‘উল্কাপাতের কারণ এবং পৃথিবীর অন্যতম গণবিলুপ্তির কথা’ শিরোনামে গত ১১ জুন ২০১৭ তারিখ Roar বাংলায় একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল- বিজ্ঞানীদের কাছে এমন তথ্য-প্রমাণ আছে যে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে কোনো এক বা একাধিক কারণে ডায়নোসরের রাজত্ব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ঐ লেখার প্রতিক্রিয়ায় একজন পাঠক বলেছিলেন–
“৬৫ মিলিয়ন বছর আগেরকার তথ্যপ্রমাণ নাকি বিজ্ঞানীদের কাছে আছে! যত্তসব পাগলের প্রলাপ!”
আগে প্রকাশিত ঐ লেখায় যদি মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের ব্যাপারগুলো নির্ণয় করার পদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত বলা হতো, তাহলে হয়তো পাঠককে এমন মন্তব্য করতে হতো না। কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের কোনো ঘটনার বয়স নির্ণয় করার পদ্ধতি একটু বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে, যা সেখানে আলোচনা করলে লেখার দৈর্ঘ্য অনেক বড় হয়ে যেত এবং আলোচনা মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে যেতো। তাই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্য এখানে আলাদা একটি লেখার অবতারণা করা হলো।
আসলেই তো, হাজার হাজার বছর আগে তো আমরা ছিলাম না, তাহলে কিভাবে জানলাম ঐ সময়কার প্রাণীরা দেখতে কেমন ছিল, আর তারা কত সময়কাল আগে পৃথিবীতে বাস করতো? এদের বেশিরভাগই জানা সম্ভব হয়েছে ফসিল থেকে। জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলোতে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর পূর্বপুরুষের যত ধরনের ছবি দেখা যায় তার সবগুলোর আদলই তৈরি করা হয়েছে ফসিলের উপর ভিত্তি করে আর আধুনিক প্রাণীর সাথে তুলনা করে।
ফসিল মূলত পাথর, কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহকে প্রতিস্থাপিত করে ঐ প্রাণীর বা উদ্ভিদের আকৃতিতে স্থায়ী হয়ে যাওয়া পাথর। প্রাণীজগতের বিশাল একটা অংশ কোনো প্রকার ফসিলে রূপান্তরিত হবার আশা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে। কোনো প্রাণীর মৃতদেহ ফসিলে রূপান্তরিত হবার কৌশল একটু অন্যরকম। কেউ যদি নিজেকে ফসিলের মাঝে অমর করে রাখতে চায়, তাহলে সঠিক প্রকারের কাদা বা পলি মাটিতে নিজের কবর রচনা করতে হবে। ঐ কাদা অনেক কাল অতিক্রম করে একসময় পাললিক শিলাতে পরিণত হবে।
কাদা হয়ে যায় পাথর, এর মানে আবার কী? পাথর (শিলা) তিন প্রকারের হয়ে থাকে। আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ও রূপান্তরিত শিলা। আমরা রূপান্তরিত শিলাকে উপেক্ষা করে যেতে পারি। রূপান্তরিত শিলা মূলত আগ্নেয় বা পাললিক শিলারই একটি রূপ। আগ্নেয় বা পাললিক শিলা প্রচণ্ড চাপ বা তাপ কিংবা একত্রে উভয়ের প্রভাবের ফলে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয়। আগ্নেয় শিলা প্রথম দিকে গলিত ও উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে, পরে ঠাণ্ডা হয়ে কঠিন পাথরে পরিণত হয়। যেমন করে আগ্নেয়গিরি থেকে উদগিরিত তরল লাভা একসময় কঠিনে রূপান্তরিত হয়, তেমন।
যেকোনো ধরনের পাথরই পানির প্রবাহ কিংবা বাতাসের প্রবাহ দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এর ফলে পাথর থেকে তৈরি হয় ক্ষুদ্র পাথর, নুড়ি, বালি ও ধূলি। বায়ু বা পানির স্রোত বালি ও ধূলির কণাকে বয়ে নিয়ে চলে। চলতে চলতে একসময় স্রোত শেষ হয়ে গেলে বালি ও ধূলির কণা পুকুর, নদী, সাগর বা সমুদ্রের তলদেশে কাদা বা পলি হিসেবে জমা হয়। ধীরে ধীরে অনেক বছর পরে এ পলিগুলো পাললিক শিলার স্তর তৈরি করার মতো যথেষ্ট দৃঢ়তা অর্জন করে। যদিও প্রথম দিকে পাললিক শিলার স্তরগুলো আনুভূমিক ও সমতলভাবেই তৈরি হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নানা কারণে হেলানো, উল্টানো, মোচড়ানো, দুমড়ানোতে পরিণত হয়। এর পেছনে কাজ করে ভূমিকম্প, প্লেট টেকটোনিকস সহ আরো কিছু কারণ।
এখন ধরা যাক, কোনো একটি মৃত প্রাণী কোনো একভাবে কাদার মাঝে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। এই কাদা যদি পরবর্তীতে দৃঢ় হওয়া শুরু করে এবং একসময় পাললিক শিলায় পরিণত হয়, তাহলে প্রাণীটি হয়তো পচে গলে মিশে যাবে, কিন্তু তার দেহের আকৃতির একটি ছাপ রেখে যাবে। এ ধরনের প্রাণীর দেহের রেখে যাওয়া ছাপ প্রতিনিয়তই পাওয়া যায়। এগুলো একধরনের ফসিল। আজকালকার ডিজিটাল ক্যামেরার আগে ফিল্ম দিয়ে ছবি তোলা যেত এমন এক প্রকার ক্যামেরা প্রচলিত ছিল। তোলা ছবিগুলো ঐ ফিল্মে স্থায়ী হয়ে যেত, চাইলেও ডিলিট করার উপায় ছিল না। ফিল্ম থেকে প্রিন্ট করিয়ে আনলে মূল ছবি পাওয়া যেত। প্রিন্ট না করেও ঐ ফিল্মকে আলোর বিপরীতে রেখে তাকালে নিম্নমানের অস্পষ্ট একটা প্রতিরূপ দেখা যেতো। এ ধরনের ছবিকে বলে মূল ছবির ‘নেগেটিভ’। এ ফসিলগুলোর বেলাতেও প্রাণীটি যে ছাপ রেখে যায় তা অনেকটা মূল প্রাণীর নেগেটিভের মতো।
মৃতদেহটি আবার কাদার মাঝে ছাঁচ হিসেবেও কাজ করতে পারে। দেহের বাইরে চারদিকে একধরনের বহিঃস্থ আবরণের মতো তৈরি করে মূল দেহের মতোই একধরনের প্রতিরূপ তৈরি করে। এগুলো হচ্ছে দ্বিতীয় প্রকার ফসিল। এ দুই ধরনের ফসিল ছাড়াও আরেক প্রকার ফসিল আছে। এ ধরনের ফসিলের বেলায় মৃতদেহ যখন কাদার মাঝে নিমজ্জিত হয়, তখন প্রাণীর দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু একটি একটি করে খনিজ পদার্থের অণু-পরমাণু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। খনিজ পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকে। প্রতিস্থাপিত হওয়া অণু-পরমাণুগুলো পরবর্তীতে পাথরে রূপান্তরিত হয়।
প্রতিস্থাপিত হওয়া পরমাণু দিয়ে গঠিত ফসিলগুলোই হচ্ছে ফসিল জগতের মাঝে সবচেয়ে সেরা ফসিল। কারণ এ ধরনের ফসিলগুলোতেই প্রাণীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকে, যা অন্য ফসিলগুলোতে থাকে না। বলা যায় এটা আমাদের জন্য একটা দারুণ সৌভাগ্য, কারণ প্রাণীর বিবরণের জন্য চাইলেও আমরা হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছর আগের দিনে গিয়ে অনুসন্ধান করতে পারবো না। কিন্তু বিজ্ঞানের কল্যাণে ফসিল বিশ্লেষণ করে আজকের দিনে বসেই অনেক অনেক আগের দিনের প্রাণীদের সম্পর্কে জানতে পারছি আমরা।
