একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিজ্ঞানের ইতিহাসে নারী বিজ্ঞানীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। ব্যাপারটি কি আসলেই সত্য? নাকি নারীদের থেকে পুরুষ বিজ্ঞানীরাই আমাদের কাছে বেশি প্রাধান্য পায়? আমাদেরকে যদি কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম অনুমান করতে বলা হয়, তবে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হবে না। ছোটবেলা থেকেই নানা বিজ্ঞানী ও তাদের অবদান সম্পর্কে আমরা পাঠ্যবই ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে জেনে আসছি। কিন্তু যদি নির্দিষ্টভাবে নারী বিজ্ঞানীদের নাম অনুমান করতে বলা হয়, তবে খেয়াল করুন। আপনি হিমশিম খাবেন।
আসলে বিষয়টি এমন নয় যে, নারী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা তুলনামূলক কম কিংবা বিজ্ঞানে নারীদের ভূমিকা পুরুষের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নারীদের অবদানকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে। এই যেমন ধরুন কম্পিউটার আবিষ্কারের কথা। পৃথিবীর প্রথম আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয় বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজকে। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, চার্লস ব্যাবেজের নকশা করা কম্পিউটারটির প্রোগ্রামার ছিলেন একজন নারী। তার নাম আডা লাভলেস। কম্পিউটার তৈরির পেছনে তারও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম প্রোগ্রামার বলা হয়।
এবার আরেকজনের কথা বলা যাক। তিনি মার্গারেট হ্যামিলটন। মানুষের চাঁদে অভিযানের সেই যুগান্তকারী ঘটনা সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি। অ্যাপোলো ইলেভেন নামক সেই অভিযান নিয়ে আমরা শুধু নভোচারীদের গল্পই শুনেছি। কিন্তু এই নভোচারীদের সঠিকভাবে চাঁদে নিয়ে যাওয়া ও নানা দুর্ঘটনা এড়িয়ে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনতে অনেকে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। তাদের সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি। এই চন্দ্র অভিযানের পেছনে মারগারেট হ্যামিল্টনের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তিনি ও তার দল অভিযানের নিরাপত্তাজনিত সকল দিক তদারকি করে চন্দ্র অভিযান সফল করেছিলেন।
এই লেখায় আমরা এমনই একজন নারীর অবদানকে তুলে ধরবো। তিনিও পূর্বে উল্লিখিত নারীদের মতো একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী, যার অ্যালগরিদমের কারণে মানবজাতি প্রথমবারের মতো সত্যিকার কৃষ্ণগহ্বরের ছবি অবলোকন করতে সক্ষম হয়। আর তিনি হলেন কেটি বাউম্যান।
কিছুদিন আগেই এপ্রিল মাসের ৯ তারিখে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হয়। মানবজাতি প্রথমবারের মতো একটি সত্যিকার কৃষ্ণগহ্বরের চিত্র দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে। কিন্তু এই অর্জন এমনিতেই আসেনি। এই অর্জনের সাথে জড়িত ছিলেন প্রায় ২০০ গবেষক ও বিজ্ঞানী। কয়েক বছর ধরে তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন কৃষ্ণগহ্বরের ত্রুটিহীন চিত্র দৃশ্যায়নের জন্য। আর এই গবেষকদের মাঝে অন্যতম কেটি বাউম্যান।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, কেটি বাউম্যানের কথা আলাদাভাবে নেওয়া হচ্ছে কেন? এর কারণ, যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে কৃষ্ণগহ্বরের চিত্র ধারণ করা হয়েছে, তা এই নারী গবেষকের প্রতিনিধিত্বেই তৈরি করা হয়েছে। তার এই অ্যালগরিদম ও আটটি শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপের সমন্বয়ে এই ত্রুটিমুক্ত ও বাস্তবসম্মত চিত্র ধারণ করা সম্ভব হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তু। এই মহাজাগতিক সত্তাটি নিয়ে নানা ধরনের তত্ত্ব ও কল্পনা প্রচলিত রয়েছে। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। তৈরি হয়েছে নানা কাল্পনিক আলোকচিত্র। তবে বাস্তবে একটি কৃষ্ণগহ্বরের চিত্র ধারণ করা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। এর পেছনে রয়েছে বিস্তর গবেষণা ও অধ্যবসায়ের গল্প।
