চিকিৎসা হলো পানি বেশি না খাওয়া, এবং সেই সঙ্গে লবণ-ট্যাবলেট খাওয়া। আজকাল অবশ্য লবণ-ট্যাবলেট না খেয়ে বলা হয় লবণ মিশ্রিত নানা ধরনের পানীয় খেতে। যদি পরিস্থিতি আরো গুরুতর হয় তাহলে শিরা-পথে স্যালাইন দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
হিট স্ট্রোকের ব্যাপারটা আলাদা। ১৯৫৭ সনে, কারণটা আজও আমরা জানি না, প্রচণ্ড গরমে থাকা এক ব্যক্তির শরীর থেকে আচমকা ঘাম বেরোনো বন্ধ হয়ে যায়। শরীর যখন তাপমাত্রা হারাতে চায়, তখন ঘামের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য পূরণ করে। তাই এই পথ বন্ধ হয়ে গেলে, দেহের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে তীব্রভাবে। কখনো কখনো ১০৬ বা ১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে যায়।
এই উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মানুষ মারাও যেতে পারে। এই সমস্যার জন্য অবশ্য দরকার প্রতিরোধ। প্রথম ধাপ হচ্ছে তীব্র গরমে একটানা কাজ না করে, প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে দশ মিনিটের জন্য ছায়ায় অবস্থান নেওয়া। এই সময়টায় কোনো ধরনের কায়িক পরিশ্রম করা নিষেধ।
এই ঘটনার পর সতর্ক হয়ে গিয়েছে সবাই। প্রতিটি ফিল্ড ইউনিট এখন সঙ্গে রাখছে পানি, লবণ-ট্যাবলেট ট্রাক-ভর্তি বরফ। এখানে আবারো বলছি, আজকাল ওটা ব্যবহার করতে অনুৎসাহিত করা হয়। যদি কারো ক্ষেত্রে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়, তাহলে যেন চিকিৎসা করতে সমস্যা না হয় সে পরিস্থিতির জন্য রাখা হয়।
আমরা কাজ করতাম হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে। তিনটি বড় বড় বাথটাব এবং একটা বড় মেশিন রাখা ছিল সেখানে। কয়েক মিনিটের মধ্যে যন্ত্রটা কয়েক ব্যাগ বরফ-চূর্ণ বানাতে পারত। কোনো ফিল্ড ইউনিট যদি জানাত যে ওদের কারো তাপজনিত উপসর্গ দেখা দিয়েছে, ডিসপেনসারির সবাই নেমে পড়ত কাজে। মাঝে মাঝে আমরা প্রস্তুতি মহড়াও চালাতাম, নিজেদেরকে তৈরি রাখার জন্য।
প্রস্তুতি নেওয়া শেষ হবার কিছুদিনের মাঝে, এ ধরনের প্রথম ঘটনা ঘটল। আমাকে প্রায় টেনে ডিসপেনসারিতে নিয়ে এল রেড। ইমার্জেন্সি কামরার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে লোকটা বিড়বিড় করে বলল, “আরো আসবে। এসব রোগী একা-একা আসে না!”
কথাটা অদ্ভুত শোনাল আমার কানে। ডিসপেনসারির পেছনে, লোডিং ডকে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। এমন সময় দূর আকাশে দেখা গেল তিনটা বড়-বড় ট্রাক, ধুলোর মেঘ উড়িয়ে আসছে এদিকেই। “রেডিওতে জানালো, দশজন নাকি আক্রান্ত হয়েছে” সবাইকে জানালো রেড। “আমি আগেই বলেছিলাম, এই রোগী কখনোও একা আসে না।”
ট্রাকগুলো এসে থামল লোডিং ডকে। আমরা একের পর এক, অজ্ঞান সৈন্যদের নামাতে লাগলাম। দশ জনের কারোরই জ্ঞান নেই, দেহে নেই একটা সুতোও। বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় বড় বলে দায়িত্ব নিলো রেড। অন্য কেউ হলে হয়তো প্রথমেই এক এক করে সবার তাপমাত্রা নিত। কিন্তু আমরা সরাসরি ওদেরকে ফেলে দিতে লাগলাম বরফ ভর্তি বাথটাবে, খবর পেয়েই সবগুলো তৈরি করে রাখা হয়েছে। একেকটায় দুটো-তিনটে করে দেহ রাখলাম আমরা।
সৈন্যদের দুজন বরফের স্পর্শ পাবার আগেই জ্ঞান ফিরে পেল। বাকিরা কয়েক সেকেণ্ডের মাঝেই শুরু করল চিৎকার-চেঁচামেচি! মিনিটখানেকের মাঝে একজন বাদে আর কেউ রইল না।
এই একজন মাত্র সৈন্যই প্রকৃতপক্ষে হিট ইনজুরির শিকার। আরো কয়েক মিনিট একেবারে মরার মতো পড়ে রইল সে। নড়ল তারপর। অন্য নয়জন ততক্ষণে কাঁপছে বসে বসে। কপাল ভালো, আক্রান্ত লোকটির তাপমাত্রা খুব একটা বেশি ছিল না, তাই কোনো চিরস্থায়ী ক্ষতিও হয়নি। রেড বলল, সবসময় নাকি এমনই হয়। বরফের এই পরীক্ষা সবসময় রোগ-নির্ণয়ে সাহায্য করে।
সৈন্যদেরকে নিয়ে আসা মাস্টার সার্জেন্ট জানালো, প্রায় সবাই নাকি একই সময়ে জ্ঞান হারিয়েছে। প্রথমে একজন মানুষ আছড়ে পড়েছিল মাটিতে, তার দেখাদেখি বাকি নয় জনেরও সে রকম হয়। সার্জেন্টের মতে, কয়েকজন আসলেই অজ্ঞান হয়েছিল, তবে ভানও ধরে ছিল কয়েকজন। ওখানেই চিমটি কেটে সবাইকে পরখ করে দেখেছিল সে। আটজনের কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি।
তবে বাথটাবে শোয়াবার পরও যাদের কিছুক্ষণ সময় লেগে যায় জ্ঞান পেতে, তারা ভান করছিল বলে মনে হয় না। এদের সবাই জ্ঞান ফিরে পাবার পর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেনি, লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে বাথটাব থেকে!
লোকটার এহেন কথায় অবাক হয়ে গেলাম আমি। যতদূর বুঝতে পারলাম, প্রথমে একজন সৈন্য হিট ইনজুরির কারণে জ্ঞান হারায়। অন্যরা, সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখে, ধরেই নেয় যে এই পরিস্থিতিতে হিট ইনজুরি অস্বাভাবিক না। আগে থেকেই তারা অনুভব করছিল উত্তাপের প্রকোপ (বিশেষ করে নতুন যারা নাম লিখেয়েছে, তারা)। তাই প্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, মনে মনে বিশ্বাস করে যে ওরাও এতে আক্রান্ত। তবে গরম থেকে বাঁচার জন্য কয়েকজন যে ভান করছিল, তা তো একদম পরিষ্কার।
প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ হবার পর, বয়স্ক সার্জেন্ট একমত হলো রেডের কথার সঙ্গে। বলল যে এমন ধরনের একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়া, যাকে বলা হয় ‘সিমপ্যাথেটিক’, আগেও দেখেছে সে। প্যারেডে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সৈনিককে বেশিক্ষণ বিশ্রাম করতে দিলেও হয় এমন। সার্জেন্ট বিশ্বাস করে, একজন অজ্ঞান হলে তার দেখাদেখি আরও অনেকে হয়ে যায়। তার মতে- “হয় কেউ অজ্ঞান হবে না, আর নইলে অনেকেই হবে। এর মাঝামাঝি আর কিছু নেই!”
পরবর্তী সময়ে বহুবার এই ঘটনা মনে করে সময় কাটিয়েছি। মানুষের জৈব-অণুর দেহে এই ঘটনার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? তখন এই ঘটনাগুলোকে ডাকা হতো কগনিটিভ ডিসোনেন্স বা আচরণগত বৈকল্য!
তবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা কোনোভাবেই জৈব-অণু মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। একে আমি বলব সিমপ্যাথেটিক ইলনেস বা সমবেদী রোগ। হিট ইনজুরির এই কেসগুলোর ক্ষেত্রে নিজের চোখেই দেখেছি। এমনকি বেসামরিক ক্ষেত্রেও দেখা যায় এই রোগ, কখনো কখনো মহামারী রূপেও দেখা যায়।
[উপরোক্ত লেখাটি Clifton K. Meador কর্তৃক প্রণীত Symptoms of Unknown Origin: A Medical Odyssey বইয়ের অংশবিশেষ।]