প্রশ্ন হতে পারে- আগেকার দিনের মরে ভূত হয়ে যাওয়া এই প্রাণী সম্বন্ধে জেনে কী হবে? ভবিষ্যতে কী করবো, কী করা উচিৎ তার ব্যাপারে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই। নিজেদের ভালো ও নিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের জন্যই অতীতের জিনিস সম্বন্ধে ভালো করে জানা দরকার।
ফসিলের বয়স নির্ণয় করা যায়, ফসিল বিশ্লেষণ করে বলে দেয়া যায় প্রাণীটি কত বছর আগের। এই কাজটি করা হয় ফসিল নামক পাথরে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে। নির্ভুলভাবে বললে শব্দটা হবে ‘তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ’ থেকে।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কী জিনিস? অতি সংক্ষেপে বললে, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হচ্ছে সে সকল পরমাণু যারা নিজেরা ক্ষয়ে গিয়ে অন্য কোনো পরমাণু হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে ইউরেনিয়ামের কথা বলতে পারি। ইউরেনিয়াম ক্ষয়ে গিয়ে এক সময় লেড নামক পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এখন যদি আমরা কোনোভাবে জানি এক পরমাণু থেকে আরেক পরমাণুতে রূপান্তরিত হতে কত সময় লাগে, তাহলে এই পরমাণুকে তেজস্ক্রিয় ঘড়ি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। তেজস্ক্রিয় ঘড়ি হিসেবে বিবেচনা করলে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর বয়স নির্ণয় করা যাবে।
তেজস্ক্রিয় ঘড়িকে জল ঘড়ি, মোম ঘড়ি কিংবা বালি ঘড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এখন সবাই ডিজিটাল ঘড়ি ব্যবহার করে, আগে মানুষ পেন্ডুলাম ঘড়ি ব্যবহার করতো। পেন্ডুলাম ঘড়ি উদ্ভাবিত হবার আগে মানুষ সময় মাপার জন্য জল ঘড়ি, মোম ঘড়ি আর বালি ঘড়িই ব্যবহার করতো। একটি পাত্রে পানি রেখে নিচের দিকে ছোট একটি ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে ঐ পানি পড়তে দিলে একটি নির্দিষ্ট হারে পানি পড়তে থাকবে। যদি একদম সূর্য ওঠার সময়ে পানি দিয়ে ভরা পাত্রটি থেকে পানি পড়া শুরু করে, তাহলে কতটুকু পানি বাকি আছে তা দেখে বলে দেয়া সম্ভব বেলা কতদূর গড়িয়েছে। মোম ঘড়ির কাজও অনেকটা এরকমই। মোম একটি নির্দিষ্ট হারে জ্বলে। তাই মোম কতটুকু বাকি আছে তা দেখে বলে দেয়া সম্ভব মোমটির কতটুকু জ্বলে শেষ হয়েছে। কতটুকু জ্বলেছে তা থেকে খুব সহজ হিসেবেই বের করা যায় কত সময় ধরে মোমটি জ্বলছে। বালিঘড়ির হিসাবও তাই।
এখন তেজস্ক্রিয় ঘড়ির কথা বিবেচনা করা যাক। ইউরেনিয়াম-২৩৮ পরমাণুর অর্ধায়ু সাড়ে চার বিলিয়ন বছর। অর্ধায়ু মানে হচ্ছে ইউরেনিয়াম পরমাণু ক্ষয়ে গিয়ে লেড পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে হয়ে অর্ধেক পরিমাণে নেমে আসতে সাড়ে চার বিলিয়ন বছর লাগে। যদি কারো কাছে এক কেজি ইউরেনিয়াম-২৩৮ থাকে, তাহলে সেটি ক্ষয়ে কমে গিয়ে আধা কেজিতে পরিণত হতে সাড়ে চার বিলিয়ন বছর লাগবে। যেহেতু ইউরেনিয়ামগুলো লেড পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তাই ঐ স্থানে কী পরিমাণ লেড আছে তা হিসাব করে বলে দেয়া সম্ভব কত সময় ধরে ইউরেনিয়াম ক্ষয়ে চলছে। হিসাব করে বের করা সম্ভব কত সময় আগে কোনো লেডই ছিল না, কত সময় আগে যা ছিল তার সম্পূর্ণটাই ইউরেনিয়াম। যদি এটাকে ঘড়ি বিবেচনা করি, তাহলে ঘড়ির ভাষায় কত সময় আগে ঘড়ি শূন্যের কাঁটায় ছিল তা হিসেব করা সম্ভব।
ফসিলের ক্ষেত্রে কোন সময়ে ঘড়ি শূন্যের কাঁটায় ছিল? ফসিল বিশ্লেষণ করে বয়স বের করা যায় শুধুমাত্র আগ্নেয় শিলার ক্ষেত্রে। আগ্নেয় শিলা যখন গলিত অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় পরিণত হয়ে দৃঢ়তা লাভ করে, তখন সেটা আগ্নেয় শিলার জন্য শূন্যের কাঁটা। এই প্রক্রিয়া পাললিক শিলার বেলায় খাটে না। এই উপায়ে পাললিক শিলার নির্দিষ্ট কোনো শূন্যের কাঁটা বা সূচনা মুহূর্ত নেই। তাই আমাদেরকে পাললিক শিলা যে স্তরে থাকে, তার আশেপাশের স্তরে আগ্নেয় শিলা খুঁজে বের করতে হবে। এই নিকটবর্তী আগ্নেয় শিলাকেই আমরা ইতিহাসের সময় মাপার তেজস্ক্রিয় ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করবো।
ছোট একটি উদাহরণ দেই। যদি কোনো পাললিক শিলার অভ্যন্তরে কোনো ফসিল পাওয়া যায় এবং এই পাললিক শিলার নিচে থাকে ১৩০ মিলিয়ন বছর আগের আগ্নেয় শিলা এবং উপরে থাকে ১২০ মিলিয়ন বছর আগের আগ্নেয় শিলা, তাহলে ধরে নিতে হবে প্রাপ্ত ফসিলের বয়স ১২০ থেকে ১৩০ মিলিয়ন বছরের মাঝে কোনো একটা সময়। কারণ সময়ের সাথে সাথে স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়ে শিলা গঠিত হয়। তাই ১২০ ও ১৩০ মিলিয়ন বছর আগের আগ্নেয় শিলার মাঝে পাললিক শিলা থাকলে পাললিক শিলার বয়স এই সীমার মাঝের কোনো একটা সময়েই হবে। জীববিজ্ঞানের বইগুলোতে যত প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর বয়স উল্লেখ করা হয়, তার সবগুলোর বয়সই এ পদ্ধতিতে নির্ণয় করা। তাই কোনো বয়সকেই কাটায় কাটায় সঠিক বলে ধরে নেয়া উচিৎ নয়। উল্লেখ করা সব বয়সই মূল বয়সের প্রায় কাছাকাছি (Approximate) কোনো একটা বয়স।
ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ইউরেনিয়াম-২৩৮ একমাত্র তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নয়। আরো অনেক পরমাণুর আইসোটোপই আছে যাদের ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আর তারা অনেক বৈচিত্র্যময়ও। তাদের অর্ধায়ুর পাল্লা অনেক অল্প থেকে শুরু করে অধিক মাত্রায় বেশি পর্যন্ত হয়ে থাকে। যেমন কার্বন-১৪ আইসোটোপের কথা বিবেচনা করা যাক। কার্বন পরমাণুর স্বাভাবিক ভর হচ্ছে ১২। কিন্তু তেজস্ক্রিয় কার্বনের ভর ১৪ হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কার্বন থেকে এই কার্বনের পার্থক্য হচ্ছে এতে দুটি নিউট্রন বেশি থাকে।
কার্বন-১৪ আইসোটোপের অর্ধায়ু মাত্র ৫,৭৩০ বছর। এটা প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য খুব দরকারি একটি অর্ধায়ু। কারণ মানুষের ইতিহাস খুব বেশি আগের নয়। তাই মানুষের উৎপত্তি ও ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষণা করতে অল্প অর্ধায়ু বিশিষ্ট আইসোটোপই এই ক্ষেত্রে বেশি উপযোগী হবে।
আরো একটি চমৎকার বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পরমাণুর সময় ঘড়ি একই রকম সময় প্রদান করে। মানে একাধিক আইসোটোপকে ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করলে তারা একই সময় প্রদান করে। এতে করে সত্যিকার বয়স সম্পর্কে অধিক নিশ্চিত হওয়া যায়। যেমন কোনো একটা ফসিলের বয়স নির্ণয় করার জন্য যদি কার্বন ও ইউরেনিয়াম উভয়কেই বিবেচনা করা হয়, তাহলে উভয়ে যে রায় দিবে তা সাধারণত একই হয়। বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্য এটা খুবই ভালো একটা দিক। বিজ্ঞানীদের জন্যও এটা খুব স্বস্তির ব্যাপার।
আমাদের জন্য আরো একটা দারুণ সৌভাগ্য যে, ঘড়ি হিসেবে কার্বন-১৪ অন্যদের থেকে একটু ভিন্নভাবে কাজ করে। এর বেলায় আগ্নেয় শিলার প্রয়োজন হয় না। কোনো একটা মৃতদেহে কী পরিমাণ কার্বন-১৪ অবশিষ্ট আছে তা থেকেই বলে দেয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে কাঠ বা মৃত গাছের কথা বলা যায়। কার্বন-১৪ আইসোটোপের অর্ধায়ু ৫,৭৩০ বছর, যা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য আইসোটোপের চেয়ে অনেক অল্প একটি সময়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম হলেও মানুষের আয়ুর কথা বিবেচনা করলে এটি অনেক লম্বা এক সময়।
এ বেলায় মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে আমরা জানলাম কার্বন-১৪ এর অর্ধায়ুর পরিমাণ? এত বছর ধরে অপেক্ষা করে অর্ধায়ু মাপা তো অনেকটা অসম্ভব। তার উপর ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর অর্ধায়ু সাড়ে চার বিলিয়ন বছর! এটা কীভাবে সম্ভব? উত্তরটা খুব সোজা। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে কোনো পরমাণুর অর্ধায়ুর জন্য আমাদেরকে ঐ পরিমাণ সময় অপেক্ষা করে পরমাণুর ক্ষয় হওয়া দেখতে হয় না। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজে অল্প সময়ের ভেতরেই আইসোটোপের ক্ষয় হবার হার মাপতে পারি। ক্ষয় হবার হার মাপতে পারলে এটা থেকে মাপা যায় অর্ধায়ু, চার ভাগের এক ভাগ আয়ু, দশ ভাগের এক ভাগ আয়ু, একশো ভাগের এক ভাগ আয়ু ইত্যাদি।
আশা করি এ লেখা পড়ে আর কেউ বলবে না যে, “৬৫ মিলিয়ন বছর আগের কথা মানুষ কীভাবে জানলো? ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের গাঁজাখুরি গল্প কেন বিশ্বাস করবো?” আসলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ একটা মূর্তিমান বিপ্লব। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের আবিষ্কার শুধু পদার্থবিজ্ঞানেই নয়, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান সহ বিজ্ঞানের অন্যান্য সকল শাখাতেই বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে এমন অনেক কিছু করা সম্ভব হয়েছে যা আগে কারো পক্ষে কল্পনা করাও ছিল আলাদিনের চেরাগের মতো অসাধ্য। কে ভাবতে পেরেছিল আজকের দিনে বসেই আমরা বলে দিতে পারবো ৬৫ মিলিয়ন বা তার চেয়েও আগের অলিপিবদ্ধ কোনো অজানা তথ্যের কথা? বিজ্ঞান এজন্যই রোমাঞ্চকর, বিজ্ঞান এজন্যই অসাধারণ।