যারা কুকুর, বিড়াল, খরগোশ পালন করেন তারা একটি বিষয় নিয়ে সর্বদাই চিন্তিত থাকেন- পোষা প্রাণীটির লিটার ট্রেইনিং। প্রাণীটিকে শৈশব থেকেই এমনভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বড় করে তোলা যাতে সে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে তার মল-মূত্র ত্যাগ করে। বিড়ালের বাচ্চা যখন একেবারেই ছোট থাকে তখন তারা স্বনির্ভর হয়ে মল-মূত্র ত্যাগ করতে পারে না বিধায় তাদের মা এই কাজের ভার নেয়। মোটামুটিভাবে দেড় থেকে দু’ মাস বয়স থেকে বিড়াল ছানাকে নির্দিষ্ট স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করার প্রশিক্ষণ শুরু করা যেতে পারে। কুকুর, বিড়াল, খরগোশকে প্রশিক্ষিত করে সুবিধা? যেহেতু তাদেরকে ঘরে পোষা হচ্ছে তাই তারা সবসময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করলে ঘরদোর পরিষ্কার রাখা সহজ হয়।
কুকুর, বিড়াল, খরগোশের সাথে গৃহপালিত প্রাণী গরুর পার্থক্য কী? অন্যরা মানুষের সাথে একই ছাদের তলায় বসবাস করলেও গরু কিংবা বাছুরকে কিন্তু ঘরে আনা হয় না। আলাদা একটি থাকার জায়গা তাদের জন্য করে দেওয়া হয়- গোয়ালঘর। গোয়ালঘরেই গরু, বাছুর মল-মূত্র ত্যাগ করে থাকে। খামারের মালিক নিয়মিত ভিত্তিতে ঘরটি পরিচ্ছন্ন রাখেন। শুনতে অন্যরকম শোনালেও, সম্প্রতি বাছুরকে প্রশিক্ষিত করার বৈজ্ঞানিক উপায় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে বর্তমানে গরুর সংখ্যা প্রায় ১.৪ বিলিয়ন। প্রতি মুহূর্তে মূত্র, মল ও ঢেঁকুরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ নিঃসরণ করে পরিবেশে। যা বিরূপ প্রভাব রাখে পৃথিবীতে। গরুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তারা জাবর কাটে। তাদের একাধিক প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পাকস্থলীতে নানা ধরনের অণুজীব গাঁজনের (ফার্মেন্টেশন) মাধ্যমে তাদের পরিপাকে সাহায্য করে। খাদ্য পরিপাকে গাঁজন একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় এরা ঢেঁকুরের সাথে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে।
শুধু গরুর মূত্র থেকেই প্রতিদিন উৎপন্ন মিথেন গ্যাসের (অন্যতম প্রধান গ্রীন হাউজ গ্যাস) পরিমাণ ৫৫-১১০ গ্যালন। মিথেনের পাশাপাশি গরুর মূত্রে বর্তমান থাকা বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্য পদার্থ বিভিন্ন জলাশয়ের পানিতে মিশে গিয়ে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এর পাশাপাশি সেসব জলাশয়ের পানি পান কিংবা ব্যবহারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। মূলত গবাদি পশুর মল-মূত্র থেকে নিঃসৃত উপাদান থেকে সংঘটিত পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ হিসেবেই বিজ্ঞানীরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বাছুরকে প্রশিক্ষিত করতে।
সম্প্রতি জার্মানী ও নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাছুরকে প্রশিক্ষিত করা বিষয়ক একটি গবেষণা সম্পন্ন হয়। এর ফলাফল ছিল ইতিবাচক। অন্য অনেক প্রাণীর মতোই গরুর মূত্র ত্যাগের পেছনে থাকা স্নায়ুবিক ক্রিয়াকৌশল বেশ জটিল। মূত্র ত্যাগের পেছনে কিছু নিয়ামক কাজ করে- কিছু কিছু ধাপ ক্রমিক অর্থাৎ একটির পরই কেবল পরেরটি সম্পন্ন হবে এবং কিছু কিছু ঘটনা একইসাথে ঘটে থাকে।
মূত্রথলী পূর্ণ হওয়ার অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, প্রতিবর্তী ক্রিয়া, মূত্র ত্যাগের স্থান নির্বাচন, এবং সবশেষে ইউরেথ্রাল স্ফিংক্টার শিথিল করা এ ধাপগুলোর মাধ্যমেই একটি প্রাণী মূত্র ত্যাগ সম্পন্ন করে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে প্রয়োজন প্রাণীটির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয়। পুরো প্রক্রিয়াটির মাঝে প্রাণীর বার বার নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার প্রবণতা প্রাকৃতিকভাবে থাকে না, তবে রিওয়ার্ড বেইজড মেকানিজম অর্থাৎ পুরষ্কার প্রদানের মাধ্যমে নির্ধারিত স্থানে মূত্র ত্যাগে উৎসাহিত করার মাধ্যমে বাছুরকে একাধিক সেশন শেষে প্রশিক্ষিত করা যায়।
