মানুষ বেশ কৌতূহলী প্রাণী। তার কৌতূহলের কোনো সীমা নেই। কৌতূহলের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মানুষ পাড়ি দিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদী, পেরিয়েছে দিগন্তের সীমানা। পৃথিবী জয় করার পর মানুষ পাড়ি দিয়েছে মহাশূন্যে। ১৯৬৯ সালে চাঁদে প্রথম পা রাখার মাধ্যমে মানুষ প্রবেশ করে মহাকাশ যাত্রার এক অনন্য অধ্যায়ে। এই সফলতার হাত ধরেই মানুষ মহাকাশকে আরো কাছ থেকে জানতে আরম্ভ করে। মানুষের মনের নানা প্রশ্নের উত্তর খুজে পায় এই যাত্রার মাধ্যমে।
এটি তো ছিল মাত্র সূচনা। মানুষ এবার তাকিয়েছে মঙ্গল গ্রহের দিকে। তবে মানুষের মনে আজও অনেক প্রশ্ন উঁকি দেয়। কী আছে ঐ মঙ্গলে? এটি কি হবে মানুষের বসবাসের যোগ্য? কীভাবেই বা বিজ্ঞানীরা পদার্পণ করবেন সেখানে? এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুজতেই মানুষ এবার পাড়ি দিয়েছে মঙ্গলের পথে। মঙ্গলের উদ্দেশ্যে মানুষের প্রথম যাত্রা চন্দ্র জয়ের পর থেকেই। বহুবার ব্যর্থ হওয়ার পর, ১৯৭১ সালে বিজ্ঞানীরা সফল হন।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, ম্যারিনার ৯ নামক একটি মহাকাশযান পৃথিবী থেকে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। এই মহাকাশযান সে বছরের নভেম্বরের ১৩ তারিখ সফলভাবে মঙ্গলের অক্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এটিই মঙ্গলের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে খ্যাত। এর ফলে মানুষ মঙ্গলকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। এরপর থেকে মানুষ বার বার চেষ্টা করে চলেছে মঙ্গলের পৃষ্ঠে পদার্পণের উপায় খুজে বের করতে।
নাসার নতুন অভিযান
ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার সদর দফতর ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত। সম্প্রতি তাদের এক নতুন অভিযান সম্পর্কে জানা গেছে। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই, তারা আবারও পাড়ি দিতে চলেছে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে। এই মহাকাশযানটি সে গ্রহে পৌঁছাবে ২০২১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি। তবে এইবারে যাত্রা হবে একটু ভিন্ন, পাড়ি দিতে হবে ভিন্ন উপায়ে, অতিক্রম করতে হবে নতুন কিছু বাঁধা বিপত্তি। এই যাত্রার নানা জটিলতার কারণে একে সেভেন মিনিট টেরর হিসেবে আখ্যায়িত করছে সংস্থাটি।
আমাদের সৌরজগতের ৪র্থ গ্রহ হলো মঙ্গল। এই গ্রহ নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই মহাকাশ বিজয়ের সূচনালগ্ন থেকেই। কিন্তু চন্দ্র আর মঙ্গল তো এক নয়! মঙ্গলের পথ যেমন দূর, ঠিক তেমনই প্রতিবন্ধক চ্যালেঞ্জে ভরা। তবে প্রতিবন্ধকতা থাকলে, তার সমাধান জটিল হলেও, বিজ্ঞানীদের কাছে তা অসম্ভব নয়। তো এত চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও কীসের নেশায় বিজ্ঞানীরা ছুটছেন এই গ্রহ জয়ের জন্য? কী এমন আছে এতে?
আমাদের পৃথিবীর থেকে কিছুটা ছোট সৌরজগতে রেড প্ল্যানেট নামে খ্যাত এই গ্রহ। এর লাল রঙের রহস্য হলো এতে বিভিন্ন ধাতুর উপস্থিতি যা বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে জারিত হয়ে থাকে। যার ফলে রাসায়নিক কারণে এর পৃষ্ঠ এমন লাল দেখায়। দেখতে আগুনের মতো তীব্র লাল হলেও, এর তাপমাত্রা পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম। এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস ৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকালে তা নেমে আসে মাইনাস ১০০ ডিগ্রিতে।
এর বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তুলনায় ১০০ গুণ পাতলা। অর্থাৎ, এখানে বায়ুর চাপ পৃথিবীর চাপের চেয়ে ১০০ গুণ কম। মঙ্গলের চারপাশে গ্যাসের একটি পাতলা স্তর রয়েছে। এর অধিকাংশই কার্বন ডাই-অক্সাইডে গঠিত। দুটি উপগ্রহ আছে এর, একটির নাম ফোবোস (Phobos) অপরটির নাম ডেইমস (Deimos)।
মঙ্গলের পৃষ্ঠে বিজ্ঞানীরা অনেক উঁচুনিচু জায়গা এবং অনেক গর্ত লক্ষ্য করেছেন। এগুলো মূলত আগ্নেয়গিরি, পাহাড় ও গর্ত। পাহাড় আর গর্তগুলো সৃষ্টি হয়েছিল উল্কাপাতের ফলে। কিছু গর্তের সাদৃশ্য পাওয়া যায় হ্রদের সঙ্গে। এই ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। কারণ, হ্রদ থাকা মানে পানির অস্তিত্ব, আর পানির অস্তিত্ব থাকা মানে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা আছে।
পৃথিবী থেকে মঙ্গলের যাত্রা সাত মাসের আর মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল থেকে তার ভূপৃষ্ঠের যাত্রা মাত্র সাত মিনিটের! এক্ষেত্রে যে ব্যাপারটির দিকে বেশি নিজর রাখা লাগবে, মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে সংকেত পৌঁছাতে সময় লাগে ১৪ মিনিট। অর্থাৎ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সেখানের বার্তা পাওয়ার ১৪ মিনিট আগেই ঘটনা ঘটে যাবে। তাই সেই মহাকাশযান তার কাজ ঠিক মতো করতে পেরেছে কি পারেনি, তা তৎক্ষণাৎ নির্ণয় করা বিজ্ঞানীদের পক্ষে অসম্ভব। তাই এই ৭ মিনিটের এই যাত্রাকে তারা আখ্যায়িত করেছেন সেভেন মিনিট টেরর হিসেবে।
৩০ শে জুলাই ২০২০, বিজ্ঞানীরা পারসেভারেন্স (Perseverance) নামক একটি ভ্রমণকারী রোবট মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে প্রেরণ করেছেন। এই রোভারটি কয়েক মাস পর (১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২১), মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে এসে পড়েছে। এটি যখন স্যাটেলাইট থকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন রোভারটি মঙ্গলের পৃষ্ঠ হতে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করে। পৃষ্ঠ স্পর্শ করতে সময় লাগে মাত্র ৪০০ সেকেন্ড। যখন রোভারটি পৃষ্ঠ হতে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে থাকে, তখন এর গতিবেগ দাঁড়ায় ঘন্টায় ২০,০০০ কিলোমিটার। যার ফলে এর তাপমাত্রা বেড়ে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি হয়ে যায়। এই তাপমাত্রার থেকে রোভারটিকে রক্ষা করে একটি হিট-শিল্ড।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোভারে থাকা প্যারাসুটটি নিক্ষিপ্ত হয়। প্যারাসুটের প্রস্থ ২১.৫ মিটার। প্যারাসুটের ফলে রোভারের গতি কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু তারপরও এই হ্রাসকৃত গতি রোভারটির নিরাপদ অবতরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
যখন এটি পৃষ্ঠ হতে ১০০ মিটার দূরত্বে থাকবে, তখন এর গতি সেকেন্ডে ১০০ মিটারে নেমে আসবে। এ সময়, একটি স্কাইক্রেন মূল খোলস থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এই ক্রেনের মূল উদ্দেশ্য হলো, থ্রাস্টারের মাধ্যমে রোভারটিকে কিছুটা দূরে সরিয়ে আনা এবং তার গতি হ্রাস করতে সাহায্য করা। মঙ্গলের পৃষ্ঠ হতে ২১ মিটার দূরত্বে স্কাইক্রেনটি অবস্থান করবে এবং কিছু দড়ির সাহায্যে রোভারটিকে পৃষ্ঠে অবতরণ করানো হবে। এর পর স্কাইক্রেনটি ছিটকে দূরে সরে যাবে। অবতরণের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে নাসার তৈরি কিছু অত্যাধুনিক রেডিও সিগন্যাল ট্রান্সমিটার।
রোভারটি অবতরণ করবে মঙ্গলের জাজিরো ক্র্যাটার (Jazero Crater) অঞ্চলে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ক্র্যাটার বা গর্তটি এককালে ছিল একটি প্রশস্ত হ্রদ। হয়তোবা এখানে এককালে পানির অস্তিত্বও ছিল। তাই এখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাও আছে। এই ক্র্যাটারটি গেইল ক্র্যাটার (যেখানে অবতরণ করেছিল এর আগের রোভারটি) হতে ৩,৭০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
পারসেভারেন্সের মূল উদ্দেশ্য
রোভারটির মূল উদ্দেশ্য মঙ্গল গ্রহে জীবনের সন্ধ্যান করা। এতে থাকা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এটি মঙ্গল গ্রহে নানা পরীক্ষা চালিয়ে যেতে সক্ষম। এর আরো একটি উদ্দেশ্য হলো, মঙ্গল গ্রহ থেকে কিছু নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসা। এই রোভারের খোঁজ শেষ হবে ২০৩১ সালে। ২০৩১ সালে এই রোভারকে আবার পৃথিবীতে ফেরত আনা হবে।
মানুষের কৌতূহলের তৃষ্ণা বড় তীব্র। আগুন আবিষ্কারের হাত ধরে আধুনিক মানুষের কৌতূহলের যাত্রা শুরু। এই কৌতূহলের শেষ কোথায়, তা আজও আমাদের অজানা। সেই কৌতূহলেরই একটা ঝলক হলো মঙ্গলে মানুষের অভিযান।