বিড়ালের পর গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে কুকুর। মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে হাজার বছর ধরে এর সুনাম রয়েছে। মানব সভ্যতার শুরু থেকে মানুষের শিকার, কৃষিকাজ, ভ্রমণ, জীবনধারণ, বিনোদন, উপাসনা এমনকি মৃত্যুর সময়ও একমাত্র যে প্রাণীকে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি পাওয়া গেছে তা হলো কুকুর। তবে এই প্রাণী হাজার বছর আগে এমন ছিল না। বর্তমান কুকুরদের দেখলে কে বলবে যে তাদের পূর্বপুরুষদের হিংস্র মাংস খাদক হিসেবে সুনামও ছিল। কারণ আজকের মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হাজার বছর আগে ছিল মানুষের বসতি নির্মাণের প্রধান শত্রু হিংস্র নেকড়ে, যারা মোটেই কোনো নিরীহ বন্ধুসুলভ প্রাণী ছিল না।
ইতিহাস
কুকুরের উৎপত্তির ইতিহাস জানতে হলে আগে জানতে হবে কুকুরের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস। যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেন তারা এটুকু একমত যে, কুকুরের সাথে সবচেয়ে কাছাকাছি সম্পর্ক রয়েছে নেকড়ে বা গ্রে উল্ফের। জীবাশ্মবিদ্যা গবেষণা করে দেখেছেন যে নেকড়ের মতো দেখতে প্রাণীর উৎপত্তি প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে যাদের নাম মিয়াসিস (Miacis)। এরা এশিয়ায় বাস করত। ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগে এরা বিবর্তিত হয়ে বর্তমান নেকড়ের কাছাকাছি আকৃতি পায় যাদের নাম কায়ানোডিক্টিস (Cynodictis)। এরপর কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে এই কায়ানোডিক্টিস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ যায় আফ্রিকায়, আরেক ভাগ যায় ইউরেশিয়ায়। এই ইউরেশিয়ান প্রজাতির নাম টমার্চাস (Tomarctus) যাদের থেকেই আজকের কেনিস ল্যুপাস (Canis lupus) অর্থাৎ নেকড়ে, শেয়াল এবং কুকুরের উৎপত্তি।
এতদিন ধরে প্রচলিত ছিল কুকুরের সাথে মানুষের সম্পর্ক অন্তত ১৫,০০০ হাজার বছরের পুরোনো। ঠিক কবে থেকে কুকুর আর মানুষ একসাথে থাকা শুরু করেছে তা নিয়ে মতভেদ ছিল। তবে ২০১৫ সালে সুইডিশ জিন তত্ত্ববিদ পন্টাস স্কোগলুন্ড সাইবেরিয়ায় পাওয়া নেকড়ের ফসিলের জিনের উপর গবেষণা করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কুকুরের পূর্বপুরুষদের শিকারের সঙ্গী হিসেবে প্রায় ৩৬,০০০ বছর থেকে ৪০,০০০ বছর আগে থেকে ব্যবহার করা হত যা প্রকারান্তরে গৃহপালিত করার প্রথম পর্যায়।
পন্টাস স্কোগলুন্ড ২০১০ সালে সাইবেরিয়ার মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে একদল জিন তত্ত্ববিদকে সাথে নিয়ে টেমির উপদ্বীপে পাড়ি জমান। সেখানে বিভিন্ন প্রাণীর দেহাবশেষের সাথে একটি নেকড়ের চোয়ালের হাড় খুঁজে পান। এটাকে তিনি ল্যাবে এনে পরীক্ষা করে দেখেন, এই নেকড়েটি জীবিত থাকা অবস্থায় যেসব খাদ্য গ্রহণ করেছে বা এর জিন আধুনিক কিছু কুকুরের পিওর ব্রিডের সাথে মিলে যায় যা ঐ সময়ের নেকড়েদের থেকে কিছুটা ভিন্ন। তিনি কার্বন ডেটিং করে দেখেছে, এই নেকড়েটি ৩৬,০০০ বছর থেকে ৪০,০০০ বছর আগে জীবিত ছিল। তিনি মনে করেন, নেকড়েদের ধরে বন্দি করা হত এবং এরা বন্দি থাকতে থাকতে একসময় পোষ মেনে যায়।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় জিন তত্ত্ববিদ রবার্ট ওয়েন মনে করেন, মানুষ যখন ৪০,০০০ বছর আগে শেষ তুষার যুগের সময় ইউরোপ এবং এশিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল সেই সময়ে নেকড়েকেও পোষ মানায়। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাট শিপম্যান মনে করেন, তুষার যুগের সময়ে কুকুর মানুষকে শিকারে সাহায্য করেছে, যার ফলে মানুষ প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পেরেছে। তবে একটা বিষয়ে অনেক গবেষক একমত, আধুনিক গৃহপালিত কুকুরের পূর্বপুরুষদের মানুষ সর্বপ্রথম পোষ মানিয়েছিল মধ্য প্রাচ্য, চীন এবং পূর্ব ইউরোপে। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং জিন তত্ত্ববিদ গ্রেজার লারসনের মতে, পশ্চিম ইউরেশিয়ার কোথাও ধূসর নেকড়েদের মানুষ গৃহপালিত করেছিল।
জীবাশ্ম পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রায় চার হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাম্র যুগের সময়ে মানুষ পাঁচ ধরনের কুকুর পুষত যাদের মধ্যে একধরনের কুকুর তখনও নেকড়ের বৈশিষ্টসম্পন্ন ছিল। ধারণা করা হয়, এই পাঁচ ধরনের কুকুরের পূর্বপুরুষ একই- বন্য ক্যানিড (wild canids)।
প্রাচীন মানুষ পশু এবং মাছ শিকার করে ক্ষুধা মেটাত। কৃষিকাজ তখনও মানুষ শিখতে পারেনি। শিকার করা প্রাণীর উচ্ছিষ্টের মানুষ তার বসতির আশেপাশে ফেলে দিত। শিকারি নেকড়েরা গন্ধ শুঁকে এসব উচ্ছিষ্ট খাওয়া শুরু করল। কালক্রমে নেকড়েরা বুঝতে পারল কষ্ট করে শিকার করার চেয়ে এসব উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক সোজা। এজন্য কিছু নেকড়ে মানব বসতির কাছাকাছি থাকা শুরু করে। হয়তো মানুষ যখন শিকারে যেত এরাও মানুষের পিছু নিত। মানুষ যখন কোনো প্রাণীর পিছনে ছুটত এরাও হয়তো সেই প্রাণীর পিছনে ছুটত। হয়তো এই বিষয়টিই মানুষের নজর কাড়ে। কারণ এই নেকড়েরা ছিল মানুষের থেকে দ্রুতগতি আর ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন। এদের ঘ্রাণশক্তি প্রখর এবং শিকার করার সব ধরনের গুণাবলী এদের মধ্যে বিদ্যমান। তাই একদিন কুকুর হয়ে ওঠে মানুষের প্রধান শিকার-সঙ্গী।
তবে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে যে, মানুষ নেকড়েকে বন্দি করে পোষ মানিয়েছে নাকি মানুষের সাথে থাকতে থাকতে কুকুর পোষ মেনেছে। কিছু গবেষক মনে করেন, নারীরাই প্রথম হয়তো নেকড়েকে পোষ মানিয়েছিল। তবে বন্দি বানিয়েই হোক বা নেকড়ে স্বদিচ্ছায়, যাযাবর আদিম মানুষেরা যখন এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছে, এই নেকড়েরা তখন মানুষের সঙ্গী হয়েছে। এই সফরসঙ্গী, শিকার-সঙ্গী নেকড়েরাই কালক্রমে তাদের হিংস্রতা হারিয়েছে।
মানুষ যখন ধীরে ধীরে কৃষিকাজ শুরু করে তখন শিকারের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। ফসল উৎপাদন এবং পশুপালন করেই তারা জীবনধারণ শুরু করে। এই পর্যায়ে এসে নেকড়ে থেকে বর্তমানের কুকুর প্রজাতি আলাদা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করে। মানুষের কৃষিকাজ শুরুর পর্যায়ে যেসব নেকড়ের দেহাবশেষ পাওয়া যায় সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব প্রাণীর খাদ্যাভ্যাসে শর্করা জাতীয় খাবার ছিল, যা প্রমাণ করে মানুষের কৃষিজাত উচ্ছিষ্ট এরা গ্রহণ করত।
প্রাগৈতিহাসিক নেকড়ে থেকে আজকের কুকুর
নেকড়ে থেকে কুকুর হয়ে ওঠার পেছনে আরও কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকগণ। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে নেকড়ে এবং মানুষ দুই প্রজাতিই সঙ্গবদ্ধভাবে বসবাস করে। এরা দল ধরে শিকারে যায়। এই জটিল সামাজিক বন্ধনই তাদেরকে নিজেদের আকৃতির থেকে কয়েকগুণ বড় প্রাণী শিকার বা অন্যান্য শিকারি প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এই কারণেই নেকড়ে এবং মানুষ একসময় একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তুলনামূলক উন্নত মস্তিষ্ক এবং প্রস্তরনির্মিত অস্ত্রের উদ্ভাবনের কারণে মানুষ শিকারের ক্ষেত্রে বেশি সফল হতে থাকে। দলছুট বা দলের অন্যান্য সদস্যদের থেকে তুলনামূলক দুর্বল নেকড়েরা মানুষের বসতির আশেপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করে খাবারের গন্ধে। প্রথমদিকে হয়তো মানুষ তাদের আক্রমণ করে হত্যা করেছে, তবে একসময় অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে এরা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ঠিক এই সময় থেকেই নেকড়ের পোষ মানার প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস। মানুষ একসময় শিকার ছেড়ে কৃষিকাজের দিকে মনোনিবেশ করে। তারা বুঝতে পারে, অনিশ্চিত শিকারের থেকে ফসল উৎপাদন করে ক্ষুধা মেটানো অনেক সহজ। তারা কৃষিকাজ শুরু করলে খাদ্যে আমিষের মাত্রা কমতে থাকে আর শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকে। একদিকে যেমন পোষমানা নেকড়েরা শিকার করা ছেড়ে দেয়, অন্যদিকে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হতে থাকে। একসময় তাদের হিংস্রতা কমে যায়। তাদের এই বৈশিষ্ট্যই পরবর্তী প্রজন্মের নেকড়ের মাঝে বাহিত হয়। ধীরে ধীরে জিনগত পরিবর্তন ঘটে তাদের দাঁত এবং চোয়ালের আকার ছোট হয়, কান খাঁড়া থাকে না।
আরেকটি কারণ হচ্ছে যাযাবর মানুষের চলতি পথে এই পোষমানা নেকড়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের নেকড়ের মধ্যে মিলনে সংকর প্রজাতির নেকড়ের উদ্ভব হয়েছে, যা বর্তমান কুকুরের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। যারা প্রাকৃতিক ভাবে সংকরায়িত হয়নি, তাই নেকড়ের বৈশিষ্ট্যও বজায় থাকেনি।
আধুনিক কুকুর এবং নেকড়েদের কিছু আকারগত এবং জিনগত পার্থক্য থাকলেও তারা অনেকদিক দিয়েই একই রকম। কুকুরের কান ঝুলে থাকে, এদের চোয়াল শিকার না করার কারণে ছোট, মাথা ছোট এবং নম্র স্বভাব। জিনগত পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে খাবার হজমকারী অন্তত তিনটি জিন, যেগুলো শর্করা জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে। এগুলো নেকড়েদের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া একগুচ্ছ ভ্রূণ গঠনকারী জিন পাওয়া যায় যেগুলো কুকুরকে কুকুরসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।
মানব সভ্যতায় কুকুর
মানুষের সাথে কুকুরের প্রথম সহাবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্যপ্রাচ্যের ইজরায়েলে। ইজরায়েলের ইন-মাল্লাহ নামক স্থানে নাতুফিয়ান সংস্কৃতির একটি কবর পাওয়া যায় যেখানে একজন বৃদ্ধকে একটা ছয়-সাত মাস বয়সী কুকুরের সাথে কবর দেওয়া হয়, যা প্রায় ১২,০০০ বছরের পুরোনো।
দক্ষিণ ফ্রান্সের চৌভেট গুহায় এক বাচ্চার পায়ের ছাপের পাশাপাশি এক কেনাইনের (কুকুরের পূর্বপুরুষ) চার পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় যা প্রায় ২৪,০০০ বছরের পুরোনো। তবে মানুষের সাথে কুকুরের সম্পর্কের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় সাইবেরিয়াতে, এক হাস্কি কুকুরের, যা প্রায় ৩৬,০০০ বছর আগের। তুরস্কের গবেক্লি তেপের মন্দিরে পাওয়া গেছে পাথরে খোঁদাই করা ১২,০০০ বছর আগের কুকুরের চিত্র।
আরমেনিয়ার জ্যাঘাম পর্বতে পাথরে খোঁদাই করা কিছু চিত্র পাওয়া যায় যেখানে দেখা যাচ্ছে মানুষ আর কুকুর একসাথে ছাগল শিকার করছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় মনে করা হত তাদের দেবী ইন্নানা সাতটি সাতটি শিকারি কুকুর নিয়ে ঘুরতেন যাদের সবার গলায় চেইন দেওয়া দুল ছিল। অনেক নিদর্শন পাওয়া যায় যেখানে এসব চিত্র খোদিত রয়েছে। সুমেরীয়ার সহর উরুকে ৩,৩৩০ বছরের পুরোনো সোনার দুল পাওয়া গেছে যা কুকুরের গলার। প্রাচীন পারস্যে কুকুরকে পবিত্র মানা হত। তারা মনে করত কুকুরের আত্মার এক-তৃতীয়াংশ পশুর, এক-তৃতীয়াংশ মানুষের এবং আর এক-তৃতীয়াংশ ঈশ্বরের। একজন মানুষ কীভাবে কুকুরের সাথে আচরণ করে তা তার পরকালীন জীবনে প্রভাব ফেলত। মানুষকে কুকুরের প্রতি দয়াবান হতে উৎসাহিত করা হত। গর্ভবতী কুকুরকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করারও বিধান ছিল।
মহাভারতেও কুকুরের পবিত্রতার বর্ণনা পাওয়া যায়। একবার যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের স্থানে যাচ্ছিলেন। পথে এক বিশ্বস্ত কুকুর তার সফরসঙ্গী হয়। পথিমধ্যে যুধিষ্ঠির মারা যান, তবে কুকুরটি মালিকের সঙ্গ ছাড়ে না। সে-ও যুধিষ্ঠিরের সাথে পরকালে যাত্রা করে। যুধিষ্ঠির যখন স্বর্গের দরজায় পৌঁছায় তখন রক্ষী তাকে বলে যে শুধুমাত্র সে স্বর্গে যেতে পারবে। কুকুরটিকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যুধিষ্ঠির এই বিশ্বস্ত প্রাণীকে ছেড়ে একা স্বর্গে যেতে রাজি হয় না। সে-ও কুকুরটির সাথে পৃথিবীতে ফেরত আসতে চায়। তখন স্বর্গের রক্ষী বলে, এটা ছিল তার সর্বশেষ পরীক্ষা। সে কুকুরটিকে নিয়ে স্বর্গে যেতে পারবে। এরপর জানতে পারে কুকুরটি দেবতা বিষ্ণু।
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায়ও কুকুরকে অনেক শ্রদ্ধা করা হত। মিশরের সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতাদের মধ্যে ছিল শিয়াল আকৃতির দেবতা আনুবিস। মিশরে পালিত কুকুরের মালিক মারা গেলে সঙ্গী হিসেবে কুকুরকেও কবরে দেওয়া হত পরকালে সঙ্গী হওয়ার জন্য। কিছু বিখ্যাত পিরামিডের ভেতরে মমিকৃত কুকুর পাওয়া গেছে। প্রাচীন গ্রিসেও কুকুরকে দেবতাদের সঙ্গী মানা হত। পাতালের দুয়ারের রক্ষী ছিল তিন মাথাওয়ালা সারবেরাস। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থেও কুকুরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রাচীন চীনে কুকুর এবং মানুষের অদ্ভুত সম্পর্ক দেখা যায়। অনেকে মনে করে, প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে চীনেই প্রথম গৃহপালিত কুকুর ছিল। এখানে কুকুরকে শুকর শিকারে ব্যবহার করা হত। এখানে তাদেরকে যেমন সঙ্গী হিসেবে রাখা হত, তেমন খাবার এবং বলির কাজেও ব্যবহার করা হত। চীনে ভবিষদ্বাণী প্রদানে কুকুরের হাড় ব্যবহার করা হত। কুকুরের রক্তকে পবিত্র মনে করা হত, তাই শপথ গ্রহণের সময় কুকুরের রক্ত ব্যবহার করা হত। কুকুরকে বাড়ি বা শহরের ফটকের সামনে পুতে রাখা হত যাতে অশুভ কিছু প্রবেশ না করে। মানুষ কুকুরের হাড়ের তৈরি বিভিন্ন গয়না ব্যবহার করত, কারণ তারা মনে করত এতে ভুত-প্রেত কাছে আসবে না।
তবে মানুষ যখন সভ্যতা গঠন করল তখন দীর্ঘকাল ধরেই কুকুর ছিল ধনীর পোষ্য। গরিবের কুকুর পোষার অনুমতি ছিল না। অভিজাত ব্যক্তিবর্গ তাদের সাথে কুকুর রাখতেন, বিশেষ করে মহিলারা। গরিব মানুষদের কুকুরের মতো পবিত্র প্রাণী পালন অনেক জায়গায় পাপ হিসেবেও দেখা হত।
কুকুরের বর্তমান অবস্থা
কুকুরের বিবর্তনের একপর্যায়ে মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে তেমনই কুকুরের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। নিষ্ঠুর বনাঞ্চলের বাইরে কুকুররা বেঁচে থাকার নিরাপদ পরিবেশ পায়, ফলে তাদের বংশবৃদ্ধির হার দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। একসময় এই হার এতই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় যে, তারা আর মানুষের গৃহে আশ্রয় পায় না। এবার তাদের জঙ্গলেও ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না, কারণ হাজার বছরের বিবর্তনে তারা বনে টিকে থাকার সকল বৈশিষ্ট্যই হারিয়েছে। ফলে তাদের জায়গা হয় লোকালয়ের কোনো রাস্তায়। এরাই নেড়ি কুকুর, যারা কুকুরের মোট সংখ্যায় প্রায় ৭০-৮০%।
গৃহপালিত কুকুরের সংখ্যা নেড়ি কুকুরের থেকে অনেক কম। তবে এই কুকুরদের আচার-আচরণ এবং দৈহিক বিশিষ্টের উপর ভিত্তি করে এদের কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন: সঙ্গী কুকুর, প্রহরী কুকুর, শিকারি কুকুর, কর্মী কুকুর ইত্যাদি। এসব কুকুরকে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন মতো সংকরায়িত করেছে। কিছু কুকুরের জাত তৈরি করা হয়েছে লম্বা পশমের জন্য, কিছু আবার একেবারে ছোট পশমের, কিছু কুকুর অনেক স্বাস্থ্যবান আবার কিছু অনেক হাড্ডিসার, কিছু কুকুর শক্তিশালী এবং আকারে বড়, আবার কিছু কুকুর দুর্বল এবং আকারে ছোট, কিছু কুকুর তাদের পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে আবার কিছু কুকুর তাদের স্বকীয়তা হারিয়েছে।
এই জাত বিভাজন হয়েছে সম্পূর্ণ মানুষের হাতে। অনেক সময় ছোট আকৃতির এবং বেশি আকর্ষণীয় করতে গিয়ে কুকুরকে দুর্বল বানিয়ে ফেলেছে, যার ফলে এরা মানুষের সাহায্য ছাড়া বাঁচতেই পারে না। আবার কিছু কুকুরকে তার নিজস্ব পরিবেশের বাইরে বেঁচে থাকতে প্রজনন ঘটানো হয়েছে। যেমন- তুষারের দেশের কুকুরকে গরমের দেশে পালনের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। এক্ষেত্রেও বেঁচে থাকতে এবং খাদ্য সংগ্রহে তারা পুরোপুরি মানুষের উপর নির্ভরশীল। হাজার বছর ধরে কুকুরের জাত নিয়ে মানুষের যে অভিক্রিয়া তা পুরোপুরি সফল না এটাও বলা চলে।
কুকুর এবং মানুষের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত সম্পর্ক। কুকুরই একমাত্র প্রাণী যারা মানুষের এত কাছাকাছি এত দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। হয়তো দুই প্রজাতির সামাজিক পরিবেশে একইসাথে অভিযোজন হয়েছে, তাই এমনটা দেখা যায়। প্রাণ জগতে কুকুরই সবচেয়ে ভালভাবে মানুষের ভাষা বুঝতে পারে। মানুষের ভাষার ভিন্নতা কুকুরের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয় না। মানুষ ডাক দিলে কাছে আসা, মানুষের সাথে খেলা- এগুলো কুকুর ভালভাবেই রপ্ত করেছে। এমনকি কুকুর মানুষের না বলা কথাগুলোও বুঝতে পারে। মানুষের রাগ, অভিমান, কষ্ট সবই বোঝার ক্ষমতা রয়েছে কুকুরের। এই বৈশিষ্ট্যগুলো কিছুটা সহজাত আর কিছুটা মানুষের সাথে হাজার বছর ধরে অভিযোজিত হওয়ার ফল।
তবে যেভাবেই হোক, এই হিংস্র নেকড়ের দল কালক্রমে মানুষের সাথে এমন এক সম্পর্কের সৃষ্টি করেছে তার বিশ্লেষণ বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুরের সাথে খেলা করার সময় মানুষের মস্তিষ্ক থেকে বিশেষ রাসায়নিক নির্গত হয়, যা ভালবাসার অনুভূতি দেয়। কুকুরের সংস্পর্শে আসলে মানুষের একাকিত্ব দূর হয়। কুকুরের ডাক শুনলে মানুষের মনে অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি হয়। কুকুরের খাবার খাওয়ার দৃশ্য মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দেয়। এসবের বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে যাচ্ছেন। তবে এত ব্যাখ্যায় কী আসে-যায়! অনেকে একটা কুকুর পেলেই সব দুঃখ-দুশ্চিন্তা ভুলে গিয়ে আদর করতে করতে দিন পার করে দিতে পারে। মানুষের এক অন্যতম বন্ধু বলে কথা!
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে