আধুনিক ক্যালেন্ডারের হিসাবে দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনের রাজ দরবারে এক অদ্ভুত যন্ত্র তৈরি হয়েছিল। দূর থেকে দেখতে সেটি এক বিশাল পাত্রের মতো দেখতে। সেই পাত্রের ঘাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে চীনা ঐতিহ্যের প্রতীক ড্রাগনের মোট ৮টি মাথা। আবার সেই ড্রাগনের মাথার ঠিক নিচেই ক্ষুধার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে আকাশের পানে হা করে তাকিয়ে আছে ৮টি ধাতব ব্যাঙ। ব্যাঙ আর ড্রাগনের নকশা করা এই যন্ত্রটি দেখে অনেকে তা সম্রাটের আমোদ ফূর্তির মাধ্যম বা শৈল্পিক নিদর্শন ভেবে ভুল করে। কিন্তু একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই যন্ত্র কোনো শিল্পকার্য নয় এবং এর সাথে সম্রাটের মনোরঞ্জনেরও কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরেও বেশ দীর্ঘ সময় ধরে সম্রাটের দরবারের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাজপ্রহরীদের কঠোর নজরদারিতে সংরক্ষিত রয়েছে যন্ত্রটি। প্রহরীদের কাজ ছিল যন্ত্রের গায়ে জুড়ে দেয়া ড্রাগনের মুখের দিকে নজর রাখা। তারা দিনের পর দিন সেই ড্রাগনগুলোর মুখের দিকে নজর রেখে চলেছেন। এই নজরদারির যেন কোনো শেষ নেই।
কিন্তু একদিন প্রহরীদের চোখের সামনে যন্ত্রের একটি ড্রাগনের মুখ থেকে একটি ধাতব গোলক বের হয়ে আসলো। সেটি গিয়ে সোজা পতিত হলো এক ক্ষুধার্ত ব্যাঙের মুখে। সাথে সাথে কাসায় চামচ দিয়ে আঘাত করার মতো শব্দে সেই সংরক্ষিত কুঠুরির দেয়াল প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। রাজপ্রহরীরা তৎক্ষণাৎ ছুটে চললেন সম্রাটের দরবারে। যাওয়ার পথে লোকের কানে কানে পৌঁছে দিলেন সেই সংবাদ, “‘হু-ফ্যাঙ দিদোং ই’-র ড্রাগনেরা জেগে উঠেছে।”
হু-ফ্যাঙ দিদোং ই
সুপ্রিয় পাঠকগণ ইতোমধ্যে প্রবন্ধের শিরোনাম পড়ে জেনে গিয়েছেন সেই ড্রাগন আর ব্যাঙের মূর্তি সম্বলিত যন্ত্রটি মূলত ভূমিকম্প নির্ণায়ক যন্ত্র। আর এই যন্ত্র তৈরি হয়েছিল ১৩২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন চীন সাম্রাজ্যে। তখনও মানব সভ্যতা ভূপৃষ্ঠের প্লেট তত্ত্ব আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। তখনকার পৃথিবীতে মানুষ ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাসসহ যেকোনো দুর্যোগকে মহাজাগতিক ইন এবং ইয়াং এর মাঝে অসামঞ্জস্যতার পরিণাম হিসেবে গণ্য করতো। তাদের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল এক রহস্য। বিশাল চীন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য এবং প্রদেশে প্রায়ই ভূমিকম্প সঙ্ঘটিত হতো। ভূমিকম্পের কারণে প্রাণহানী এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম ছিল না। তাই চীন সম্রাট এই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা লাঘব করার লক্ষ্যে দুর্যোগ কবলিত স্থানে অতিসত্বর সাহায্য প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাছাড়া সেই আমলের ধর্মীয় বিশ্বাসে ভূমিকম্পকে স্বর্গীয় ঘটনার নির্দেশক হিসেবে গণ্য করা হতো।
কিন্তু দ্রুত সাহায্য প্রেরণ করা বেশ কঠিন কাজ। তৎকালীন সমাজে যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল না কোনো টেলিফোন, টেলিগ্রাফ কিংবা ডাক ব্যবস্থা। দেখা যেত সম্রাটের নিকট ভূমিকম্পের খবর পৌঁছুতে সপ্তাহখানেক দেরি হয়ে যেত। তাই সম্রাট রাজ্যের বিজ্ঞানীদের ফরমান জারি করলেন, দ্রুত ভূমিকম্পের খবর জানার উপায় বের করতে। সম্রাটের ফরমানে সাড়া দিয়ে বিজ্ঞানীরা আদা জল খেয়ে কাজে নেমে পড়লেন। শত শত বিজ্ঞানীদের মাঝে ঝাং হ্যাং নামক এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম ভূমিকম্প নির্ণায়ক এক অভিনব যন্ত্র নিয়ে সম্রাটের দরবারে হাজির হন। তিনি সেই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন হু-ফ্যাঙ দিদোং ই বা ‘ভূমিকম্প নির্দেশক’।
ঝাং হ্যাং এক প্রতিভার নাম
চীনা সাম্রাজ্যকে ভূমিকম্প নির্ণায়ক যন্ত্র উপহার দেয়া বিজ্ঞানী ঝাং হ্যাং ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে জ্যোতির্বিদ, গাণিতিক, প্রকৌশলি, কবি, ভূতাত্ত্বিক এবং চমৎকার একজন উদ্ভাবক। সাঁঝের আঁধারে যখন চীনের সকল কর্মকাণ্ড থেমে যেত, তখন জেগে উঠতো তার উৎসুক মন। তিনি রাতের পর রাত আকাশ পানে তাকিয়ে প্রায় আড়াই হাজারের মতো তারকারাজির অবস্থান লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এছাড়া তিনি পৃথিবীর প্রথম পানিচালিত অ্যাস্ট্রোলেইব উদ্ভাবন করেন।
প্রথম শতাব্দীতে তিনি হান সাম্রাজ্যের শাসনামলে চীনে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ঠিক কত সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তার কর্মদক্ষতা অচিরেই তাকে চীনা রাজ দরবারের প্রধান বিজ্ঞানীর সম্মানে ভূষিত করেছে। তবে ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে পৃথিবীর প্রথম সিসমোস্কোপ হু-ফ্যাঙ দিদোং ই আবিষ্কারের জন্য।
যন্ত্রের কলাকৌশল
ঝাং হ্যাং-এর যন্ত্রটি বাইরে থেকে দেখতে একটি ৬ ফুট পরিধির ব্রোঞ্জের পাত্রের মতো। তৎকালীন চীনে সাধারণত এধরনের পাত্র ব্যবহার করা হতো মদ এবং পানীয় রাখার জন্য। পাত্রের গায়ে ৮টি ড্রাগন লাগানো ছিল। চীনা সংস্কৃতিতে সর্বমোট ৮টি দিক ব্যবহার করে বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করার প্রচলন ছিল। প্রতিটি ড্রাগনের মুখ সেই ৮টি দিক নির্দেশ করতো। ড্রাগনের মাথার একদম নিচে ৮টি ধাতব ব্যাঙ অবস্থান করতো। এই গেলো পাত্রের বাইরের বর্ণনা। পাত্রের ভেতরে ঝাং হ্যাং একটি সূক্ষ্ম পেন্ডুলাম জুড়ে দিয়েছিলেন। পাত্রের ভেতরের ফাঁকা জায়গা তিনি এক প্রকার তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করেছিলেন যা সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীরা অন্ধকারে আছেন। প্রাচীন চীনা পাণ্ডুলিপির অস্পষ্ট পাঠ থেকে এই যন্ত্রের কলাকৌশল এবং এর ধারণকৃত তরলের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি।
যন্ত্রের সূক্ষ্ম কলকব্জা সম্পর্কে গবেষকগণ এখনও ধোঁয়াশায় আছেন। তবে সহজ কথায় তারা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট কম্পন অনুভূত হওয়া মাত্র পাত্রের ভেতরের পেন্ডুলাম নির্দিষ্ট দিকে আন্দোলিত হতো। এর ফলে সেই দিকে রাখা ধাতব গোলক পেন্ডুলামের আঘাতে ড্রাগনের মুখ দিয়ে নিচে রাখা ব্যাঙের মুখে পতিত হতো। তবে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই যন্ত্র এর আশেপাশে ভূমিকম্প ব্যতীত সৃষ্ট কম্পন দিয়ে প্রভাবিত হতো না। কিন্তু সেই সময়ে ঝাং হ্যাং কীভাবে এই জটিল কাজ সম্পন্ন করেছেন, তা বিজ্ঞানীদের বোধগম্য নয়। ধাতব গোলক ব্যাঙের মুখে পড়ার পর বেশ জোরালো শব্দের মাধ্যমে তা প্রহরীদের সতর্ক করে দিতো। এর মাধ্যমে শুধু ভূমিকম্প নির্দেশিত হতো না, বরং এর দিক এবং অবস্থানও জানা যেত।
সতীর্থদের প্রতিহিংসা এবং অপেক্ষা
সম্রাট যখন বিজ্ঞানীদের নিকট সিসমোস্কোপ নির্মাণের ফরমান জারি করেছিলেন, তখন শত শত বিজ্ঞানী সম্রাটকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কাজে নেমেছিলেন। কিন্তু তারা সকলেই ব্যর্থ হয়েছিলেন শুধু ঝাং হ্যাং ছাড়া। তাই স্বাভাবিকভাবে তিনি সহকর্মীদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। তারা তাকে পথেঘাটে হেয় করা শুরু করে। সবাই বলাবলি করতো, ঝাং হ্যাং খ্যাতির লোভে সম্রাটকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে। ওদিকে সম্রাটের দরবারে সেই যন্ত্র পড়ে আছে মাসখানেক ধরে। শুনতে হাস্যকর লাগলেও সবাই অপেক্ষা করছিল পরবর্তী ভূমিকম্পের জন্য। দীর্ঘদিন ধরে কোনো ফলাফল না হওয়ায় সবাই ধরে নিয়েছিল এই যন্ত্রের কোনো কার্যকারিতা নেই।
ঝাং হ্যাং-এর অপেক্ষার পালা শেষ হয় ১৩৮ সালের এক সুন্দর সকালে। রাজপ্রহরীরা তাকে সম্রাটের নির্দেশে রাজ দরবারে নিয়ে যায়। তিনি সেখানে পৌঁছে আবিষ্কার করেন পশ্চিম দিকে মুখ করা এক ব্যাঙের মুখে ধাতব গোলকটি আটকে আছে। কিন্তু রাজধানী শহরের পশ্চিম দিকে কেউ ভূকম্পন অনুভব করেননি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল যন্ত্রটি প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অপেক্ষায় থাকা হ্যাং জানতেন তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে এসেছে। কয়েকদিন পর পশ্চিমের শহর লং (বর্তমান গানসু) থেকে দূত এসে সম্রাটকে জানালেন ভূমিকম্পের কথা। এমনকি ভূমিকম্প সঙ্ঘটনের সময়কাল গোলক পতনের সাথে মিলে যায়। এই বিস্ময়কর মুহূর্ত শুধু ঝাং হ্যাং-এর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং পুরো বিজ্ঞানের জয়জয়কার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। দেখা গেলো যারা তাকে তিরস্কার করেছিল, সেই সতীর্থরাই ঝাং হ্যাং-কে সেরাদের আসনে বসিয়ে দিলো। প্রতিভার কাছে হেরে গেল বিষাক্ত প্রতিহিংসা।
রেপ্লিকা বানানোর প্রচেষ্টা
সিসমোস্কোপ নির্মাণের এক বছর পর ঝাং হ্যাং মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার শিষ্যরা সফলভাবে হু-ফ্যাঙ দিদোং ই’র রেপ্লিকা বানাতে সক্ষম হন। কিন্তু কালের আবর্তে সবগুলো রেপ্লিকা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। কারণ, কীভাবে সেই যন্ত্র শত শত মাইল দূরের ভূকম্পন নির্ণয় করার সময় পারিপার্শ্বিক কম্পন অগ্রাহ্য করতো তা এখনও জানা যায়নি। আধুনিক যুগে ১৯শ এবং ২০শ শতাব্দীতে পৃথক পৃথক গবেষণাগারে বহুবার এই যন্ত্রের রেপ্লিকা নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন গবেষকরা। ২০০৫ সালে চীনের একাডেমি অফ সায়েন্সের ভূমিকম্প বিশারদগণ এর কার্যকর রেপ্লিকা নির্মাণ করেছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু সেই যন্ত্রে নেই ঝাং হ্যাং-এর অসাধারণ সূক্ষ্মতার ছোঁয়া।
চীনা রেপ্লিকায় ৮টি আলাদা গোলকের বদলে মাত্র একটি গোলক ব্যবহৃত হয়েছে। গোলক স্পর্শ করে ঝুলে আছে একটি পেন্ডুলাম। ভূকম্পনের প্রভাবে পেন্ডুলাম নির্দিষ্ট দিকে আন্দোলিত হয়ে গোলকটিকে ড্রাগনের মুখে ঠেলে দেয়। বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্র নিয়ে আরো কাজ করে যাচ্ছেন। তারা আশাবাদী অদূর ভবিষ্যতে তারা চীনা পাণ্ডুলিপিতে বর্ণিত যন্ত্রের সূক্ষ্মতার কাছাকাছি রেপ্লিকা নির্মাণ করতে পারবেন।
ঝাং হ্যাং-এর পৃথিবী এখন অনেকটাই বদলে গেছে। যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে বিপ্লব। ভূমিকম্প নিয়ে মানুষ প্লেট তত্ত্ব আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসমোগ্রাফের মাধ্যমে ভূমিকম্প নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। প্রয়োজনে দ্রুততার সাথে আক্রান্ত স্থানে ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে বছরজুড়ে। কিন্তু এই ১৮০০ বছরের ব্যবধানেও ঝাং হ্যাং-এর নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। এমনকি আধুনিক যুগের যন্ত্রগুলোতেও দেখা যায় সেই প্রাচীন হু-ফ্যাঙ দিদোং ই’র ছোঁয়া। বর্তমান সিসমোস্কোপে ব্যবহৃত সেন্সরটি একটি ঝুলন্ত দেহ যা সেই পেন্ডুলামের কাজ করে যাচ্ছে। পেন্ডুলামের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে চুম্বকীয় শক্তি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি ধীরে ধীরে এই যন্ত্রকে আরো উন্নত করবে, কিন্তু এসব কিছুই শুরু হয়েছিল হান সাম্রাজ্যের চীনে একজন প্রতিভাবানের হাত ধরে। সেই প্রতিভাবান ঝাং হ্যাং-এর প্রতি মানব সভ্যতা চির কৃতজ্ঞ।
রোর বাংলা এর বই সমূহ কিনতে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কে:
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে