১৯২৪ সাল। হঠাৎ করেই পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ঢিঢি পড়ে গেল। কোথা থেকে কোনো এক ফরাসী বিজ্ঞানী উদ্ভট এক তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন। যদিও বিজ্ঞানের জগতে কোনো তত্ত্বকেই কখনো উদ্ভট ভাবা হয় না; কেননা প্রশ্ন যত উদ্ভট হয়, তার উত্তরও বিজ্ঞানের কোনো একটা বিষয়ের ধ্যান ধারণা তত পরিষ্কার করে তোলে অথবা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
আর তাছাড়া উদ্ভট তত্ত্বে সত্য প্রমাণ হওয়ার নজিরও নেহাত কম নয়। তারপরও এর প্রস্তাবনা এমনই যে শুনলে পিলে চমকে যাওয়ার মতোই। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, মানুষ তার আশেপাশে যত ধরনের ভরসমৃদ্ধ কণাসদৃশ বস্তু দেখে, এগুলো নাকি আবার একই সাথে তরঙ্গও। তার মানে এমনকি মানুষ নিজেও এর বাইরে নয়, মানে মানুষের মধ্যেও ভরের কারণে সৃষ্ট কণা চরিত্রের পাশাপাশি তরঙ্গ চরিত্রও বিদ্যমান। চোখ কপালে উঠবে বৈকি।
আসলে কোনো একটা পদার্থের এই দ্বিমুখী বা দ্বৈত চরিত্র যে সে সময়কার বিচারে একেবারে নুতন তাও নয়, বরং এর তিন বছর আগে ১৯২১ সালে আইনস্টাইন আলোর তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯০৫ সালে দেওয়া এই তত্ত্বের মাধ্যমে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য জনপ্রিয় এই বিজ্ঞানী আলোর কণা ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পূর্বে আলো তরঙ্গ হিসেবেই ব্যাপকভাবে গৃহীত ছিল।
কিন্তু, আলোকে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের চারপাশে দেখা আর দশটা সাধারণ পদার্থ বা কোনো একটা বস্তুর কাতারে দেখতে মন ঠিক সাঁয় দেয় না। কাজেই আলোর এই দ্বৈত আচরণ যে আর কারো ক্ষেত্রেও খাটতে পারে তা ছিল বাস্তবিকই অভাবনীয়। আর সেই ধারণার মূলেই করাঘাত করে ফরাসী এই বিজ্ঞানী আবারো বিজ্ঞানের জগতের অনিত্যতাকে সামনে নিয়ে আসেন।
পরবর্তীতে ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক কোম্পানির ল্যাবরেটরি (পরবর্তীতে বেল ল্যাবস) বিভাগের ক্লিনটন ডেভিসন এবং লেস্টার জার্মার নামের দুজন বিজ্ঞানী ১৯২৭ সালে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রস্তাবনা প্রমাণ করে দেখালে তার ২ বছর পরেই ১৯২৯ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন কিংবদন্তী এই ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেও মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানেই অধ্যয়নের কথা ছিল না। কথা ছিল ইতিহাস পড়বেন, হবেন ঐতিহাসিক। যদি তিনি তা হতেন তাহলে পৃথিবী হারাতো অসাধারণ এক পদার্থবিজ্ঞানীকে। আলোচিত এই বিজ্ঞানীর নাম প্রিন্স লুই ভিক্টর পিয়েরে রেমন্ট ডি ব্রয়, বা সংক্ষেপে ডি ব্রয়; যদিও প্রচলিত বাংলায় তার নাম ডি ব্রগলি হিসেবেই লেখা হয় সব ক্ষেত্রে।
শৈশব ও কৈশোর
১৯২৪ সালে পদার্থের দ্বৈত চরিত্রের প্রস্তাবনা দেওয়ার ৩৮ বছর আগে, ১৮৯২ সালের ১৫ই অগাস্ট ফ্রান্সের ডিয়েপে শহরে জন্মগ্রহণ করেন ডি ব্রগলি। বাবা ভিক্টর ডিউক ডি ব্রগলি ও মা পলিন ডি’আরমা। ডি ব্রগলি বংশে তিনি ৭ম ডিউক। বড় বোন লরা মারি পলিন ডি ব্রগলি এবং বড় ভাই মরিস ডি ব্রগলির পর এই খ্যাতনামা ও সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে ৩য় সন্তান হিসেবে ঘর আলো করেন তিনি। তার ডিউক উপাধি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এবং প্রিন্স উপাধি অস্ট্রিয়ার হয়ে ৭ বছরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত।
শিশু বয়স থেকে তিনি তেমন একটা বিজ্ঞানের পথে ছিলেন এমনটা বলা যাবে না, বরং রাতে খেতে বসে বিভিন্ন নাটক থেকে সংলাপ হুবহু আওড়ে বাকিদের মুগ্ধ করতে পারতেন। এ থেকে বোঝা যেত যে নাটকের প্রতি তার ভালোবাসা নিখাদ।
১৯০৬ সালে পিতার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গৃহশিক্ষকদের থেকেই শিক্ষা অর্জন করেন। বাবার মৃত্যুর পর তার বড় ভাই মরিস তাকে লিসে জঁসঁ ডে সাঈ স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে ইতিহাস এবং দর্শনে খুব ভালো করার মধ্য দিয়ে ১৯০৯ সালে স্কুল জীবন শেষ করেন তিনি। সে সময় পদার্থবিজ্ঞান কিংবা গণিতে তেমন আগ্রহ ছিল না তার। যার কারণে তিনি প্রথমে সাহিত্যে মাধ্যমিক ডিগ্রী অর্জনের জন্য ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে ১৯১০ সালে ইতিহাসে ডিগ্রী অর্জন করেন।
কিন্তু ভাগ্যদেবীর ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা
কিন্তু ভবিষ্যতের বিষয়ে তার দ্বিধা দ্বন্দ দেখে তার ভাই মরিস (যিনি নিজেও একজন পদার্থবিজ্ঞানী), তাকে পদার্থবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার গঠনের জন্য প্রভাবিত করতে সক্ষম হন এবং ১৯১৩ সালে ডি ব্রগলি ইউনিভার্সিটি অব সোর্বন থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রী অর্জন করেন। এখানে পড়াকালীন সময় ১৯১২ সালে বিখ্যাত সলভে কনফারেন্সের প্রতিবেদন তাকে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলে।
এরপর ১৯১৪ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তাকে ফরাসী সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে হয় এবং তাকে সেনাবাহিনীর বেতার বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে আইফেল টাওয়ারে পাঠানো হয়। এ দায়িত্ব তার জন্য এক অর্থে শাপে বর হয়ে আসে। বেতার যোগাযোগের দায়িত্বে থাকার জন্যে এবং তখনকার বিচারে স্বল্পোন্নত বেতার যন্ত্রের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের গতির কারণে তিনি তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ নিয়ে ভাবনার অনেক সময় পান, আর তার সাথে আরও যুক্ত হয় ইলেকট্রন এবং তরঙ্গ নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনা, যা তাকে বিজ্ঞানের এ শাখাটি নিয়ে অনেক আগ্রহী করে তোলে।
১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ডি ব্রগলি তার ভাই মরিসের ল্যাবে কাজ করতে যান। মরিস ছিলেন ফলিত পদার্থবিজ্ঞানী, সহজ বাংলায় যারা মূলত পরীক্ষণের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় গবেষণা করেন। বস্তুত এখানকার অভিজ্ঞতাই ডি ব্রগলির সেই বৈপ্লবিক তত্ত্বের পেছনে ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে। সে সময় মরিসের গবেষণাগারে এক্স-রে নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল, যার ফলশ্রুতিতে ডি ব্রগলি আলোর দ্বৈত চরিত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।
পরীক্ষাগারের সান্নিধ্যে থাকলেও ব্রগলির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান। এখানকার বিভিন্ন অমীমাংসিত রহস্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করতেন তিনি। কাজেই যখন থেকে তিনি বড় ভাইয়ের কাছে কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর ম্যাক্স প্ল্যাংক এবং আইনস্টাইনের কাজ সম্বন্ধে জানতে পারেন, তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের এই দিকটি নিয়ে তার মধ্যে বিপুল আগ্রহ কাজ করতে শুরু করে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিললে তিনি তখন পরমাণু জগতের অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে লেগে পড়েন এবং শেষমেশ ১৯২৪ সালে তার পিএইচডি পড়াশোনার অংশ হিসেবে এ বিষয়ে ডক্টরাল থিসিস প্রকাশ করেন।
ডি ব্রগলির প্রস্তাবনা এবং তরঙ্গ বলবিদ্যার জন্ম
পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের গতি বিশ্লেষণ করতে গেলে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া লাগছিল বারবার। ইলেকট্রন যখন নিউক্লিয়াসের চারপাশে আবর্তিত হয় তখন গাণিতিক ফলাফল আর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। কেন এমনটা হচ্ছে সে সময়ে তা কারো জানা ছিল না।
ডি ব্রগলি এ সমস্যা সমাধানের জন্য আলোর দ্বৈত চরিত্রের অনুরূপ ইলেকট্রনেরও তরঙ্গ অস্তিত্বের প্রস্তাবনা করেন। তার মতানুসারে, নিউক্লিয়ার চার্জ দ্বারা আবদ্ধ সীমানায় কোনো একটা গতিশীল তরঙ্গের গতিপথই কেবল এমন নির্দিষ্ট হওয়া সম্ভব।
১৯২৩ সালে প্রথম যখন এই ধারণা প্রস্তাবিত হয়, তখন এর স্বপক্ষে সমর্থন পাওয়া যাচ্ছিল অল্পই। কেননা, সে সময় ইলেকট্রনের কণা ধর্ম পরীক্ষালব্ধ উপায়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু, ১৯২৪ সালে এটি থিসিস আকারে প্রকাশ পাওয়ার পর এর একটি কপি আইনস্টাইনের হাতে পৌঁছালে তিনি এই ভাবনাকে সাদরে সম্ভাষণ জানান এবং অকপটেই এর প্রতি নিজের আস্থা ও সমর্থন জ্ঞাপন করেন। পাশাপাশি এ ধারণার ওপর তিনি নিজেও কিছু কাজ করেন। ফলস্বরূপ বিজ্ঞানের জগতে ধীরে ধীরে তার তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে থাকে।
এরপর ১৯২৭ সালে ডেভিসন এবং জার্মারের পরীক্ষায় ইলেকট্রনের অপবর্তনের বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুটিত হলে তার তত্ত্ব সফলভাবে প্রমাণিত হয়।
ডি ব্রগলির দেওয়া তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এরউইন শ্রোডিঙ্গার ১৯২৬ সালে তরঙ্গ ফাংশন এবং তরঙ্গ সমীকরণ উদ্ভাবন করে তরঙ্গ বলবিদ্যা নামে পদার্থবিজ্ঞানে নতুন শাখার সূচনা করেন। কোয়ান্টাম জগতে যেকোনো চলাফেরার নেপথ্যে যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কাজ করে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এই তরঙ্গ বলবিদ্যা।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রণয়নে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটি ভিত্তি ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পল ডিরাক উদ্ভাবিত আপেক্ষিক তরঙ্গ সমীকরণ উদ্ভাবনের পেছনেও ডি ব্রগলির এই তত্ত্বের অবদান অসামান্য। তরঙ্গ বলবিদ্যার এই গাণিতিক রূপায়নের জন্য শ্রোডিঙ্গার ও ডিরাক যুগপৎভাবে ১৯৩৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
পরবর্তী জীবন ও বিভিন্ন সম্মাননা
ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর ডি ব্রগলি সোর্বন বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন এবং ১৯২৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হেনরি পয়ক্যারে ইন্সটিটিউটে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬২ সালে তার অবসরের আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
১৯৪৫ সালের পর থেকে ডি ব্রগলি ফরাসী পারমাণবিক শক্তি কমিশনের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫২ সালে বিজ্ঞানকে সাধারণ জনতার বোধগম্য করার জন্য তার লেখালেখি এবং অন্যান্য প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো তাকে কলিঙ্গ পুরস্কার প্রদান করে। পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ রয়াল সোসাইটির একজন আন্তর্জাতিক সদস্য ছিলেন। ফরাসী বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাকে আজীবন সচিব পদে ভূষিত করে।
১৯৪৪ সাল থেকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির মতো ফ্রান্সের অ্যাকাডেমি ফ্রাঁসেই (ফরাসী অ্যাকাডেমি)-র প্রধানের পদ অলংকৃত করেন। এছাড়া এটাও রোমাঞ্চকর একটা তথ্য যে, ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ তথা CERN এর একনিষ্ঠ এবং ১ম সারির সমর্থকদের মধ্যে তিনিই প্রথম এর প্রস্তাবনা করেন।
কিংবদন্তী এই চিরকুমার বিজ্ঞানী ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।