২৯ বছর বয়সী ক্যাথেরিন লুইস বাউম্যান ওরফে কেটি বাউম্যান ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে পড়াশোনার সময় তিনি একটি অ্যালগরিদম তৈরি করেন। এটি বানানোর সময়ও তিনি জানতেন না, আসলে কৃষ্ণগহ্বর কী জিনিস। তার এই অ্যালগরিদমের নাম ছিল Continuous High-Resolution Image Reconstruction using Patch priors (CHIRP)। এটি ইন্টারফেরোমেট্রি নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টেলিস্কোপে শনাক্ত করা বিভিন্ন সংকেত একত্রিত করে প্রয়োজনীয় ত্রুটিহীন চিত্র তৈরি করতে পারে।
কেটি বাউম্যানের এই অ্যালগরিদম কৃষ্ণগহ্বরের চিত্র ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার মতে,
বেতার তরঙ্গের অনেক সুবিধা রয়েছে। এটি যেমন একটি দেয়াল ভেদ করতে পারে, তেমনি ছায়াপথের ধূলিকণাও ভেদ করতে পারে। আমরা আমাদের দৃষ্টিসীমার মাঝে কখনো ছায়াপথের কেন্দ্র দেখতে পারবো না। কারণ এর মাঝে অনেক কিছু রয়েছে।
দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে বেতার তরঙ্গ শনাক্তকরণের জন্য অনেক বড় রেডিও টেলিস্কোপের প্রয়োজন। কৃষ্ণগহ্বরের ছবি নেওয়ার জন্য যে টেলিস্কোপের দরকার তার আকার তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীর ব্যাসের কাছাকাছি হতে হবে। কেটি বাউম্যান কৃষ্ণগহ্বরের চিত্র ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন,
একটি কৃষ্ণগহ্বর আকারে অনেক, অনেক বড়। মিল্কি ওয়ে ছায়াপথের মাঝখানে এমন একটি বস্তুর চিত্র ধারণ করা, আর পৃথিবী থেকে চাঁদে একটি আঙ্গুরের চিত্র ধারণ করা একই কথা। এত দূর থেকে এত ছোট একটি বস্তুর চিত্র ধারণ করার জন্য আমাদের এমন একটি টেলিস্কোপের প্রয়োজন ছিল, যার ব্যাস প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে এটি সম্ভব নয়, কারণ পৃথিবীর ব্যাসই ১৩,০০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে, একটি টেলিস্কোপের মাধ্যমে কখনো এমন কাজ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বিজ্ঞানীগণ একটি নতুন প্রজেক্ট হাতে নেন। “ইভেন্ট হেরাইজেন টেলিস্কোপ” নামক এই প্রজেক্টে মোট আটটি রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়। এই টেলিস্কোপগুলো একত্রে তাত্ত্বিকভাবে একটি গ্রহের সমান আকারের টেলিস্কোপের মতো কাজ করতে পারে।
লক্ষ্যবস্তু যেমন তেমন কোনো জিনিস নয়। একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর। আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে এম৮৭ নামক একটি ছায়াপথে এর অবস্থান। এমন একটি বস্তুর ছবি তোলার পদ্ধতি ছিল সাধারণ ছবি তোলার পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে ক্যামেরা নয়, বরং সংগৃহীত তথ্য থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ছবি দাঁড় করানো হবে। আর এই তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহার করা হয় মোট আটটি রেডিও টেলিস্কোপ। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এদের স্থাপন করা হয়। বিজ্ঞানীরা মনোযোগের সাথে এগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন।
একটি জায়গায় সমস্যা তৈরি হয়। আর তা হলো প্রত্যেকটি টেলিস্কোপে তথ্য প্রবাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আটটি যন্ত্রকে একটি যন্ত্রের মতো আচরণ করতে হলে এ ব্যাপারটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের প্রকৃতি সকল জায়গায় সমান না হওয়ায় প্রত্যেকটি টেলিস্কোপে একত্রে তথ্য পৌঁছায় না। এতে নির্ভুল চিত্র তৈরিতে অনেক ব্যাঘাত ঘটার কথা। কিন্তু এই বিলম্ব দূর করতেই এগিয়ে আসে কেটি বাউম্যানের অ্যালগরিদম। তার এই অ্যালগরিদম টেলিস্কোপগুলোতে তথ্য প্রবাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষ্ণগহ্বরের লক্ষ লক্ষ সিমুলেশন তৈরি করে। উক্ত সিমুলেশনগুলোর সাথে তাত্ত্বিক বিষয়াদির তুলনা করে অবশেষে একটি নিখুঁত ও নির্ভুল চিত্র সম্পাদন করে।
বর্তমানে কেটি বাউম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োজিত আছেন। নিজের বানানো অ্যালগরিদম থেকে তৈরি হওয়া কৃষ্ণগহ্বরের চিত্র তাকে বিমোহিত করে। তার এই মুগ্ধতার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু এই কাজের কৃতিত্ব তিনি একা নিতে নারাজ। তাই তিনি বলেছেন,
কেবল একটি অ্যালগরিদম এবং একজন মানুষ এই চিত্র তৈরি করেনি। এটি তৈরির পেছনে পুরো পৃথিবীব্যাপী অসাধারণ প্রতিভাধর কিছু বিজ্ঞানীর ভূমিকা রয়েছে। বছরের পর বছর লেগে গিয়েছে এজন্য যন্ত্র তৈরি, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইমেজিং পদ্ধতি শুদ্ধকরণ ও পর্যবেক্ষণের পেছনে। আর তারপরই আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি।