সৌরচালিত হেলিকপ্টার এবং ড. হাসান শহীদের গল্প

বিজ্ঞান যাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। নতুন নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে বিশ্ব আজ দেখছে নতুন নতুন স্বপ্ন। যদিও এই বিজ্ঞান চর্চায় আধুনিক বিশ্ব থেকে অনেকাংশেই পিছিয়ে আছে আমাদের দেশ, কিন্তু দেশের বাইরে আমাদের সূর্য-সন্তানেরা ঠিকই তাদের পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছেন বিশ্ব দরবারে। বিজ্ঞানী আবুল হুসমামের ‘সনো ফিল্টার’ আবিষ্কার থেকে শুরু করে রুবাব খানের পঞ্চ-নক্ষত্র আবিষ্কার, বাঙালি বিজ্ঞানীরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন সর্বত্র। প্রযুক্তি জগতে এরকমই একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে সৌরচালিত হেলিকপ্টার বা ‘সোলার কপ্টার’, যার পিছনেও রয়েছে আরেকজন প্রতিভাবান বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর প্রয়াস।

ড. হাসান শহীদ, লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রোবোটিকস কন্ট্রোল এন্ড কম্পিউটিং-এর অধ্যাপক এই বিজ্ঞানীর নেতৃত্বেই ২০১৩ সালের জুনে আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রথম সৌরচালিত হেলিকপ্টার। বিজ্ঞানী মহলে এই আবিষ্কারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কেননা সৌরচালিত হেলিকপ্টার যদি বাণিজ্যিকভাবে আলোর মুখ দেখে, তাহলে হয়তো বেঁচে যাবে এভিয়েশন খাতে খরচ হওয়া বিপুল পরিমাণ শক্তি। আর স্বাভাবিকভাবে এই গ্রিন এনার্জির প্রয়োগের ফলে উপকৃত হবে আমাদের পরিবেশ।

সোলার-কপ্টার পর্যবেক্ষণ করছেন বিজ্ঞানী হাসান শহীদ; Source: the daily star

সোলার কপ্টারের পিছনের গল্প

বেশ কয়েক বছর ধরেই এই সৌরচালিত হেলিকপ্টার বা সোলার চপার নিয়ে গবেষণা করছিলেন হাসান শহীদ। ২০১১ সালে কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়েই হাসান শহীদের তত্ত্বাবধানে তাঁর ইরানী ছাত্র আলী আবিদালী সোলার চপার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তখনকার মডেলটিও আকাশে উড়তে পারতো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেটি পূর্ণ সৌরচালিত ছিল না। একটা সময় ব্যাটারির সাহায্য নিতেই হতো।

শুধুমাত্র সূর্যের আলো দিয়ে হেলিকপ্টার উড়াবেন, তখন থেকে এটাই ছিল হাসান শহীদের ধ্যানজ্ঞান। তখন এই প্রজেক্টে ড. শহীদের সাথে সহ-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক এন্টনিও মুনজিযা। দেখতে দেখতে একসময় এই প্রকল্প যোগ হয় মাস্টার্সে। গবেষণা প্রকল্পে যোগ দেন আরো ৬ জন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই গবেষণা দলেও ছিলেন আরেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শাকির আহমেদ। কম্পিউটার ডিজাইন আর গবেষণার মাধ্যমে চলতে থাকে এই দলের দীর্ঘ পথচলা। সময়টা একঘেয়ে হলেও একদিক দিয়ে রোমাঞ্চকরও ছিলো, কেননা সাফল্য মানেই বিপ্লব। হেলিকপ্টার ডিজাইনে গবেষণা দলের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল তিনটি: হালকা, মজবুত এবং স্বল্প-শক্তি ব্যয়। পাঁচ মাসের পরিশ্রমের পর তৈরী হয় স্বপ্নের হেলিকপ্টার, যার ওজন এক কেজিরও কম। নাম দেয়া হয়, ‘সোলার কপ্টার’।

যেহেতু ইংল্যান্ডের মতো দেশে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাওয়া যায় না, সোলার কপ্টারের ওড়ার ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য তাই ল্যাবে হ্যালোজেন ল্যাম্পের সমন্বয়ে তৈরী করা হয় সান সিমুলেটর। রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সচল করা মাত্রই সান সিমুলেটরের সাহায্যে ঘুরতে থাকে হেলিকপ্টারের চারটি চাকা। আলোর মুখ দেখে বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম সৌরচালিত হেলিকপ্টার

সান সিমুলেটরের নিচে প্রস্তুত ‘সোলার কপ্টার’; source: Prothom Alo

সোলার কপ্টারের আকার

সাধারণ হেলিকপ্টারের চেয়ে সোলার কপ্টারের বাহ্যিক গড়ন পুরোই আলাদা। আমরা যে হেলিকপ্টার দেখে অভ্যস্ত তাতে প্রপেলার বা পাখা থাকে দুটি। লেজের দিকে একটি, আর উপরে একটি বড় পাখা। কিন্তু সোলার কপ্টারে চার কোনায় কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে চারটি পাখা থাকে। এই অদ্ভুত আকার দেয়ার পিছনের উদ্দেশ্য একটিই, সূর্য থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তি নিশ্চিত করা। বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহার হলে নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক পরিবর্তন আসবে এই ডিজাইনে।

কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ‘সোলার কপ্টার’; Source: designboom

ড. হাসান এন্ড টিম

নবায়নযোগ্য সৌরশক্তি চালিত বিশ্বের প্রথম এই হেলিকপ্টার নির্মাণের পিছনে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ড. শহীদ নিজেই। সহ-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁর সাথে পুরো গবেষণা কাজ দেখভাল করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এন্টনিও মুনজিযা। তাঁদের সাথে কাজ করেছে মাস্টার্সের ৬ জন প্রতিভাবান তরুণ। তাদের একেকজন ছিলেন একেকটি দায়িত্বে। যেমন: সোলার প্যানেল তৈরির দায়িত্বে ছিলেন আলী আবিদালী। এই দলের অন্য বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শাকির আহমেদ কাজ করেছেন সৌরশক্তির বর্তমান অবস্থা এবং কী ধরনের সোলার সেল ব্যবহার করা যেতে পারে হেলিকপ্টারটির জন্য তা নিয়ে। কপ্টারটির আকার ও কাঠামো নিয়ে কাজ করেছেন কাজিমিরেজ ওজোওদা।

সোলারকপ্টার টিমের সাথে ড. হাসান শহীদ; Source: mahfujalam

বিশ্ববিখ্যাত টিভি চ্যানেল ডিসকভারি এই দলের উপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করে তাদের ‘ডেইলি প্লানেট শো’ অনুষ্ঠানে। সেখানে এই সোলার কপ্টারকে বিশ্বের প্রথম সৌরচালিত হেলিকপ্টার ঘোষণা করা হয়। ডিজাইনবুম, গিজম্যাগ, ইনহ্যাবিট্যাটসহ বিশ্বের নামকরা অনেক প্রযুক্তি ম্যাগাজিনও ফলাও করে প্রচার করে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের খবর।

কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে পরীক্ষামূলক উড্ডয়নরত ‘সোলার-কপ্টার’;  Source:  inhabitat

কী কাজে লাগবে (সোলার কপ্টারের ভবিষ্যত)

নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার এই সৌরচালিত হেলিকপ্টার। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করার জন্য বিশ্বে যে আন্দোলন চলছে, সোলার কপ্টারের বাণিজ্যিক ব্যবহার সেই আন্দোলনকে আরো বেগবান করবে। এভিয়েশন খাতে খরচ হওয়া বিপুল শক্তির অনেকটাই হয়তো বাঁচিয়ে দেবে এই হেলিকপ্টার। এছাড়া ড. শহীদের মতে ক্যামেরা এবং জিপিএস কাজে লাগিয়ে এই হেলিকপ্টারটিকে নজরদারির কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। যেহেতু ওজন কম, আকারে ছোট এবং মূল্য-সাশ্রয়ী, তাই পুলিশী কিংবা গোয়েন্দা তদারকিতে এই কপ্টার ভালো কাজে দিবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। যদি এই হেলিকপ্টারের সাথে ক্যামেরা এবং জিপিএস সংযুক্ত করা হয়, তাহলে পুলিশী বা গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ, অপরাধ দমন, উদ্ধারকাজ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে এটি ব্যবহার করা সম্ভব হবে। মেরু বা বরফপ্রবণ অঞ্চলে এর ব্যবহার এতটা কার্যকরী না হলেও মধ্যপ্রাচ্য বা নিরক্ষীয় অঞ্চলগুলোতে এই সোলার কপ্টারের ব্যবহার খুবই কার্যকরী হবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। তখন সাহারা মরুভূমি বা সুন্দরবনের মতো সুবিশাল বনে জীবজন্তুর বিচরণ পর্যবেক্ষণ বা আবহাওয়া বিষয়ক খবরাদি সংগ্রহ করতে পারবে এই হেলিকপ্টার।

আমাদের হাসান শহীদ  

তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে তো অনেক কিছুই জানলেন, এবার আসুন জেনে নেই আবিষ্কারের পিছনের ব্যক্তিটিকে। বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের ছেলে হাসান শহীদ। ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিল হাসান, যার ফলশ্রুতিতে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ক্যাডেট হাসান। মেধা তালিকাতেও তার স্থান ছিল উপরের দিকেই। তারপর ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে এ গ্র্যাজুয়েশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে। এখানেও তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটিতে। তখন তার গবেষণার বিষয় ছিল রোবটের হাত নিয়ন্ত্রণ। এই শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি থেকেই তিনি তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পিএইচডি শেষে ২০০১ সালে যোগ দেন কুইন মেরি ইউনিভার্সিটিতে। বর্তমানে তিনি সিনিয়র প্রফেসর হিসেবে স্কুল অব ম্যাটেরিয়াক সায়েন্স বিভাগে রোবোটিকস এন্ড কন্ট্রোলের উপরে গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রভাবশালী ১০০ বাংলাদেশির মধ্যে তাঁকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে একসময় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রচুর লেখালেখিও করেছেন হাসান শহীদ। ২০০৭ সালে সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘এলিয়েন: সম্ভাবনা ও সন্ধান’ এবং ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘মহাবিস্ময়ের মহাকাশ’।

‘প্রফেসর অব কন্সেপ্ট’ পুরষ্কার হাতে ড. হাসান শহীদ; Source: Queen Marry University website

সৌরচালিত হেলিকপ্টার আবিষ্কার করেই বসে থাকেননি হাসান শহীদ, দ্যুতি ছড়িয়েছেন তাঁর নিজের ভুবন রোবোটিক্সেও। আরেকটি সাড়া জাগানো আবিষ্কারেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হয় ট্যাবলেট আকৃতির ‘ক্যামেরা রোবট’ যা রোগীর নাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ভেতরের ছবি ও তথ্য দিতে সক্ষম। এই আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেই আশা করছেন বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে ক্যান্সারের চিকিৎসায়। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ ‘প্রফেসর অব কন্সেপ্ট’ পুরষ্কারে ভূষিত করে।

বিভাগের অন্য গবেষকদের সাথে হাসান শহীদ; Source: Queen Marry University website

ড. হাসান শহীদের মতো ব্যক্তিদের জন্যই আজ বিশ্বদরবারে আমরা বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারি। বলতে পারি, “আমরাও পারি”। হাসান শহীদের মতো প্রতিভাবান আরো অনেকেই হয়তো জন্মেছেন আমাদের দেশে, হয়তো নিজেদের কৃতিত্বের প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্য কোনো শাখায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁদের প্রায় সবাই নিজেদের গবেষণা চালাচ্ছেন প্রথম বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে। কারণ আমাদের দেশ তাঁদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। আজ যদি জাতি হিসেবে আমরা হাসান শহীদদের মূল্যায়ন করতে পারতাম, এ দেশ হয়তো থাকতো নতুন এক উচ্চতায়।

 

Related Articles

Exit mobile version