পৃথিবী জুড়ে বৈজ্ঞানিকেরা এবং আমরা জনসাধারণও দৈর্ঘ্যের জন্য একটি এককই ব্যবহার করি- ‘মিটার’। কিন্তু কখনো কি নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখেছেন, কেন এতটুকু দৈর্ঘ্যকেই আমরা এক মিটার বলি, এর বেশিও না কমও না? সে প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো আমরা এ প্রবন্ধে।
খেয়াল করে দেখবেন, প্রত্যেকটি বৈজ্ঞানিক সূত্রের পেছনে অনেক যুক্তিতর্ক ও পরীক্ষণ রয়েছে, একে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি। কিন্তু এক মিটারের দৈর্ঘ্যকে কিন্তু স্বেচ্ছাচারপ্রসূতই মনে হয়, তা-ই না? হ্যাঁ, বিজ্ঞানের শুরু থেকেই এককগুলো পারতপক্ষে স্বেচ্ছাচারপ্রসূতই বটে।
ইতিহাসের শুরু থেকে মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত একেক দেশে একেক একক ব্যবহৃত হতো। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকারকে ধরা হতো একক হিসেবে- কিউবিট, ফুট, গজ ইত্যাদি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস সিদ্ধান্ত নিলো, সারা পৃথিবীর এককগুলোকে একটি মানদণ্ডের নিচে নিয়ে আসা হবে। তারা বিভিন্ন একক নিয়ে ভাবা শুরু করলো, পর্যায়ক্রমে আসলো দৈর্ঘ্যের পালা।
বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের পূর্বে দেয়া বিভিন্ন বুদ্ধি তখন আসতে শুরু করলো পর্যালোচনায়। জন উইলকিন্স বা ক্রিস্টোফার রেনের মতো কিছু বিজ্ঞানী বলে গিয়েছিলেন, পেন্ডুলাম থেকে দৈর্ঘ্যের একক নিয়ে আসবার কথা। এক সেকেন্ডে যে পেন্ডুলামগুলো এক মাথা থেকে আরেক মাথায় আসতে পারে, অর্থাৎ সেকেন্ড পেন্ডুলাম, এগুলোর দৈর্ঘ্যকেই আমরা দৈর্ঘ্যের একক হিসেবে নিই। তাহলে যখন তখন পেন্ডুলাম ব্যবহার করে আমরা দৈর্ঘ্য মেপে ফেলতে পারবো। শুনতে খারাপ শোনায়নি বুদ্ধিটা, কিন্তু ততদিনে নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করে ফেলেছেন, তাই বুদ্ধির সীমাবদ্ধতাটা বের হতে সময় লাগলো না। পেন্ডুলামের দোলনকাল কিন্তু নির্ভর করে অভিকর্ষ বলের উপর। পৃথিবীর যেহেতু একেক জায়গায় অভিকর্ষ বল একেক রকম, সেহেতু একটি পেন্ডুলামের দোলনকালও একেক জায়গায় একেক রকম। তবে কি দৈর্ঘ্যের এককও একেক জায়গায় একেক রকম হবে? তা তো আর হতে পারে না। তাই এই বুদ্ধিটি বরবাদ হয়ে গেল।
বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, যেহেতু দৈর্ঘ্য মাপবো পৃথিবীতে বসে, পৃথিবীর পরিধি থেকেই আমরা বের করে নেবো দৈর্ঘ্যের একক। তারা বললেন, নিরক্ষরেখা থেকে উত্তরমেরুর দূরত্বের এক কোটি ভাগের এক ভাগ হবে এক একক। দূরত্বটা মাপার সময় যেতে হবে প্যারিসের উপর দিয়ে।
একটি নিরীক্ষক দল ফ্রান্সের ডানকার্ক থেকে স্পেনের বার্সেলোনার দূরত্ব মাপলেন। তারপর জ্যামিতি ব্যবহার করে বের করলেন পুরো দূরত্বটি।
অবশ্য পৃথিবী ঘোরার সময় যে বিভিন্ন অবস্থানে বিভিন্নভাবে সংকুচিত হয়, তা তারা হিসাবে আনেননি। এই ভুলকে উপেক্ষা করেই সেই দূরত্বের এক কোটি ভাগ বের করে তাকে তারা ধরে নিলেন দৈর্ঘ্যের একক হিসেবে। আর ফরাসি ভাষায় ‘মিটার’ শব্দটির অর্থ মাপা, এটাই দেওয়া হলো দৈর্ঘ্যের এককের নাম।
১৭৯৯ সালে ফ্রান্স সেই এক মিটার দৈর্ঘ্যের একটি প্লাটিনাম দণ্ড তৈরি করে নাম দিলো ‘মিটার অফ দ্য আর্কাইভস’।
এখানে প্লাটিনাম ব্যবহৃত হলো, কারণ প্লাটিনাম অণু খুব সহজে ক্ষয় হয় না, বিক্রিয়াও করে না। আর তারা সেটাই চেয়েছিলো, তাদের তৈরি দণ্ডটি যেন ছোট না হয়ে যায় বা নিজের সংযুক্তি বদলে না ফেলে। তবে, লোহার মতো মরিচা ধরে সবকিছু বদলে না গেলেও, প্লাটিনামও তাপমাত্রার সাথে সাথে সংকুচিত এবং সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু এসব সমস্যাকে বিজ্ঞানীরা উপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ এর থেকে ভালো কোনো বিকল্প তাদের হাতে ছিল না।
পরবর্তী শতাব্দীতে এই মিটারের হিসেবটা বেশ জনপ্রিয়তাই পেয়ে গেল। ১৮৭৫ সালে প্যারিসে আয়োজিত হলো আন্তর্জাতিক মেট্রিক সম্মেলন, যেখানে উত্থাপন করা হয় বিখ্যাত ‘Treary of the Metre’ বা মিটারের চুক্তি। ১৭টি দেশ সই করলো সেই চুক্তিতে। এই চুক্তির মাধ্যমেই পরিমাপের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সূচনা হয়, যাকে আমরা এখন ‘International Bureau of Weights and Measures (BIPM)’ নামে চিনি। ১৭টি দেশ দিয়ে শুরু হলেও এখন সংগঠনটির মূল সদস্য হিসেবে আছে ৫৯টি দেশ আর ৪২টি দেশ আছে সহকারী সদস্য হিসেবে। বাংলাদেশ সংগঠনটির সহকারী সদস্য।
এই চুক্তির পর সদস্য সবগুলো দেশই প্যারিসের মতো নিজস্ব একটি মিটারের দণ্ড দাবি করে। ১৮৮৯ সালে প্রত্যেকটি দেশকেই ওই দণ্ডের প্রোটোটাইপ দেওয়া হয়। তবে এই প্রোটোটাইপগুলো তৈরি হয়েছিল প্লাটিনাম আর ইরিডিয়ামের সংকর দিয়ে, স্থিতিশীলতা আর দৃঢ়তা দুটোই বেশি ছিল এদের। সবগুলোর দৈর্ঘ্য মাপা হয়েছিল জিরো ডিগ্রিতে, যাতে তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে দণ্ডের পরিমাপেরও সামঞ্জস্য রাখা যায়।
এসব কারণে এবার এই দণ্ডের হিসাব বেশ নির্ভরযোগ্য হলো সবার কাছে। সবাই ভাবলো, দৈনন্দিন জীবনের জন্য মিটারের হিসাব এতটুকু নিখুঁত থাকলেই হবে।
কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের জন্য যথেষ্ট হলেও, বিজ্ঞানীদের জন্য এটা যথেষ্ট ছিল না। তারা এই মিটারকে আরো ধ্রুব, আরো সার্বজনীন বানাতে চাচ্ছিলেন। কারণ মিটারকে এখনো তারা মহাজাগতিক কোনো ধ্রুবক দিয়ে প্রকাশ করতে পারেননি।
উদাহরণস্বরূপ, এ পৃথিবীর বাইরের কাউকে, অর্থাৎ কোনো এলিয়েনকে, মিটারের সংজ্ঞা দিতে হলে তাকে পৃথিবীর মেরু চেনাতে হবে, নিরক্ষরেখা চেনাতে হবে। বিজ্ঞানীদের কাছে তাই এই সংকীর্ণ সংজ্ঞাটি আস্তে আস্তে লজ্জাজনক মনে হতে শুরু করলো।
তারপর পরামর্শ আসলো আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দ্বারা মিটারকে সংজ্ঞায়িত করতে। কারণ আলো সমগ্র মহাবিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বিভিন্ন উৎস থেকে বের হওয়া আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিভিন্নরকম। বিজ্ঞানীরা একটি নির্দিষ্ট আলোকে বেছে নিতে চাইলেন।
আমরা জানি, যেকোনো অণুতে ইলেক্ট্রন স্থান পরিবর্তন করলে শক্তি গ্রহণ করে এবং আগের অবস্থানে ফিরে গেলে সেই শক্তিকে বিকিরণ করে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদার্থের অণুর এই বিকিরিত আলোকে পর্যবেক্ষণ করে, তখন বোঝার চেষ্টা করলেন কোন অণু থেকে বিকিরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে স্থিতিশীল, সুবিধাজনক। তারা বেছে নিলেন ক্রিপ্টন-৮৬ একটি নির্দিষ্ট স্থানান্তরের কমলাটে আলোকে।
১৯৬০ সালে ওজন ও পরিমাপের ১১তম সাধারণ সম্মেলনে মিটারকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বলা হয়, ক্রিপ্টন-৮৬ এর দ্বারা শূন্যে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ১৬,৫৯,৭৬৩.৭৩ গুণ হচ্ছে এক মিটার। উল্লেখ্য, মিটারের দৈর্ঘ্য কিন্তু এখানে পরিবর্তিত হয়নি, শুধু আগের দৈর্ঘ্যটারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে নতুনভাবে।
তবে মানুষ সেখানেই থামেনি। যতই সময় গিয়েছে, মানুষ আলোকে বুঝতে পেরেছে আরো ভালোভাবে। আর সেই বোধগম্যতা থেকেই মানুষ বুঝেছে যে, মিটারকে সংজ্ঞায়িত করার আরো সার্বজনীন, আরো মৌলিক একটি উপায় আছে। আমরা জানি, আলোর গতি ধ্রুব, কোনো প্রসঙ্গ কাঠামোর ধার ধারে না এ গতি। তাই আধুনিক বিজ্ঞান বলে, এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক ধ্রুবক হচ্ছে আলোর গতি।
তাই ১৯৮৩ সালে মিটারকে আবার সংজ্ঞায়িত করা হয়। এখন এক মিটারের সংজ্ঞা হচ্ছে, এক সেকেন্ডের ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ ভাগের এক ভাগ সময়ে আলো যতটুকু দৈর্ঘ্য ভ্রমণ করতে পারে। এর চেয়ে মৌলিক হওয়া আর আধুনিক বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
অতএব দেখা গেল, নিছক দৈর্ঘ্যের একটি একককে সংজ্ঞায়িত করতেই বিজ্ঞানীরা লাগিয়েছেন প্রায় ২০০ বছর! সুতরাং পরবর্তীতে আমরা যখন কোনোকিছু মিটার বা সেন্টিমিটারে মাপবো, এই এতটুকুকে ঠিকঠাক সংজ্ঞায়িত করতেই যে বিজ্ঞানীরা ২০০ বছর লাগিয়ে দিয়েছেন, এটা ভেবে আমরা একটু মুচকি হাসতেই পারি!
ফিচার ইমেজ: wallpaperhdzone.com