পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি দিককার কথা। ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে পঁচিশ মাইল দূরে অবস্থিত ভিঞ্চি শহরে জন্ম নেয় এক ছেলে, নাম তার লিওনার্দো দি সার পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি। কালক্রমে এই ছেলেটিই জগত জুড়ে পরিচিত হয়ে ওঠে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নামে।
ইতালীর রেনেসাঁকালে (চতুর্দশ-সপ্তদশ শতক) জন্ম নেয়া এ মানুষটি ছিলেন একজন পলিম্যাথ (জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহুবিধ শাখায় যার রয়েছে স্বচ্ছন্দ বিচরণ)। উদ্ভাবন, চারুকলা, ভাষ্কর্য, স্থাপত্যবিদ্যা, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, গণিত, প্রকৌশলবিদ্যা, সাহিত্য, এনাটমি, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ইতিহাস চর্চা ও মানচিত্রাঙ্কন- জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সৃজনশীলতার এত বিশাল জগত জুড়ে হেসে-খেলেই বেড়িয়েছেন এ মানুষটি।
লিওনার্দোর উদ্ভাবন ছিলো অগণিত। এর মাঝে অনেকগুলো থেকে গিয়েছিলো তার নোটবুকেই, কেবলমাত্র স্কেচ হিসেবে। অসম্ভব প্রতিভাধর এ মানুষটির এক ডজন উদ্ভাবনের গল্প শোনাতেই আজকের এ লেখার অবতারণা।
১) অ্যানিমোমিটার
পাখিদের উড়তে পারার ক্ষমতা যে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে দারুণভাবে বিমোহিত করতো, সে কথাটা তার জীবন নিয়ে কয়েক পাতা ওল্টানো কারোরই অজানা নয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ মোহই তাকে অ্যানিমোমিটার নামক যন্ত্রটির ডিজাইন করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো, যা দিয়ে তিনি বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ মাপতে পারবেন। তিনি আশা করেছিলেন, তার এ যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে উড়বার আগমুহূর্তে বায়ুপ্রবাহের দিক সম্পর্কেও জানা সম্ভব হবে।
অবশ্য এ যন্ত্রের ডিজাইনের মূল কৃতিত্ব লিওন বাতিস্তার, যিনি ১৪৫০ সালে এর নকশা করেছিলেন। ভিঞ্চি ১৪৮৩ থেকে ১৪৮৬ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে সেই যন্ত্রেরই ভিন্ন এ প্রকরণটির নকশা করেন, যা আগেরটির চেয়ে আরো কার্যকরভাবে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ মাপতে পারবে।
অ্যানিমোমিটারের স্কেচের পাশে তিনি লিখেছিলেন, “বায়ুপ্রবাহের সাহায্যে প্রতি ঘণ্টায় কতটুকু দূরত্ব অতিক্রান্ত হয়েছে, সেটি পরিমাপের জন্য। সময় গণনার জন্য এখানে একটি ঘড়ি দরকার।”
২) প্যারাসুট
পতনশীল কোনো বস্তু কত বেগে ভূমির দিকে ধেয়ে আসছে, তা মূলত নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর- (ক) অভিকর্ষ বল এবং (খ) বাতাসের সাথে ঘর্ষণ। যদি কোনো বায়ুমণ্ডল না থাকতো, তাহলে বস্তুটির বেগ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তেই একসময় তা মাটিতে আছড়ে পড়তো। কিন্তু বায়ুমণ্ডল থাকায় সেটি আর হয় না। পতনশীল বস্তুর সাথে বাতাসের ক্রমাগত ঘর্ষণের ফলে তার ত্বরণ কমতে কমতে একসময় একটি প্রান্তীয় বেগে এসে উপনীত হয়। এ বেগ নিয়েই পতনের বাকিটা সময় বস্তুটি ভূমির দিকে আসতে থাকে।
প্যারাসুট কাজ করে এই প্রান্তীয় বেগ নিয়েই। এখানে আরোহীর প্রান্তীয় বেগকে যথাসম্ভব কমিয়ে এমন মাত্রায় আনা হয় যেন অনেক উঁচু থেকে পড়লেও মানবদেহের কোনো ক্ষতিই না হয়। মানুষকে একদিন উড়তে দেখার স্বপ্নে বিভোর মানুষটি স্বজাতির ওড়ার পথ সহজ করতেই প্যারাসুটের ডিজাইন করেছিলেন। পিরামিড আকৃতির ফ্রেম ঢাকতে ব্যবহার করা হয়েছিলো কাপড়।
নোটবুকে নিজের এ ডিজাইনটি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “(এটা একজন মানুষকে) যেকোনো উচ্চতা থেকে লাফিয়ে পড়লেও নিরাপদে অবতরণের নিশ্চয়তা দেবে।”
৩) অর্নিথপ্টার
প্যারাস্যুটে তো ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিরাপদে অবতরণ করা সম্ভব। কিন্তু পাখিদের ওড়া দেখতে দেখতে একসময় লিওনার্দো ভাবলেন, “ইশ, যদি ওদের মতোই মাটি থেকে ডানা ঝাপটে আকাশপানে যাত্রা করা যেত!” এমন ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত উড়ন্ত মেশিনের নকশা অর্নিথপ্টার।
পাখির মতো করে বানানো এ ডিজাইনে একটি ক্র্যাঙ্ক রাখা হয়েছিলো, যেটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়েই পাইলট আকাশে উড়বেন বলে ভেবেছিলেন ভিঞ্চি। অবশ্য আধুনিককালে তার সেই মডেল বাস্তবায়িত করে দেখা গেছে, অর্নিথপ্টার উড়তে পারবে ঠিকই, কেবলমাত্র যদি ইতোমধ্যেই তা বাতাসে ভেসে থাকে। ক্র্যাঙ্কগুলোকে মানুষের সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যন্ত্রটিকে আকাশে ওড়ানোর স্বপ্নটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো।
৪) এরিয়াল স্ক্রু
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে প্রথম হেলিকপ্টার আবিষ্কৃত হয়। তবে ভিঞ্চির নোটবুক থেকে প্রাপ্ত ডিজাইন পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীগণ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সেখানে থাকা এরিয়াল স্ক্রু নামক যন্ত্রটিই আসলে আজকের দিনের হেলিকপ্টারের পূর্বপুরুষ। যদিও তিনি কখনোই এটা বানিয়ে পরীক্ষা করে যান নি, তবে স্কেচের পাশে ঠিকই নোট রেখে গিয়েছিলেন কীভাবে এ যন্ত্রটি কাজ করবে সেই সম্পর্কে। তিনি লিখেছিলেন, “যদি স্ক্রু দিয়ে গঠিত এ যন্ত্রটি ঠিকমতো তৈরি করা যায়, অর্থাৎ লিনেন দিয়ে তৈরি করে ছিদ্রগুলো স্টার্চ দিয়ে বন্ধ করা যায়, তাহলে এই স্ক্রুটি সর্পিলভাবে আকাশে ভাসতে থাকবে এবং উপরে উঠতে শুরু করবে।”
প্রায় ১৫ ফুট ব্যাসার্ধের এ যন্ত্রটি নলখাগড়া, লিনেন ও তার দিয়ে তৈরি করার চিন্তা করেছিলেন ভিঞ্চি। ওড়ানোর জন্য চারজন মানুষ থাকবে কেন্দ্রীয় একটি প্লাটফর্মে, যারা ক্র্যাঙ্ক ঘোরানোর ফলে ঘুরতে শুরু করবে শ্যাফটটি। ভিঞ্চি ভেবেছিলেন, প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘূর্ণনশক্তি দিতে পারলে তার এ যন্ত্রটি উড়তে শুরু করার কথা। আধুনিককালের বিজ্ঞানীগণ অবশ্য তার সাথে একমত নন। তাদের মতে, অতিরিক্ত ভরের কারণে এরিয়াল স্ক্রুর ভূমি ছেড়ে উপরে ওঠার সম্ভাবনা ছিলো শূন্যের কাছাকাছি।
৫) ট্রিপল ব্যারেল ক্যানন
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মনে করতেন, যুদ্ধ জয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো গতি। এ চিন্তার প্রয়োগ তার করা বিভিন্ন সাঁজোয়া যানের নকশাতেও দেখা যায়।
উদাহরণস্বরুপ ট্রিপল ব্যারেল ক্যাননের কথাই ধরা যাক। তৎকালীন কামানগুলো বেশ ভারী হবার কারণে সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে ব্যবহার করা হতো। এছাড়া সেগুলো রিলোড করতেও বেশ সময় লাগতো। অন্যদিকে ভিঞ্চির ক্যাননটি এ দুটো সমস্যারই বেশ চমৎকার সমাধানের নিশ্চয়তা দিয়েছিলো। সমকালীন প্রচলিত কামানগুলো থেকে যেখানে একবারে মাত্র একটি গোলা ছোঁড়া যেত, ভিঞ্চির কামান থেকে সেখানে ছোঁড়া যেত তিনটি করে। দরকার মতো এর উচ্চতাও কমানো-বাড়ানো যেত। ওজনে হালকা হওয়ায় ও বৃহদাকৃতির চাকা ব্যবহার করায় কামানটি দরকার অনুযায়ী স্থানান্তর করা যেত।
৬) বৃহদাকৃতির ধনুক
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সেনাদের যদি মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া যায়, তাহলে যুদ্ধজয়ের পথটা অনেকটাই সুগম হয়ে যায়। এ সত্যটা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন লিওনার্দো। এজন্যই তিনি এমন সব অস্ত্রের নকশা করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, যেগুলো দেখলে শুরুতেই প্রতিপক্ষের পিলে চমকে যায়।
তার নকশা করা বৃহদাকৃতির ধনুককে তেমন চিন্তার ফসলই বলা চলে। এর একপাশ থেকে অপর পাশের আড়াআড়ি দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ২৭ গজ। চলাচলের জন্য দু’পাশে মোট ছয়টি চাকা ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। ধনুক বানাতে পাতলা কাঠ ব্যবহারের চিন্তাই করা হয়েছিলো যেন সেটি খুব বেশি ভারি না হয়ে যায়। তীরের পরিবর্তে এ ধনুকটি থেকে পাথর কিংবা অগ্নিবোমা নিক্ষেপের চিন্তা করেছিলেন ভিঞ্চি।
৭) সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক
মিলানের ডিউক লুডোভিকো সফোরজার জন্য কাজ করার সময় এ সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন ভিঞ্চি। ট্যাঙ্কটি চালাতে পেশীশক্তির যোগান আসতো আটজন মানুষের সাহায্যে, যারা এর খোলকের ভেতরে থেকে কাজ করে যেতেন। এর চারদিক দিয়ে মোট ৩৬টি বন্দুকের নল বের করে রাখার পরিকল্পনা ছিলো। ফলে ডিজাইন অনুযায়ী যদি আসলে এটা বানানো হতো, তবে যে শত্রুপক্ষের একেবারে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হতো, তা বোধহয় না বললেও চলে।
মজার ব্যাপার হলো, ভিঞ্চির এ ট্যাঙ্কের নকশায় বেশ বড় রকমের একটি ঘাপলা ছিলো। এর গিয়ারগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছিলো যেন সামনের চাকাগুলো পেছনের চাকাগুলোর উল্টোদিকে চলে। ফলে বাস্তবে বানানো হলে ট্যাঙ্কটি জায়গাতেই স্থির থাকতো, একটুও এগোতো না।
ভিঞ্চির মতো একজন দক্ষ ডিজাইনার এমন বোকার মতো ভুল করবেন- এটা ঠিক মেনে নিতে পারেন নি ইতিহাসবিদগণ। এজন্য ট্যাঙ্কের নকশার এ ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করতে তারা কিছু অনুমানের আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মতে- হয় ভিঞ্চি চান নি যে ট্যাঙ্কটি কোনোদিন বানানো হোক, কিংবা শত্রুপক্ষের হাতে এর নকশা চলে যাবার ভয়েই তিনি এমনটা করেছিলেন যাতে করে তিনি ছাড়া আর কেউই সেটা বানাতে না পারে।
৮) ৩৩ ব্যারেলের অর্গান
গোলা ভরতে বেশ সময় নেয়ার ব্যাপারটি ভিঞ্চির সময়কার কামানগুলোর বেশ বড় একটি সমস্যা ছিলো। এজন্য তিনি ডিজাইন করতে চেয়েছিলেন এমন একটি অস্ত্র, যা লোড করতে ও গুলি করতে বেশ অল্প সময় লাগে।
এ চিন্তা থেকেই ৩৩ ব্যারেলের অর্গানটির ডিজাইন করেছিলেন ভিঞ্চি, যাতে তিন সারির প্রতিটিতে ১১টি করে ছোট ক্যালিবারের বন্দুক রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। সবগুলো বন্দুকই একটি ঘূর্ণায়মান প্লাটফর্মের উপর রাখা হয়েছিলো। আর পুরো সরঞ্জামটির চলাচলের জন্য পাশের ছিলো বড় আকারের চাকার ব্যবস্থা।
পরিকল্পনা ছিলো তিন সারির প্রথমটি দিয়ে গুলি করা হবে, দ্বিতীয়টি তখন ঠান্ডা হতে থাকবে এবং তৃতীয়টি লোড করা হতে থাকবে। এভাবে অবিরাম গোলাবর্ষণের সুযোগ রাখা হয়েছিলো এ অস্ত্রটির ডায়াগ্রামে। ধারণা করা হয়, উনিশ শতক থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে যে মেশিনগানের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিলো, তার সূচনা হয়েছিলো ভিঞ্চির এ ৩৩ ব্যারেলের অর্গানের হাত ধরেই।
৯) ঘূর্ণায়মান ব্রিজ
চমৎকার এ ব্রিজটির ডিজাইনও ভিঞ্চি করেছিলেন ডিউক সফোরজার অধীনে কাজ করার সময়। মূলত সেনাবাহিনীর চলাচলের কথা মাথায় রেখেই এর ডিজাইন করা হয়েছিলো। বহনযোগ্য এ ব্রিজ কোথাও পানির উৎস পড়লেই খুলে নিয়ে ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল। কাজ শেষে আবার খুলে নিয়ে শুরু করা যেত পদচারণা।
এসব ব্রিজের ডিজাইন করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো যেন নতুন কোনো এলাকায় সৈন্যরা সহজেই চলাফেরা করতে পারেন এবং শত্রুপক্ষের ধাওয়া খেলে পালাতে কোনো অসুবিধা না হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটি সেনাবাহিনীর মাঝে অন্যরকম গতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিলো।
১০) কলোসাস
১৪৮২ সালের কথা। মিলানের ডিউক ভিঞ্চিকে দায়িত্ব দিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘোড়ার মূর্তি নির্মাণের। এ দায়িত্বটি নিঃসন্দেহে বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিলো। তবে চ্যালেঞ্জ ছিলো বলেই সেটি সানন্দে লুফে নিলেন তিনি, এরপর নকশা করেও ফেললেন ২৪ ফুট উঁচু একটি বিশাল ঘোড়ার মূর্তির, যা নির্মাণে ব্যবহার করা হবে ব্রোঞ্জ।
এবার নির্মাণের পালা। মূর্তিটি প্রথমে বানানো হলো কাদামাটির সাহায্যে। এরপর সিদ্ধান্ত হলো পুরো কাঠামোটি ব্রোঞ্জের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। মূর্তি নির্মাণে এটিই ছিলো সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। আর এ বিষয়টি নিয়ে এমন সব কাহিনী ঘটেছিলো, যা বিখ্যাত এ শিল্পীর মনে বেশ বড় রকমের দুঃখের ছাপ রেখে গিয়েছিল।
ঘোড়ার মূর্তির বিশালাকৃতির জন্য এর পুরোটা ঢাকতে দরকার পড়তো ৮০ টনের মতো ব্রোঞ্জ। তা-ও যেনতেন ভাবে দিলে চলবে না; পুরো কাঠামো জুড়ে সমানভাবে দিতে হবে, নাহলে যে এর ভারসাম্য রাখাটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে! দীর্ঘদিন ধরে কামান ডিজাইনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এ সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ছাঁচ বানানোর পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন ভিঞ্চি। এছাড়া এই বিপুল পরিমাণ ব্রোঞ্জ গলানোর জন্য আলাদা চুল্লীও নির্মাণ করতে হলো তাকে।
সকল সমস্যা সমাধানের পর যখন কাঠামোটি ব্রোঞ্জ দিয়ে ঢাকবার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে, তখনই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হলেন ভিঞ্চি। ১৪৯৪ সালে রাজা চার্লস আক্রমণ করে বসলেন ফ্রান্সে। ফরাসি সেনাবাহিনীকে ঠেকাতে দরকারি অস্ত্র বানাতে মিলানের ডিউক ভিঞ্চির জন্য বরাদ্দকৃত সেই ব্রোঞ্জই দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে ঘোড়াটি আর কখনোই ভিঞ্চির হাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নি। শেষে তিনি তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি ঘোড়াটার ব্যাপারে আর কিছুই বলবো না।”
১১) স্বয়ংক্রিয় গাড়ি
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ডিজাইন করা এ গাড়িটিকে বিশ্বের সর্বপ্রথম যান্ত্রিক গাড়ি বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কারণ কোনো চালকের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজেই চলতে পারতো এ গাড়িটি। অবশ্য ভিঞ্চি তার নোটবুকে এ ডিজাইন পুরোটা এঁকে যান নি। যেটুকু বাকি ছিলো, তা এখনকার যুগের ইঞ্জিনিয়ারদের মাথা খাটিয়ে বের করতে হয়েছে।
সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ধারণাটি হলো- গাড়িটি চালাতে সম্ভবত স্প্রিংয়ের সাহায্য নেয়ার কথা ভাবা হয়েছিলো। মেইন স্প্রিংগুলো ড্রাম আকৃতির ধারকের মাঝে রাখা হতো, যেগুলো হাতের সাহায্যেই প্যাঁচানো যেত। আজকালকার দিনের বাচ্চাদের খেলনার মতো যখন স্প্রিংয়ের প্যাঁচ খুলতে থাকতো, তখন গাড়িটি সামনের দিকে এগোতে শুরু করতো। স্টিয়ারিং ঠিক রাখার জন্য গিয়ারে বিভিন্ন ব্লক ব্যবহার করা হয়েছিলো। গাড়িটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটি কেবল ডানদিকেই মোড় নিতে পারতো।
১২) রবোটিক নাইট
মানবদেহের গঠন কাঠামো ভিঞ্চিকে সবসময়ই বিমোহিত করেছে। এজন্য বিভিন্ন সময়ই লাশের ব্যবচ্ছেদ করে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এ দেহের কর্মকৌশল। এভাবে গবেষণা চালাতে চালাতেই একসময় তিনি বুঝতে শুরু করেন কীভাবে মাংসপেশিগুলো হাড়কে চালিত করে। পরে তিনি ভাবলেন, এই একই ধারণা কাজে লাগিয়ে হয়তো মেশিনের ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক কিছু একটা করা সম্ভব।
এভাবে চিন্তা করতে করতেই কাজে লেগে গেলেন ভিঞ্চি। অবশেষে একদিন সত্যি সত্যিই তিনি একটি রবোটিক নাইট তৈরি করতে সক্ষম হন। তবে এ নাইট কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ করে আসে নি, বরঞ্চ ভিঞ্চির ধনী পৃষ্ঠপোষক সফোরজার আয়োজিত নানা পার্টিতে আগত অতিথিদের মনোরঞ্জনের ব্যবহৃত হতো সেটি। আজ অবশ্য সেই রবোটটির কোনো অবশিষ্টাংশ টিকে নেই। এটা যে অতিথিদের সামনে কী কী করতে পারতো সেটাও পুরোপুরি জানার উপায় নেই। মূলত পুলি ও গিয়ার ব্যবহার করেই বানানো হয়েছিলো এ রবোটিক নাইটকে।