দুই দেশের গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় সম্পন্ন এই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় মোট ১৬টি বাছুরকে বাছাই করা হয়। ৮টি করে দুটি দলে এদেরকে ভাগ করে নেয়। গবেষণাটিতে নির্ধারিত স্থানে মূত্র ত্যাগের পুরষ্কারস্বরূপ বাছুরকে দেওয়া হতো খাদ্য এবং কোনো বাছুর ভুল করলে তাকে ভর্ৎসনা করার জন্য হালকা পানির ঝাপটা দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণ শেষে দেখা গেল ১৬টি বাছুরের মাঝে মোট ১০টি বাছুর পুরষ্কারের মাধ্যমে নির্ধারিত স্থানে মূত্র ত্যাগের বিষয়টি রপ্ত করতে পেরেছে যথাযথভাবে।
গরুর মূত্রে থাকা পদার্থ ইউরিয়া বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতায় অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয়। মাটিতে মূত্র পড়ে মিশে যাওয়ার পর মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে এই অ্যামোনিয়া আবার নাইট্রাস অক্সাইডে পরিণত হয়। যা অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস। নাইট্রাস অক্সাইড গ্রিন হাউজ গ্যাস হিসেবে কতটা ক্ষতিকর সেটি বোঝার জন্য একটি তুলনাই যথেষ্ট– গ্রীন হাউজ গ্যাস হিসেবে এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৯৬ গুণ বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নজুড়ে নিঃসরিত মোট অ্যামোনিয়ার ৭০ ভাগই আসে প্রাণীসম্পদ থেকে। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য যে, পুরো পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল গাড়ি, ট্রাক, বাস, প্লেন সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে, একা প্রাণীসম্পদ তার চেয়ে বেশি নিঃসরণের জন্য দায়ী।
বাছুরগুলোকে প্রশিক্ষিত করে উপকার হবে এই যে, তারা তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়েই মূত্র ত্যাগ করবে এবং এতে করে তারা মাটিতে মূত্র ত্যাগের অভ্যাস থেকে সরে আসবে। মাটিতে মূত্র না মেশার ফলে মূত্রে থাকা ইউরিয়ার নাইট্রাস অক্সাইডে পরিণত হওয়া সম্ভব হবে না যার কারণে গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমে আসবে। গরু-বাছুরের মলমূত্র ত্যাগের স্থানটিতে বাছুরের মূত্র সংগ্রহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে এবং সেটিকে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হবে যাতে পরিবেশের ক্ষতি হয় সবচেয়ে কম। গবেষকরা আশা করছেন তারা একইভাবে বাছুরগুলোকে অভ্যস্ত করে তোলার মাধ্যমে তাদের এই কাজকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
বর্তমানে তারা কাজ করছেন দুটি বিষয়ে। প্রথমত, তাদের গবেষণাটি ছিল সম্পূর্ণভাবে ল্যাবরেটরির মতো পরিবেশে। তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে এই একই বিষয় বড় আকারের খামারে প্রয়োগ করে সফল হওয়া। দ্বিতীয়ত, তারা একটি সেন্সর ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন যার মাধ্যমে একটি খামারে থাকা সকল বাছুরই প্রশিক্ষিত হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
তবে বাছুরকে প্রশিক্ষিত করার এই ধারণা ও প্রক্রিয়া খামারিরা কেমনভাবে নেবেন, কতটা মেনে নেবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ সেন্সরের বিষয়টি বাদ দিলেও যদি ধরেই নেওয়া হয় যে, মানুষই বাছুরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন তাহলেও সেটি এতকাল ধরে প্রচলিত গরু পালন ব্যবস্থার সাথে মিলবে না। তাই গবেষণাগারে যেটি এতটা সফলতার মুখ দেখছে সেটি বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটি নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না।